
মমঙ্গল গ্রহের উপযোগী রোবট বানিয়ে ‘ইউআইইউ মার্স রোভার টিম’ ২০২২ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বমঞ্চে টানা ছয়টি সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশের পতাকাকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। প্রতিটি সাফল্যের পেছনে রয়েছে অদম্য সংগ্রাম, অধ্যবসায় ও নিরলস পরিশ্রমের গল্প।
ঢাকার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) ইউআইইউ মার্স রোভার টিম ২০২৫ সালের ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ (ইউআরসি) প্রতিযোগিতায় এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বব্যাপী ষষ্ঠ স্থান অর্জন করে। এ ছাড়া প্রতিযোগিতার সায়েন্স মিশনে বিশ্বে প্রথমবারের মতো ১০০-এর মধ্যে পূর্ণ ১০০ নম্বর পেয়ে এক বিরল রেকর্ড করে। তবে এই মঞ্চে এটি তাদের প্রথম অর্জন নয়। সাফল্যের ধারাবাহিকতা চলছে টানা পাঁচ বছর ধরে। একই বছরে অনুষ্ঠিত আনাতোলিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জে (এআরসি) দলটি ১৮ ফাইনালিস্টের মধ্যে বিশ্বব্যাপী তৃতীয় এবং এশিয়ায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
২০২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের কয়েকজন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় গঠন করেন ইউআইইউ মার্স রোভার টিম। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে তাঁরা বিশ্বমঞ্চে প্রথমবার সাফল্য নিয়ে আসেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৯৯টি দলের অংশগ্রহণে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় ৩৬টি ফাইনালিস্ট দলকে পেছনে ফেলে এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বব্যাপী ১৩তম স্থান অধিকার করে দলটি।
২০২৩ সালে ১০৪টি দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে, ৩৭টি ফাইনালিস্ট দলের মধ্য থেকে ইউআইইউ বিশ্বব্যাপী নবম ও এশিয়ায় আবারও ১ম স্থান অধিকার করে। এ ছাড়া ২০২৩ সালে তুরস্কে আয়োজিত আনাতোলিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় ১৯টি ফাইনালিস্ট দলের মধ্যে ইউআইইউ তৃতীয় এবং সিস্টেম বিভাগের ম্যাটেরিয়াল সিলেকশন চ্যালেঞ্জে বিশেষ পুরস্কার অর্জন করে।
২০২৪ সালে ১০২টি প্রাথমিক দল ও ৩৮ ফাইনালিস্টের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পঞ্চম ও এশিয়ায় আবারও চ্যাম্পিয়ন হয় দলটি। ছয়টি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রতিবারই এশীয় অঞ্চলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বিরল রেকর্ড করেছে ইউআইইউ মার্স রোভার টিম।
২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে গঠিত হয় সেন্টার ফর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রোবোটিকস। এর অধীনে ইউআইইউ মার্স রোভার টিম পায় তাদের প্রথম ডেডিকেটেড ল্যাব। বর্তমানে এই দলে কাজ করছেন প্রায় অর্ধশত তরুণ-তরুণী, যার মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ নারী। তবে মূল প্রতিযোগিতা চলাকালীন আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পান মাত্র ১০ জন শিক্ষার্থী।
এই গৌরবময় সাফল্য অর্জন করতে শিক্ষার্থীদের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। শিক্ষার্থীরা জানান, একাডেমিক ও রোভার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের দায়িত্বে প্রথমে প্রাধান্য দিতে হয় দলের কাজকে। বছরের স্বাভাবিক দিনগুলোয় ক্লাসের সময় বাদে বাকি পুরো সময় তাঁরা রোভার প্রস্তুতিতে ব্যয় করেন। প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি চলাকালীন ছয় মাস শিক্ষার্থীরা ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা এই কাজে নিয়োজিত থাকেন। এ সময় দলের ১৫ থেকে ২০ জন তরুণ ল্যাবেই রাত্রিযাপন করেন, ঘুমের সুযোগ পান মাত্র ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা।
দল হিসেবে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে যন্ত্রপ্রকৌশল বিভাগ না থাকা। ইউআইইউতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগ থাকলেও, রোভার তৈরিতে কারিগরি দলকে নানা সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। দলের অন্য সদস্যদেরই যন্ত্রপ্রকৌশলের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো রপ্ত করে কাজ এগিয়ে নিতে হয়েছে, যা ছিল বেশ কঠিন।
শিক্ষার্থীরা জানান, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হয় খুবই কম। এমনকি অনেকে ঈদ, পূজা বা অন্যান্য উৎসবের দিনগুলোতেও নিজ পরিবারের কাছে না গিয়েও কাজ করেন রোভার তৈরিতে। দলের সায়েন্স সাব–টিম লিডার সাইফ আল সাদ প্রথম আলোকে জানান, ‘চলতি বছরে ঈদুল আজহার দিন আমরা ছিলাম প্রতিযোগিতা থেকে ফিরতি ফ্লাইটে।’
দলনেতা মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সামাজিক জীবন বলতে আসলে কিছু নেই।’ সাব-টিম লিডার শেখ সাকিব হোসেন আরও যোগ করেন, ‘আমরা সামাজিক জীবনে অনেক কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও, দলের সদস্যরা একে অপরের খুব কাছের, আমরাই একটা পরিবার।’
দলীয় অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের বিষয়ে তাঁরা বলেন, ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা দলের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিই। এ বছরের প্রতিযোগিতায় আমাদের মেন্টর শিক্ষক আদিব হোসেন ছাড়া দলের প্রত্যেক সদস্যেরই ছিল প্রথমবার অংশগ্রহণ। সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয়েছে একেবারে অনভিজ্ঞতার সঙ্গে। কিন্তু, আমরা তাতে সফল হতে পেরেছি।’
দলের নারীদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সদস্য আয়েশা আক্তার প্রথম আলোকে জানান নারী হিসেবে রোবোটিকসে সুযোগ, সীমাবদ্ধতা ও সংগ্রামের কথা। তিনি বলেন, রোবোটিকসে মেয়েদের জায়গা খুবই কম, পরিবার বা সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সুযোগও কম। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ দলের নারী সদস্যদের ল্যাবে অবস্থানের সুযোগ দেয় সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। সেরিব্রাল বা ফিজিক্যাল প্রেশার এক হলেও দলের পুরুষ সদস্যরা রোভার প্রস্তুতিতে বেশি কর্মঘণ্টা দিতে পারে, নারীদের নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই সমপরিমাণ কাজ করে দিতে হয়। অবকাঠামোগত এই সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে একই সঙ্গে তিনি কৃতজ্ঞতা জানান ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ ও মার্স রোভার দলের প্রতি।
ইউআইইউ মার্স রোভার টিম নিজেদের সাফল্য ধরে রাখার জন্য একটি অভিজ্ঞ ব্যাচ বের হয়ে যাওয়ার আগেই সদস্য নবায়ন করে থাকে। বর্তমানে দলের নবাগত সদস্যরা এর পঞ্চম প্রজন্মের অংশ। ইন্টার্ন মেরিনা মনতাজ বলেন, ‘রোবোটিকস যেহেতু একটি জটিল বিষয়, আমাদের একাগ্রতার সঙ্গে সব বিষয় সিনিয়রদের কাছ থেকে বুঝে নিতে হয়। দৈনিক তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় আমাদের ল্যাবে কাজ করতে হয়।’
দলের জ্যেষ্ঠ সদস্য শেখ সাকিব হোসেন ও সাইফ আল সাদ জানান, তাঁরা দেশের কম্পিউটারব্যবস্থা নিরাপত্তায় কাজ করতে চান। এ ছাড়া ইউআইইউ মার্স রোভার টিম ইউনিভার্সিটি মার্স রোভার প্রতিযোগিতায় ভবিষ্যতে শুধু এশীয় নয়, বরং বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রত্যাশা রাখে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে ইউআইইউ মার্স রোভার টিম অংশগ্রহণ করতে চায় সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়তানির্ভর ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ (ইআরসি) প্রতিযোগিতায়। তার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, সংশিষ্ট শিল্প খাতের সহায়তা এবং বড় অঙ্কের বাজেট।