আয়ারল্যান্ড তারকা পল স্টার্লিং
আয়ারল্যান্ড তারকা পল স্টার্লিং

সাক্ষাৎকারে পল স্টার্লিং

‘প্রতিদিন সেরাটা দিতে হলে গিরগিটির মতো রং বদলাতে হবে’

১৭ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন। শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই সতীর্থ ও প্রতিপক্ষ হিসেবে খেলেছেন ১ হাজার ৬৭ জন ক্রিকেটারের সঙ্গে। স্বীকৃত ক্রিকেটে খেলেছেন ৩৩টি দলের হয়ে। আয়ারল্যান্ডের সাদা বলের অধিনায়ক পল স্টার্লিং এখন টেস্ট সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে। সিলেটে আজ শুরু প্রথম টেস্টের আগে প্রথম আলোকে তিনি শুনিয়েছেন তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতার কথা—

প্রশ্ন

বাংলাদেশে এসে কেমন লাগছে?

স্টার্লিং: আসার পর থেকে অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। জাতীয় দলের সঙ্গে আমার প্রথম সফর ছিল বাংলাদেশেই। তখন বয়স মাত্র ১৭ বছর। মিরপুরে গ্যালারিভর্তি দর্শক। কোনো কিছু যখন আপনার জীবনে প্রথম ঘটে, সেই স্মৃতি সব সময় একটু বিশেষই থাকে।

প্রশ্ন

এখন আপনার বয়স ৩৫ বছর। এই সময়ে তো ক্রিকেটও অনেক বদলে গেল!

স্টার্লিং: হ্যাঁ, গত ১০ বছরে অনেক বেশি বদলে গেছে। যখন শুরু করেছিলাম, তখনো ৫০ ওভারের ক্রিকেটই ছিল সবকিছু, ২৫০–২৬০–২৭০ রান করাটাই ছিল অনেক। এখন তা বেশির ভাগ সময়ই কম হয়ে যায় বড় দলগুলোর বিপক্ষে। আয়ারল্যান্ডের ক্রিকেটার হিসেবে সব সময়ই মনে হয়, সময়ের চেয়ে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি কি না। কোচিং স্টাফ এবং খেলোয়াড়দের জন্য এটাই চ্যালেঞ্জ। তবে আমার মনে হয়, যা কিছু বদলাচ্ছে, তা ভালোর জন্যই। টেস্ট ক্রিকেট এখনো ভালোভাবে টিকে আছে, টি–টোয়েন্টি লাইমলাইটে এসেছে। দেখা যাক, আগামী ১০ বছরে ক্রিকেটটা আর কীভাবে বদলায়।

বাংলাদেশে এর আগেও এসেছেন পল স্টার্লিং
প্রশ্ন

আপনি শুধু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই খেলেছেন ২৯টি দলের বিপক্ষে, নিজেও খেলেছেন ৩৩টি ভিন্ন ভিন্ন দলের হয়ে। এত সতীর্থ বা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলার অভিজ্ঞতা কেমন?

স্টার্লিং: ক্রিকেটার হিসেবে তো বটেই, এটা আমাকে মানুষ হিসেবেও গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। ভিন্ন সংস্কৃতি, মানুষ, ভাষা, জীবনযাত্রা—সব রকম অভিজ্ঞতাই হয়েছে। এখন আমি মানুষ হিসেবে যেমন, হয়তো তার অর্ধেকও হতে পারতাম না যদি ঘুরে ঘুরে এত ক্রিকেট না খেলতাম।

প্রশ্ন

এটা তো বড় একটা চ্যালেঞ্জও। আজ হয়তো একেবারে ফোর্থ ডিভিশনের কোনো দলের সঙ্গে খেলছেন, মাসখানেকের মধ্যেই আবার টেস্ট খেলতে নামতে হচ্ছে!

স্টার্লিং: তা তো বটেই, কিন্তু এটাকে আমি কাজের অংশ হিসেবেই মনে করি। সামনে যা–ই আছে, তার জন্য নিজের সেরা খেলা ও শক্তিটা দিতে হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে চলি। প্রতিদিন সেরাটা দিতে হলে গিরগিটির মতো রং বদলাতে হবে। সুইচ করার কাজটা সহজ নয়, কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবে আপনাকে যতটা সম্ভব সেরা জায়গাতেই থাকতে হবে।

আইরিশ ক্রিকেটে পল স্টার্লিং বেশ বড় নাম। ছবিটি এর আগে তাঁর বাংলাদেশ সফরের সময় তোলা
প্রশ্ন

লম্বা ক্যারিয়ারে আয়ারল্যান্ড ক্রিকেটকেও বদলাতে দেখেছেন, সে অভিজ্ঞতা কেমন?

স্টার্লিং: আমি ছিলাম আয়ারল্যান্ডের প্রথম চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারদের একজন। সেমি পেশাদার থেকে এখন পুরো পেশাদার চুক্তি হচ্ছে। এই জিনিসটা থেকেই পরিবর্তন সম্পর্কে আঁচ করতে পারবেন। সহযোগী দেশ থেকে টেস্ট মর্যাদাও পেলাম। খুব দ্রুতই হয়ে গেছে সব। এখন আর কোনো সহজ ম্যাচ নেই আমাদের জন্য। আশা করি পরের ১০ বছরে আপনারা আরও অনেক উন্নতি দেখতে পাবেন।

প্রশ্ন

প্রথম টেস্ট খেলার অনুভূতি কি মনে করতে পারেন?

স্টার্লিং: আমি টেস্ট ক্রিকেট দেখেই বেড়ে উঠেছি, ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নও টেস্ট দেখেই। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে অ্যাশেজ দেখেছি। ছোটবেলা থেকে বিশ্বাস করেছি, এটাই ক্রিকেট। আমার সব নায়কেরাই টেস্ট ক্রিকেটার। আমি একটা পর্যায় পর্যন্ত বিশ্বাসই করতাম না, আয়ারল্যান্ডের হয়ে কোনো দিন সাদা জার্সি পরে খেলব। যখন তা বাস্তব হলো, ওই অনুভূতি অন্য রকম ছিল।

প্রশ্ন

টেস্ট খেলার জন্য আপনাকে তো কঠিন একটা সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছিল…

স্টার্লিং: হ্যাঁ, ব্রিটিশ পাসপোর্ট ছিল আমার। হয় বিদেশি ক্রিকেটার হিসেবে কাউন্টি খেলতে হতো, নয়তো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়তে হতো। কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, আমি মিডলসেক্সে ১০ বছর খুব উপভোগ করেছি। এখনো লন্ডনেই থাকি। কিন্তু দিন শেষে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, বিশ্বকাপ ও বিশ্বসেরাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়তে চাইনি। কাউন্টিতে না খেললে আমি এখন যেমন ক্রিকেটার, তাঁর অর্ধেকও হতে পারতাম না। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

টেস্ট ক্রিকেটও উপভোগ করেন পল স্টার্লিং
প্রশ্ন

আপনাকে নিয়ে তো সবার ধারণা, আসবেন আর ধুমধাড়াক্কা মারবেন!

স্টার্লিং: ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে কিন্তু এমন ছিলাম না যে উইকেটে গিয়েই বড় ছক্কা মারার চেষ্টা করব। টেকনিক ভালো ছিল, টাইমিংও ভালো হতো, ছক্কা তখনো কিছু মারতাম। কিন্তু টি–টোয়েন্টি এসে সব বদলে দিয়েছে। দলে আমার ভূমিকাও এর একটা কারণ। অপর পাশে এমন কেউ থাকত, যে দীর্ঘক্ষণ ব্যাট করে, তখন আমি চেষ্টা করেছি দ্রুত রান করতে। অন্যদের ওপর থেকে চাপ কমাতে কমাতেই আমার খেলার ধরন এমন হয়ে গেছে।

প্রশ্ন

দীর্ঘ সংস্করণে কীভাবে মানিয়ে নেন?

স্টার্লিং: এখানে আপনাকে সঠিক মানসিকতায় থাকতে হবে। হাতে সময় থাকে, বল ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ আছে। যদিও ভিত্তিটা একই। যতবারই আমরা টেস্ট ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুতি নিই, ততবার আমি সংক্ষিপ্ত সংস্করণের জন্যও আরও পরিপক্ব হই। বেসিকগুলো আবার ঝালিয়ে নেওয়া যায়। যখন ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টিতেও টেস্ট ক্রিকেটকে অনুসরণ করতে পারব, তখনই দল হিসেবে আরও শক্তিশালী হতে পারব।

প্রশ্ন

আরও প্রায় এক দশক আগে ইয়ন মরগ্যান বলেছিলেন, আপনার প্রতিভার দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি পাওয়া উচিত। সেটা কি পেয়েছে বলে মনে হয়?

স্টার্লিং: আমি আসলে নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফিরে তাকানোর সময় পাইনি। মাঝপথে এসে সেই সুযোগও কম। কিন্তু যে সময় কাটিয়েছি, তা উপভোগ করেছি। খেলাটাকে আরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে, এটা ভেবেই এখনো চালিয়ে যাচ্ছি। হয়তো ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু দেখা বাকি আছে।

টেস্টের মেজাজেও ব্যাট করতে পারেন পল স্টার্লিং
প্রশ্ন

সামনে তো একটা বড় মাইলফলকও আছে। টি–টোয়েন্টিতে আর আট ম্যাচ খেলেই আপনি রোহিত শর্মাকে ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা ক্রিকেটার হয়ে যাবেন…

স্টার্লিং: সংখ্যা নিয়ে কখনো তেমন ভাবিনি। কিন্তু এটা আমার অবিশ্বাস্যই লাগে। এই তালিকায় খুব ভালো ক্রিকেটারদের নাম আছে, যারা পুরো বিশ্বে দাপট দেখিয়েছে। তাদের পাশে নাম দেখলে ভালো লাগে।

প্রশ্ন

ভবিষ্যতে আয়ারল্যান্ডের ক্রিকেটটাকে কেমন দেখতে চান?

স্টার্লিং: মৌলিক বিষয়গুলো আগে ঠিকঠাক করতে হবে—সেরা কোচ ও খেলোয়াড়দের ধরে রাখতে হবে। অন্য খেলাগুলোতে আমাদের অনেক ক্রিকেটার চলে যাচ্ছে। পুলটা তাই ছোটই থাকছে। কিন্তু এটা তো অজুহাত হতে পারে না। এত কিছুর পরও গত ২০–৩০ বছরে আমরা অনেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার তৈরি করেছি। জয়ের অভ্যাস ধরে রাখতে হবে। কে জানে, কোনো ম্যাচ জেতা দেখে হয়তো আয়ারল্যান্ডের কোনো শিশু ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখবে!