১৯২২ সালে নিউইয়র্কের সিরাকিউসে এয়ার কন্ডিশনারের জনক উইলিস এইচ ক্যারিয়ার ও তার রেফ্রিজারেশন মেশিনের ছবি
১৯২২ সালে নিউইয়র্কের সিরাকিউসে এয়ার কন্ডিশনারের জনক উইলিস এইচ ক্যারিয়ার ও তার রেফ্রিজারেশন মেশিনের ছবি

রেফ্রিজারেশন কালে কালে

প্রকৃতিকে বশ করে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য মানবসভ্যতায় বিস্ময়কর সব উদ্ভাবন দেখা যায়। রেফ্রিজারেশন বা হিমায়ন পদ্ধতি তেমনই একটি উদ্ভাবন বলা যায়। এই উদ্ভাবন মানুষের জীবনযাপন ও খাদ্য সংরক্ষণের ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তির ফ্রিজ ও এসির ব্যবহার পর্যন্ত দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রা দেখা যায়।

রেফ্রিজারেশন পদ্ধতির ধারণাটি আধুনিক হলেও, খাদ্য সংরক্ষণের জন্য শীতল বস্তুর ব্যবহারের প্রবণতা মানব–ইতিহাসের প্রায় শুরু থেকেই বিদ্যমান। প্রাচীন সভ্যতায় মানুষ প্রাকৃতিকভাবে বরফ ও তুষার ব্যবহার করত খাবার ঠান্ডা রাখার জন্য। পারস্যে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে ইয়াকচাল নামের একধরনের ঠান্ডা ঘরে মাটির নিচে বরফ সংরক্ষণ করা হতো। রোমানরা পর্বত থেকে বরফ এনে খাবার ও পানীয় ঠান্ডা রাখত বলে জানা যায়। প্রাচীন মিসরীয়রাও রাতের বেলায় পানিকে বাষ্পীভূত করে শীতল করার কৌশল ব্যবহার করত। মধ্যযুগে বরফ সংরক্ষণের কৌশল আরও উন্নত হয়। ইউরোপে বরফঘর তৈরি করে বরফ গ্রীষ্মকালের জন্য সংরক্ষণ করা হতো। বরফ সংগ্রহ তখন একটি লাভজনক ব্যবসা ছিল। ভারত ও চীনেও মাটির নিচে বরফ সংরক্ষণ ও ব্যবহারের প্রচলন ছিল। এই সময়ে লবণ ও বরফের মিশ্রণ ব্যবহার করে তাপমাত্রা কমানোর ধারণা বিকশিত হয়।

রেফ্রিজারেশন পদ্ধতির আসল বিপ্লব আসে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ১৭৪৮ সালে স্কটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম কুলেন প্রথম কৃত্রিমভাবে শীতলতা তৈরির ধারণা দেন। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পরীক্ষা পরিচালনা করেন। তিনি ইথার ব্যবহার করে একটি আংশিক শূন্যস্থানে শীতলতা তৈরি করেন। এটি ছিল বাষ্পীভবনের মাধ্যমে শীতলতা তৈরির প্রথম পরীক্ষামূলক প্রমাণ ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী রেফ্রিজারেশন যন্ত্রের নমুনা তৈরি করেন।

১৯৪০–এর দশকে প্রথম ডিপ ফ্রিজের ধারণা জনপ্রিয় হয়

১৮০৫ সালে মার্কিন উদ্ভাবক অলিভার ইভানস প্রথম রেফ্রিজারেশন যন্ত্র তৈরি করেন। এখানে তিনি তরলের বদলে বাষ্প ব্যবহার করেন। একই ধরনের আরেকটি যন্ত্র ১৮৪৪ সালে জন গোরি তৈরি করেন। ১৮৫৬ সালে বাণিজ্যিকভাবে রেফ্রিজারেশন ব্যবস্থা চালু করেন মার্কিন ব্যবসায়ী আলেকজান্ডার টুইনিং। ১৮৫৯ সালে একটু আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন ফ্রান্সের ফার্দিনান্দ ক্যারে। ক্যারে অ্যামোনিয়া ব্যবহার করেন। তাঁর তৈরি রেফ্রিজারেটর অনেক জনপ্রিয়তা পায়। এখনো কুলিং মেথড হিসেবে অ্যামোনিয়ার ব্যবহার হয়। ১৮৫৯ সালে ফ্রান্সের এডওয়ার্ড টুসেইন্ট গ্যাসনির্ভর রেফ্রিজারেশন সিস্টেম উন্নত করেন। জার্মানির কার্ল ভন লিন্ডে ১৮৭৬ সালে প্রথম কমপ্রেসড অ্যামোনিয়া রেফ্রিজারেটর উদ্ভাবন করেন। তিনি অ্যামোনিয়া, সালফার ডাই–অক্সাইড ও মিথাইল ক্লোরাইড ব্যবহার করেন।

আধুনিক রেফ্রিজারেটরের পূর্বসূরি দেখা যায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। ১৮৩৪ সালে আমেরিকান উদ্ভাবক জ্যাকব পারকিন্স প্রথম একটি বাষ্প-সংকোচন রেফ্রিজারেশন সিস্টেম তৈরি করেন। ১৮৯৪ সালে হাঙ্গেরীয় উদ্ভাবক ইস্তেভান রক বড় আকারের অ্যামোনিয়া রেফ্রিজারেটর চালু করেন। ১৯২০–এর দশকে যখন বিদ্যুৎ সহজলভ্য হয় তখন গৃহস্থালির ব্যবহারের জন্য ফ্রিজ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ১৯১৩ সালে প্রথম বৈদ্যুতিক রেফ্রিজারেটর বাড়িতে ব্যবহারের জন্য উদ্ভাবন করেন ফ্রেড উল্ফ। ১৯১৪ সালে প্রকৌশলী ন্যাথানিয়েল ওয়েলস বৈদ্যুতিক রেফ্রিজারেশন ইউনিটের ধারণা দেন, যা পরে কেলভিনেটর ব্র্যান্ডের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯৩০–এর দশকে ফ্রেয়ন রেফ্রিজারেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

কেলভিনেটর ফ্রিজের সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন

এয়ারকন্ডিশনার বা এসির ইতিহাসও রেফ্রিজারেশন পদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯০২ সালে উইলিস ক্যারিয়ার আধুনিক এসির আবিষ্কার করেন। প্রাথমিকভাবে এটি মুদ্রণ কারখানায় কাগজ ও কালির আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হতো। ১৯১৪ সালে সাধারণ বাড়িতে প্রথম এয়ারকন্ডিশনিং চালু হয়, যা তৈরি করেন চার্লস গিলবার্ট গেটস। ১৯২০–এর দশকে সিনেমা হল ও অন্যান্য বড় জনসমাগমের স্থানে এসির ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৩১ সালে এইচ এইচ শুলজ এবং জে কিউ শেরমান প্রথম সাধারণ ব্যবহারের জন্য এসি উদ্ভাবন করেন। ১৯৩২ সালে প্রথম গাড়িতে এসি–ব্যবস্থা চালু হয়।

সূত্র: ক্যারল গ্যান্টজের লেখা রেফ্রিজারেশন: আ হিস্টোরি বই