ডেল এডুকেশন চ্যালেঞ্জ, যুক্তরাষ্ট্র

আশার আলো

তাঁরা পাঁচজন স্বপ্ন দেখেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার। তাঁরা স্বপ্ন দেখেন এমন সব জায়গায় শিশুদের কাছে কম্পিউটার পৌঁছে দেওয়ার, যেখানে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। তাঁরা রাতের আঁধারকে ভয় পান না, কারণ দিনের সূর্যকে ধরে রাখতে জানেন তাঁদের কাজে। শুধু স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত হননি, তাঁরা কাজে লেগেছেন কোমর বেঁধে। ঘুরে বেড়িয়েছেন সেসব জনপদে, যেখানে শিক্ষা এখনো মেলে ধরতে পারেনি তার আলোকিত ডানা। সেখানে মানুষের দিন আজও কাটে অজ্ঞানতার আঁধারে, আধুনিক বিজ্ঞান এখনো জয় করতে পারেনি সেসব জনপদ। কিন্তু আমাদের এই সাহসী স্বাপ্নিকেরা শুরু করে দিয়েছেন তাঁদের অভিযান। জয়ী তাঁরা হয়েই আসবেন আঁধারের-অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রামে। আর তাঁদের শক্তি হয়ে প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে সূর্যের শক্তি সৌরবিদ্যুৎ।

এই পাঁচ সৈনিক হলেন আরিফ মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ ভূঁইয়া, তৃপ্তি প্রজাপতি, মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, মীর মোহাম্মদ নাজমুল আরেফিন ও মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম। নেপালের মেয়ে তৃপ্তি প্রজাপতি এই অভিযানে অংশ নিয়েছেন সহযোগী হিসেবে। বাকি চার জনই বাংলাদেশি। তাঁরা স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন গাজীপুরের ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইইউটি) থেকে। তাঁদের প্রকল্প ‘লাইট অব হোপ’ বা আশার আলো নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন ২০১১ সাল থেকে। প্রকল্পের প্রাথমিক অংশ হিসেবে নোয়াখালীর চরাঞ্চলে তাঁরা সৌরশক্তিচালিত পাঁচটি স্কুল খুলবেন, যেগুলো একই সঙ্গে দুটি কাজ করবে। প্রথমত, গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকায় এই স্কুলগুলোয় স্থাপন করা সোলার প্যানেল গ্রামের মানুষের শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করবে। সাধারণ মানুষ এখানে মুঠোফোনে চার্জ করতে পারবে, জরুরি ই-সেবাও পাবে। অন্যদিকে, একটি ক্লাস, একজন শিক্ষক—এই মডেলের সঙ্গে একটি ল্যাপটপ যোগ করে এই স্কুলগুলো হয়ে উঠবে শিশুদের তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক জ্ঞান লাভের সূতিকাগার। শিক্ষার্থীরা রাতেও সেসব স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পাবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিটি স্কুলই হবে চর এলাকায় একেকটি বাতিঘর, যার আলোয় দূর হবে ওই এলাকার সব অজ্ঞানতা। এরই মধ্যে দেশের প্রথম সারির একটি উন্নয়ন সংস্থা এবং কয়েকটি সৌরপ্রযুক্তি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছে।

থেমে নেই আমাদের স্বাপ্নিকেরাও। তাঁরা কাজ করছেন আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে তহবিল সংগ্রহ করে আরও বিস্তৃত পরিসরে এই প্রকল্পকে চালু করতে। ২০১৩ সালে ডেল আয়োজিত এডুকেশন চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের লাইট অব হোপ উঠে এসেছে সেরা তিনটি প্রকল্পের একটি হিসেবে। এই বছর ডেল এডুকেশন চ্যালেঞ্জে অংশ নেয় ৮১৬টি প্রকল্প। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে তিনটি প্রকল্পকে ফাইনালিস্ট নির্বাচিত করা হয়। বাংলাদেশের লাইট অব হোপ ছাড়াও আছে মেক্সিকোর প্রকল্প ‘অ্যাবি’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রকল্প ‘ইমারসড গেমস’।

দলনেতা আরিফ মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ ভূঁইয়া তাঁদের প্রকল্প সম্পর্কে বলেন, এই মুহূর্তে প্রকল্পের ডিজাইন অংশ চূড়ান্ত হয়েছে। এর পরের ফেজ পাইলট টেস্টিং। এই পর্যায়ে প্রথমে পাঁচটি এবং আগামী তিন বছরে চর এলাকায় ১০টি কমিউনিটি স্কুল স্থাপন করা হবে। চার থেকে আট বছরের মধ্যে তিনটি উপকূলীয় এলাকায় ৩০টি স্কুল চালু করা হবে। দলের পাঁচজন সদস্য শিক্ষার্থী ও পেশাজীবী। তাঁদের অবস্থান পৃথিবীর একেক প্রান্তে। আরিফ মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ ভূঁইয়া ও তৃপ্তি প্রজাপতি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিচ্ছেন জার্মানির ফ্লেন্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, শক্তি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। মীর মোহাম্মদ নাজমুল আরেফিন ব্যস্ত পিএইচডির গবেষণায়, অস্ট্রেলিয়ার সুইনবার্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়ো মেডিক্যাল ইমেজ প্রসেসিংয়ের ওপরে। অন্যদিকে, মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শিক্ষকতা শুরু করেছেন দেশেই, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও এআইইউবিতে।

৯ থেকে ১৩ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের অস্টিন শহরে বসবে ডেল এডুকেশন চ্যালেঞ্জ-২০১৩-এর গ্র্যান্ড ফাইনালের আসর। প্রথম পুরস্কার ১০ হাজার ডলারের জন্য তাঁরা লড়বেন, একই সঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করবেন লাল-সবুজ স্বপ্নের। তাঁদের হাত ধরে আশার আলো জ্বলে উঠুক দেশের প্রতিটি জনপদে।