
৩১ জানুয়ারি রান্নাবিদ সিদ্দিকা কবীরের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। শারমিন লাকি তাঁর সঙ্গে ‘সিদ্দিকা কবীর’স রেসিপি নামে রান্নার অনুষ্ঠান করেছেন দীর্ঘদিন। নকশার পাঠকদের তিনি জানিয়েছেন সিদ্দিকা কবীরের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা। সেই সঙ্গে সিদ্দিকা কবীরের প্রিয় কয়েকটি রান্না করেছেন নিজের হাতে।
সিদ্দিকা কবীর আপার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী? আমরা কি বউ-শাশুড়ি? তিনি কি আমার খালা? এমন প্রশ্নই সবচেয়ে বেশি শুনতে হয় আমাকে। তাঁদের বলে রাখি, আমরা আসলে বউ-শাশুড়ি নই। এমনকি তিনি আমার পরিবারেরও কেউ নন।
তবে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম। আমরা যখন রান্নার অনুষ্ঠানটা শুরু করলাম, আমি খানিকটা দূরেই থাকতাম। প্রথম দিকে আমাদের সম্পর্কটা ছিল অম্ল-মধুর, খানিকটা বউ-শাশুড়ির মতোই। আমি ভয়ে ভয়ে তখন আপার পাশে উপস্থাপনা করতাম। এরপর একটা সময়ে তিনি আমাকে কাছে টেনে নেন। নানা ধরনের রান্না শিখেছি আমি তাঁর কাছ থেকে। এক রান্নাঘরে নয় বছর একসঙ্গে কাটিয়েছি আমরা। তাই, আমাদের রসায়নটাও বদলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।
আপা আমাকে আদর করে সুহাসিনী বলে ডাকতেন। তাঁর দেওয়া বইটাতে এই নামটাই লেখা আছে।
তিনি সব সময়ে চাইতেন আমি যেন সুন্দর করে সেজে থাকি। তাই সেজেছি আপার পছন্দমতোই। নীল শাড়ির সঙ্গে কপালে নীল টিপ দিয়ে। আপা আমার টিপ পরা খুব পছন্দ করতেন।
অনুষ্ঠানের এই নয়টা বছর আমরা সেজেছি পাশাপাশি বসে। আপা শুরুতে একদমই সাজতে চাইতেন না। আমি জোর করে সাজাতাম। শেষের দিকে আপা সেটে আগে এলেও আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। আর আমি আগে গেলে আপার জন্য অপেক্ষা করতাম। আমি আপার সাজ ঠিক করে দিতাম। তাঁকে অনেক বুঝিয়ে শেষের দিকে রঙিন পোশাক পরিয়েছি। তাঁর চুল কীভাবে বাঁধা হবে, সেটা আমি ঠিক করে দিতাম। আমাদের এই সময়ের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো। আপা বা আমি সব ধরনের হাসি-আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতাম। অনেকে মনে করেন আপা কম হাসতেন। তাঁর হাসি দেখেছি আমি। আমরা সেটে যখন গল্প করতাম, হো হো করে আপা হাসতেন।
আপার রান্নায় যেন জাদু ছিল। যা-ই রান্না করতেন, আমার মনে হতো, এটাই সেরা। মনে হতো, রসায়নের গবেষণাগারে বসে আপা জাদুর মতো নতুন কিছু বানিয়ে ফেলছেন। তাঁর অনেক পছন্দের রান্না ছিল ম্যাশ পটেটো, অরেঞ্জ কেক, ভেজিটেবল সতে। আপার কাছে আমার প্রথম শেখা বেকিং ছিল এই অরেঞ্জ কেক। আপা রান্না করলে পুরো সেটে সেই গন্ধ ছড়িয়ে যেত।
আমার ফোনে আপার নম্বরটা এসকে আপা দিয়ে সেভ করা। এখনো আছে। কোনো নম্বর খুঁজতে গেলে কখনো আপার নামটা দেখলেই কষ্টে বুকটা ভেসে যায়। ভাবতে পারি না, এই নম্বর থেকে আর কখনো আপার ফোন আসবে না। বলবে না, ‘হ্যালো সুহাসিনী...’।
অরেঞ্জ কেক
উপকরণ: ময়দা ১ কাপ, বেকিং পাউডার আধা চা-চামচ, বাইকার্বনেট অব সোডা আধা চা-চামচ, ডিম ৩টি, টক দই ১ কাপ, নরম মাখন আধা কাপ, চিনি ১ কাপ, কমলার খোসা কুচি ১ টেবিল চামচ, কমলার রস একটি কাপের চার ভাগের এক ভাগ, কমলার কোয়া ৩ টেবিল চামচ।
প্রণালি: ওভেনে ১৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ দিন। কেক তৈরির প্যানে কাপ বা চার কোনা ট্রে বসিয়ে রাখুন। ময়দা, বেকিং পাউডার, বাইকার্বনেট অব সোডা একসঙ্গে চেলে নিন। দই ছাকনিতে বা কাপড়ে নিয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। মাখন চিনির সঙ্গে ফেটে একটা করে ডিমের কুসুম দিয়ে ফেটে নিন। এবারে কমলার রস, কোয়া ও খোসার কুচি মেশান। ময়দা কয়েক ধাপে হালকা করে মিশিয়ে নিন। দই মেশান। ডিমের সাদা অংশ ফেটে মেরাং করে নিন। ময়দার মিশ্রণে মেরাং মিশিয়ে নিন। কেকের কাপে বা ট্রেতে অধিকাংশ স্থানে চামচ দিয়ে মাখন দিন। ওভেনে ১৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে ৪০-৬০ মিনিট অথবা কেক তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বেক করে নিন।
লাজানিয়া
প্রথমেই লাজানিয়া শিট তৈরি করে নিতে হবে।
লাজানিয়া শিট তৈরির উপকরণ: ময়দা ১ কাপ, ডিম ১টি, পানি ১ টেবিল চামচ
মাংসের গ্রেভির উপকরণ: সসেজ ৩টি, গরুর মাংসের কিমা এক কাপের তিন ভাগের দুই ভাগ, টমেটো কুচি ৪টি, জলপাই তেল ২ টেবিল চামচ, পেঁয়াজ কুচি ৩ টেবিল চামচ, রসুন কুচি ১ টেবিল চামচ, গাজর কুচি সিকি কাপ, উস্টার সস ২ চা-চামচ, সাদা গোলমরিচের গুঁড়া সিকি কাপ, সরষের পেস্ট আধা চা-চামচ, পেঁয়াজপাতা কুচি ১ টেবিল চামচ, টমেটো পেস্ট ২ টেবিল চামচ, পারমিশান পনির কুচি ১০০ গ্রাম, লবণ ও চিনি স্বাদমতো।
শিট তৈরির প্রণালি: সব উপকরণ মিশিয়ে নিয়ে মেখে রাখতে হবে। লাজানিয়া বেকিংয়ের ডিশে বিছিয়ে চারদিকে ঝুলে থাকে এই মাপের ৫টি পাতলা শিট বেলে নিন। প্রথম শিট থেকে পরেরগুলো ক্রমান্বয়ে ছোট হবে। তবে চাইলে বাজার থেকে শিট কিনেও নিতে পারেন।
মাংসের গ্রেভি প্রণালি: এক চা-চামচ জলপাই তেলে সসেজ ১ মিনিট ভেজে নিন। সসেজ কুচি করে আরও এক চা-চামচ তেলে ভাজুন। ঠান্ডা করে আরও ছোট কুচি করুন। এবার টমেটোর ওপরের পাতলা আবরণ ছাড়িয়ে কুচি করুন। সসপ্যানে বাকি জলপাই তেল দিয়ে কিমা মৃদু আঁচে ১ মিনিট ভেজে নিন। এবার সসেজ, পেঁয়াজ, রসুন ও সব সবজি দিয়ে ২ মিনিট ভাজুন। এরপর টমেটো ও মাস্টার্ড পেস্ট দিন। এবারে উস্টার সস, গোলমরিচ, চিনি আর লবণ দিয়ে ১ মিনিট রান্না করে নামিয়ে নিন। পাশপাশি হোয়াইট সস তৈরি রাখুন।
এবার মাংসের স্তর তৈরি ও বেক করার জন্য ওভেনে ২২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ দিন। ৪-৫ ইঞ্চি গভীর পাইরেক্সের চার কোনা পাত্রে সয়াবিন তেল বা মাখন মাখিয়ে নিন। সবচেয়ে বড় শিটটা পাত্রের তলায় ও চারপাশে সমান করে বসিয়ে বাড়তি অংশ কেটে ফেলুন। শিটের ওপরে গ্রেভি, হোয়াইট সস, পনির পর পর স্তরে স্তরে বিছিয়ে দিন। বাড়তি শিট দিয়ে ঢেকে দিন। এভাবে চার স্তর করার পরে ওপরে ছোট শিট দিয়ে ঢেকে নিয়ে তার ওপরে পনির ছিটিয়ে দিন। এরপর গরম ওভেনে ৩০ মিনিট বেক করে নামিয়ে নিন।
সবজি সতে
উপকরণ: পছন্দমতো সবজি নিন। এর মধ্যে ব্রকলি, গাজর, বরবটি থাকলে রংটা ভালো দেখাবে। সামান্য মাখন। গোলমরিচ গুঁড়া ও লবণ স্বাদমতো।
প্রণালি: সবজিগুলো দুবার সেদ্ধ করে ভাপিয়ে নিন। এরপর কড়াইয়ে অল্প মাখন দিয়ে হালকা ভেজে নামিয়ে নিন। এটাকে বলে শ্যালো ফ্রাই। এবার নামিয়ে নিয়ে ওপরে একটু হালকা গোলমরিচ আর লবণ ছিটিয়ে পরিবেশন করুন ম্যাশ পটেটোর পাশেই।
ম্যাশড পটেটো
উপকরণ: এক কেজি আলু, মাখন ২০০ গ্রাম, এক লিটার দুধ।
প্রণালি: আলু সেদ্ধ করে ভালোমতো মেখে নিন। এরপর সেটা জ্বাল দেওয়া দুধে মাখনসহ ঢেলে দিন। কিছুক্ষণ হালুয়ার মতো জ্বাল দিয়ে নামিয়ে ফেলুন। নামানোর আগে দেখে নিন, বেশি পাতলা হলো কি না। মাঝারি মানের হলে, অর্থাৎ শক্ত বা নরম কোনোটাই অধিক নয়, এমন সময়ে নামিয়ে পরিবেশন করুন। এটা হালুয়ার মতো হবে।