বিজ্ঞান মেলায় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রটির কার্যকারিতা তুলে ধরেছে খুদে বিজ্ঞানীরা। বাঁ থেকে সাদমান চৌধুরী, সাবির ফারহান হক, নাহিদুল ইসলাম, আবদুল্লাহ আজিম ও বিচারক ঝলক ঘোষ
বিজ্ঞান মেলায় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রটির কার্যকারিতা তুলে ধরেছে খুদে বিজ্ঞানীরা। বাঁ থেকে সাদমান চৌধুরী, সাবির ফারহান হক, নাহিদুল ইসলাম, আবদুল্লাহ আজিম ও বিচারক ঝলক ঘোষ

খুদে বিজ্ঞানী

চার কিশোরের আগুন নেভানোর স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র

পত্রিকা কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চোখ রাখলে দেখা যায় অগ্নিদুর্ঘটনা। অগ্নিদুর্ঘটনার কারণে প্রতিবছর হারিয়ে যাচ্ছে বহু জীবন ও মূল্যবান সম্পদ। এই ভয়াবহতাকে প্রযুক্তির মাধ্যমে রুখে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে কুমিল্লার চারজন কিশোর। কয়েক সপ্তাহের প্রস্তুতির নিরলস প্রচেষ্টায় তারা তৈরি করেছে এক বিস্ময়কর বিজ্ঞান প্রকল্প। তাদের এই প্রকল্পের নাম অটোমেটেড ফায়ার এক্সটিংগুইশার বা স্বয়ংক্রিয় আগুন নেভানোর যন্ত্র। এই যন্ত্র অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগুন নিভিয়ে দিতে সক্ষম।

কুমিল্লা শহরের চার খুদে বিজ্ঞানীর দল ‘ব্লেজ স্কেপ’ এই প্রকল্প তৈরি করেছে। দলের সদস্যরা হলো আবদুল্লাহ আজিম (দলনেতা), সাদমান চৌধুরী, নাহিদুল ইসলাম ও সাবির ফারহান হক। সবাই কুমিল্লার এথনিকা স্কুল ও কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাদের এ প্রকল্প সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স ক্লাব আয়োজিত বিজ্ঞান মেলায় প্রথম স্থান অর্জন করে। এরপর নিজ স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় সেরা প্রকল্পের পুরস্কার জিতে নেয় তারা।

অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রটির কার্যকারিতা

ব্লেজ স্কেপের তৈরি স্বয়ংক্রিয় ফায়ার এক্সটিংগুইশারটি একটি সহজ কিন্তু কার্যকর প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হবে। এতে একটি তাপমাত্রা সংবেদনশীল সেন্সর ব্যবহার করা হবে। যখন কোনো কক্ষে তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট বিপৎসীমা অতিক্রম করে যা আগুনের উপস্থিতি নির্দেশ করে তখন সেন্সরটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগুন নেভানোর উপাদান, যেমন পানি বা রাসায়নিক ফোম নির্গত করতে শুরু করে। এটি বিশেষত বন্ধ কক্ষ, সার্ভার রুম বা এমন বদ্ধ জায়গায় অত্যন্ত কার্যকর বলে জানায় খুদে বিজ্ঞানীরা। যেখানে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের পক্ষে পৌঁছানো কঠিন, সেসব এলাকায় অগ্নিনির্বাপণের এই উদ্ভাবন কাজে আসবে। ভবিষ্যতে এই প্রকল্পে রোবট ও ড্রোন ব্যবহার করে উন্নত করার সুযোগ থাকবে বলে জানায় খুদে বিজ্ঞানীরা।

কুমিল্লা শহরের চার খুদে বিজ্ঞানীর তৈরি স্বয়ংক্রিয় আগুন নেভানোর যন্ত্রের নমুণা

কিশোরদের প্রচেষ্টা ও উদ্ভাবনের গল্প

এই প্রকল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও উপকরণ কিনতে কিশোরেরা নির্ভর করেছে তাদের নিজেদের জমানো অর্থের ওপর। মাত্র দুই থেকে তিন হাজার টাকা এবং সীমাহীন কৌতূহলকে সম্বল করে তারা এ যন্ত্র তৈরি করেছে। দলনেতা আবদুল্লাহ আজিম তাদের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে বলে, ‘আমরা ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করছিলাম। কুমিল্লা হোক বা ঢাকা হোক, এমন কোনো সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছিলাম, যা সবার কাজে আসে। আমরা শুধু চেয়েছি আমাদের কাজ দেশের মঙ্গলে আসুক। অগ্নিকাণ্ড একটি জাতীয় সমস্যা, যা অর্থনীতি ও জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতি করে। আমাদের যন্ত্রটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যাতে মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই এটি আগুনের উৎস শনাক্ত করে নেভানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে।’

দলের আরেক সদস্য সাদমান চৌধুরী বলে, ‘আমরা সব সময়ই প্রযুক্তির মাধ্যমে নাগরিক সমস্যা সমাধানের জন্য ভাবি। আমরা বিশ্বাস করি, স্কুল-কলেজে আমরা যে জ্ঞান অর্জন করছি, তা কেবল পরীক্ষার খাতায় সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে প্রয়োগ করা উচিত। যন্ত্রটি সেই ভাবনারই ফল।’

নাহিদুল ইসলাম তাদের উদ্ভাবনের পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করে বলে, ‘অগ্নিকাণ্ডে অনেক জীবন ও মূল্যবান সম্পত্তি চোখের সামনে চলে যেতে দেখেছি। সেই সমস্যাকে আমরা দূর করতে চাই। আমাদের এই ছোট প্রচেষ্টা যদি একটি জীবনও বাঁচাতে পারে, তবে আমাদের পরিশ্রম সার্থক।’

অন্যদিকে সাবির ফারহান হক খুব সরলভাবে তাদের প্রেরণার কথা জানায়। সে বলে, ‘আমরা আমাদের চারপাশের সমস্যা সমাধানের জন্য এ প্রকল্প তৈরি করেছি। বিজ্ঞান মানেই তো আবিষ্কার, যা মানুষের জীবনকে সহজ ও নিরাপদ করে তুলবে।’

ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা

ক্লাসের নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা গল্পে সময় পার করেন এই কিশোরেরা। নিজেদের স্কুলে কোনো বিজ্ঞান গবেষণাগার কিংবা আইসিটি ল্যাব না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অনলাইন সাইট থেকে ধারণা নিয়ে প্রকল্প তৈরি করার চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীরা। এই চার কিশোরের চোখেই এখন দূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন। তারা কেবল স্কুলের প্রকল্প জেতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না, তাদের প্রত্যেকেরই লক্ষ্য একদিন সত্যিকারের উদ্ভাবক বিজ্ঞানী হয়ে উঠবে। ইনান ভবিষ্যতে সেনা কর্মকর্তা হিসেবে বড় বড় চ্যালেঞ্জ জয় করতে চায়। সাবির হতে চায় চিকিৎসাবিষয়ক গবেষক। সাদমান হতে চায় চিকিৎসক। তামিম হতে চায় প্রকৌশলী।