
স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে কর্মীর বেতন দেওয়া থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্যের বাজারে প্রবেশ, এ যেন মাহমুদুল হাসানের হার না–মানা এক সংগ্রামের গল্প। বর্তমানে তিনি লন্ডনে ‘রিয়েলিস্টিক থ্রিডি লিমিটেড’ নামে নিজের কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। স্ত্রী আফরিনা পারভিনকে নিয়ে ঢাকায় ত্রিমাত্রিক স্টুডিওর পর এটি তাঁদের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে এই উদ্যোক্তা দম্পতি ১৭ জনের একটি দল পরিচালনা করছেন, যাঁদের বেতন বাবদ প্রতি মাসে খরচ হয় প্রায় ১৩ লাখ টাকা।
তবে আজকের এই সাফল্যের পেছনের গল্পটা মোটেও সহজ ছিল না। সম্প্রতি ঢাকার উত্তরা অফিসে গিয়ে ও লন্ডন থেকে ভিডিও কলে মাহমুদুল হাসান শোনালেন তাঁদের অদম্য পরিশ্রমে গড়া সেই কঠিন পথচলার গল্প।
মাহমুদুল হাসানের বাবা কামরুল হাসান শুরুতে ব্যবসায়ী থাকলেও জীবনের শেষ দিকে ছিলেন স্কুলশিক্ষক। মাহমুদুল নিজে ২০০২ সালে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। পড়াশোনা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৬ সালে, কিন্তু নানা কাজের চাপে তা শেষ করতে ২০১২ সাল হয়ে যায়। মাহমুদুল হাসানের পেশাগত জীবনের শুরুটা হয় ২০০৫ সালে ল্যাটিটিউড ২৩ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। এরপর দেশের প্রখ্যাত স্থপতিদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান তিনি। ২০০৯ সালে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন। মূলত দেশীয় কোম্পানির জন্য থ্রিডি ভিজ্যুয়ালাইজেশনের কাজ।
২০১০ সালে স্ত্রী আফরিনা পারভিনকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নিজেদের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ত্রিমাত্রিক স্টুডিও। মাহমুদুল সেসব দিনের কথা স্মরণ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরুতে প্রায়ই কাজের টাকা পেতে দেরি হতো। অনেক সময় দলের সদস্যদের বেতন দিতে ঋণ করতে হতো। এমনও সময় গেছে, যখন আমার স্ত্রীর বিয়ের স্বর্ণালংকার স্বর্ণকারের কাছে বন্ধক রেখে টাকা ধার করে বেতন পরিশোধ করতে হয়েছে।’
অনেক ঈদে নিজেদের জন্য কিছুই কেনেননি, তবুও কর্মীদের বেতন নিশ্চিত করেছেন। মাহমুদুল হাসান, তাঁর স্ত্রী আফরিনা ও সহকর্মী সুলতান মাহমুদ এমন অনেক ঈদ কাটিয়েছেন একেবারে নিঃস্ব হয়ে, শুধু দায়িত্ব পালনের তৃপ্তিটুকুই ছিল সম্বল।
তখনকার ধীরগতির ইন্টারনেট ও থ্রিডি রেন্ডারিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিশালী কম্পিউটারের বাজেট না থাকায় সংগ্রাম ছিল আরও কঠিন। গ্রাহকদের ডেডলাইন মেটাতে গিয়ে রাত–দিন পরিশ্রম করতে হতো, বাদ পড়ত অসংখ্য সামাজিক অনুষ্ঠান।
এই কঠিন সময়ে মাহমুদুল হাসানের পাশে ছায়ার মতো ছিলেন স্ত্রী আফরিনা পারভিন, যিনি একাধারে একজন স্থপতি ও আপওয়ার্কের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার। ২০১২ সালে আফরিনা পারভিন ফ্রিল্যান্সার ডটকমে প্রথম একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্প পান। সেই প্রকল্পটিই ছিল বৈশ্বিক বাজারে তাঁদের প্রবেশের সূচনা। এরপর ধীরে ধীরে ওডেক্স (বর্তমান আপওয়ার্ক)–এ কাজ শুরু হয় এবং আন্তর্জাতিক গ্রাহক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। স্বামী–স্ত্রীর এই জুটি মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে ঢাকার ত্রিমাত্রিক স্টুডিওকে একটি সফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে।
মাহমুদুল হাসান–আফরিনার সেই পরিশ্রম আজ বৃথা যায়নি। ত্রিমাত্রিক স্টুডিও এখন ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠিত নাম। চলতি বছরের মে মাসে মাহমুদুল হাসান লন্ডনে রিয়েলিস্টিক থ্রিডি লিমিটেড নামে নতুন কোম্পানি নিবন্ধন করেছেন। তাঁর বর্তমান লক্ষ্য হলো, এই কোম্পানির মাধ্যমে নিজেকে সেলফ স্পনসর করে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং কোম্পানিটিকে একটি আন্তর্জাতিক মানের সৃজনশীল প্রতিষ্ঠানে গড়ে তোলা।
মাহমুদুল হাসান তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী দুই বছরের মধ্যে আমাদের দলকে বর্তমানের ১৭ থেকে অন্তত ৩০ জনে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমার স্বপ্ন শুধু থ্রিডি রেন্ডারিং কোম্পানি নয়; বরং একটি সম্পূর্ণ সৃজনশীল এজেন্সি হিসেবে গড়ে তোলা।’
মাহমুদুল হাসান এমন একটি ‘ওয়ান–স্টপ’ সমাধান তৈরি করতে চান, যেখানে একজন গ্রাহক থ্রিডি ভিজ্যুয়ালাইজেশন, বিআইএম, ভিআর অ্যানিমেশন, কনটেন্ট তৈরি ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো সব সেবা একই ছাদের নিচে পাবেন। আফরিনা পারভিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো ডিজাইন, প্রযুক্তি ও কল্পনাশক্তিকে একত্র করে এমন ভিজ্যুয়াল অভিজ্ঞতা তৈরি করা, যা ব্র্যান্ড ও কোনো প্রকল্পকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে।’