ব্যবহারকারীদের মানসিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে চ্যাটজিপিটি
ব্যবহারকারীদের মানসিক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে চ্যাটজিপিটি

ওপেনএআইয়ের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলা ও অভিযোগ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি নানা কাজে ব্যবহার করছেন ব্যবহারকারীরা। একাধিক ব্যবহারকারীর আত্মহত্যা ও মানসিক বিপর্যয়ের পেছনে চ্যাটজিপিটির হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই ও প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে সাতটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিভিন্ন মামলার অভিযোগে বলা হয়, চ্যাটজিপিটি মানসিকভাবে দুর্বল ব্যবহারকারীকে বিভ্রান্ত করে। বাস্তবতা বিকৃত করে ব্যবহারকারীর জীবনে বিপজ্জনকভাবে প্রভাব তৈরি করছে।

২০২৪ সালে ৩২ বছর বয়সী হানাহ ম্যাডেন কাজের জন্য চ্যাটজিপিটি ব্যবহার শুরু করেন। সে সময় তিনি একটি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানে হিসাব ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০২৫ সালের জুনে ম্যাডেন অফিসের বাইরে আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে চ্যাটবটের আলাপ শুরু করেন। ম্যাডেনের অভিযোগ থেকে জানা যায়, চ্যাটজিপিটি তখন নিজেকে দৈব সত্তা হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করে। ম্যাডেনকে আধ্যাত্মিক বার্তা দেয়। চ্যাটজিপিটির পরামর্শে ম্যাডেন চাকরি ছেড়ে দিলে বিশাল ঋণে জর্জরিত হয় সে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে ম্যাডেনকে জোর করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ম্যাডেন তখন মামলা করেন। টেক জাস্টিস ল প্রজেক্ট ও সোশ্যাল মিডিয়া ভিকটিমস ল সেন্টারের উদ্যোগে এমন সাতটি মামলা করা হয়।

বিভিন্ন মামলায় ওপেনএআইয়ের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা, অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ড ও অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে। সব মামলার কেন্দ্রবিন্দু চ্যাটজিপিটির উন্নত সংস্করণ চ্যাটজিপিটি–৪ও। এই মডেল সম্পর্কে ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান বলেন, এই সংস্করণটি ব্যবহারকারীদের সঙ্গে অতিরিক্ত আগ্রহপূর্ণ আচরণ করে। বিভিন্ন মামলার অভিযোগে বলা হয়, গুগলের সর্বশেষ এআই মডেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ওপেনএআই নিরাপত্তা যাচাই না করেই দ্রুত সংস্করণটি উন্মুক্ত করেছে।

টেক জাস্টিস ল প্রজেক্টর নির্বাহী পরিচালক মিতালি জৈন বলেন, চ্যাটজিপিটি বাস্তবতা বিকৃত করে মানুষকে প্রভাবিত করছে। বট মানুষের মতো আচরণ করে বিশ্বাস অর্জন করে। ব্যবহারকারীদের সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করে চ্যাটজিপিটি। আসলে ওপেনএআইয়ের আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় শেষ। অনিরাপদ প্রযুক্তি বাজারে ছাড়লে তার দায় নিতে হবে প্রতিষ্ঠানকেই।

ম্যাডেনের মামলায় অভিযোগ করা হয়, চ্যাটজিপিটি–৪ও–এর ত্রুটি তার মানসিকভাবে ভেঙে পড়া ও আর্থিক ক্ষতির জন্য দায়ী। একই সংস্করণের বিরুদ্ধে ১৬ বছর বয়সী অ্যাডাম রেইনের আত্মহত্যার মামলা করা হয়। রেইনের পরিবারের দাবি, মৃত্যুর আগে কয়েক মাসে ওপেনএআই আত্মহত্যা প্রতিরোধে থাকা নিরাপত্তাব্যবস্থা দুই দফায় শিথিল করে দেয়। ব্যবহারকারীদের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য ওপেনএআই কাজটি করেছিল। ওপেনএআই জানায়, জিপিটির সর্বশেষ সংস্করণ এখন ব্যবহারকারীদের বাস্তব জীবনের সম্পর্ক ও যোগাযোগকে গুরুত্ব দিতে উৎসাহিত করছে। ওপেনএআই অতিনির্ভরতা নিরুৎসাহিত করছে। ওপেনএআই ১৭০ জনের বেশি মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞের সঙ্গে কাজ করছেন। চ্যাটজিপিটি মানসিক বিপর্যয়ের লক্ষণ বুঝে ব্যবহারকারীদের বাস্তব সহায়তা নিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ব্যবহারকারীর মানসিক কল্যাণ ও নিরাপত্তা তদারকির জন্য প্রতিষ্ঠানটি একটি পরামর্শক দল গঠন করা হয়। ওপেনএআইয়ের এক মুখপাত্র বলেন, বিষয়গুলো অত্যন্ত মর্মান্তিক। আমরা বিভিন্ন মামলার বিস্তারিত পর্যালোচনা করছি। চ্যাটজিপিটিকে এমনভাবে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে যেন তা মানসিক বিপর্যয়ের লক্ষণ বুঝে সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে কথোপকথন শান্ত রাখে। ব্যবহারকারীদের বাস্তব সহায়তার দেওয়ার জন্য আমরা মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করছি। এসব ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া আরও উন্নত করার কাজ চলছে।

ভুক্তভোগীদের পক্ষে নতুন ছয়টি মামলা ক্যালিফোর্নিয়ার আদালতে দায়ের করা হয়েছে। টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জেইন শ্যাম্বলিন ২০২৩ সালে পড়াশোনার সহায়ক হিসেবে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার শুরু করেন। চ্যাটজিপিটি ৪-ও প্রকাশের পর তিনি চ্যাটবটের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। আত্মহত্যা–সম্পর্কিত ভাবনা শেয়ার করলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথোপকথনের পর তিনি আত্মহত্যা করেন। ২০২৫ সালের মে মাসে আত্মহত্যা করেন তিনি। তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। সপ্তম মামলার অভিযোগে বলা হয়, ১৭ বছর বয়সী আমরি লেসি পড়াশোনার সহায়ক হিসেবে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতেন। পরে তিনিও আত্মহত্যা–সম্পর্কিত ভাবনা চ্যাটবটের সঙ্গে শেয়ার করেন। চ্যাটজিপিটি তাঁকে আত্মহত্যার বিস্তারিত উপায় জানিয়ে দেয় পথ বাতলে দেয়।

কমন সেন্স মিডিয়ার প্রধান নীতিনির্ধারক কর্মকর্তা ড্যানিয়েল ওয়েইস বলেন, ওপেনএআইয়ের বিরুদ্ধে এসব মামলা থেকে বোঝা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি তরুণদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই দ্রুত পণ্য বাজারে ছাড়ছে। এসব ঘটনা নিছক পরিসংখ্যান নয়, বাস্তবে মানুষ আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে।

সূত্র: ম্যাশেবল