বিশ্বের ইতিহাসে কিছু স্থাপনা কেবল নির্মাণশৈলীর দিক দিয়ে নয়; বরং সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। ইসলামের প্রাচীন মসজিদগুলোও সেই ধরনের স্থাপনা। এ মসজিদগুলো শত শত বছর ধরে টিকে আছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কার ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে এগুলোর স্থায়িত্ব বজায় রাখা হয়েছে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে থাকা এই মসজিদগুলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সাক্ষী। বিশ্বের প্রাচীন ১০ মসজিদের একটি তালিকা করেছে ওয়ার্ল্ড এটলাস। এর মধ্যে পাঁচটি মসজিদেরই অবস্থান সৌদি আরবে। তালিকায় নাম থাকা প্রাচীন মসজিদগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
সৌদি আরবের মক্কায় মসজিদুল হারামের অবস্থান। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো মসজিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পবিত্র কাবা শরিফকে ঘিরে এ মসজিদ গড়ে উঠেছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে কাবা সবচেয়ে পবিত্র স্থান।
মসজিদুল হারাম হলো হজ ও ওমরাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বিশাল এ মসজিদে একসঙ্গে প্রায় ৮ লাখ ২০ হাজার মানুষ ইবাদত করতে পারেন। মসজিদের পুরোনো কাঠামোটিতে অনেকবার সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ করা হয়েছে।
কুবা মসজিদের অবস্থান সৌদি আরবের মদিনায়। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করার পর মসজিদটি নির্মাণ করেন। এটি ইবাদতকারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বিশেষ করে পবিত্র রমজান মাসে এখানে ইবাদতকারীদের সংখ্যা উল্লেখজনকভাবে বেড়ে যায়।
বিংশ শতাব্দীতে মসজিদটিকে আধুনিক ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীতে পুনর্নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে এটি সৌদি আরবের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ।
সৌদি আরবের মদিনায় ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদের প্রথম কাঠামোটি তৈরি হয়েছিল মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাড়ির কাছে। কাবার পর এটিকে ইসলামের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান বলে বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন শাসক এটি বড় ও সুন্দর করে তৈরি করেছেন।
মসজিদের সবুজ গম্বুজ খুবই বিখ্যাত। ১৮১৮ সালে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সময়ে এ গম্বুজ তৈরি করা হয়। মসজিদটি হজ ও ওমরাহ পালনকারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারকের অবস্থানও এখানে।
সৌদি আরবের মদিনায় ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদ নির্মিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে এ মসজিদ বিশেষ গুরুত্ব আছে। কারণ, এ মসজিদে নামাজ আদায়ের সময় নবীজি (সা.)-এর ওপর আল্লাহর তরফ থেকে কিবলা বদলের ওহি নাজিল হয়েছিল। নবীজি তখন আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে জেরুজালেমের পরিবর্তে মক্কার দিকে মুখ ঘুরিয়ে, অর্থাৎ কাবামুখী হয়ে নামাজ আদায় করেন।
মসজিদুল কিবলাতাইন প্রথমে দুটি কিবলার জন্য পরিচিত ছিল। একটি কিবলা ছিল জেরুজালেমের দিকে এবং অন্যটি মক্কার দিকে। পরে সংস্কারের মধ্য দিয়ে জেরুজালেমের দিকে থাকা কিবলা সরানো হয়। মসজিদটির ধারণ ক্ষমতা প্রায় দুই হাজার। এটি মুসলিম পর্যটকদের জন্য অন্যতম পছন্দের গন্তব্য।
হুয়াইশেং মসজিদের অবস্থান চীনের গুয়াংজুতে। ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মাণ করা হয়। এ মসজিদ লাইটহাউস মসজিদ নামেও পরিচিত। নাবিকদের দিকনির্দেশক বাতিঘর হিসেবে পরিচিত ৩৬ মিটার উঁচু গোলাকার টাওয়ারের নাম অনুসারে লাইটহাউস নামটি এসেছে।
হুয়াইশেং মসজিদ হলো আরব উপদ্বীপের বাইরে নির্মিত প্রথম মসজিদ। বলা হয়ে থাকে, সপ্তম শতকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চাচা সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চীন ভ্রমণ করেছিলেন। মসজিদটি ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে এবং পরে আবার ১৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দে নতুন করে নির্মাণ করা হয়।
মসজিদ আল-কিবলাতাইন নামের এ মসজিদের অবস্থান সোমালিয়ার জেইলা এলাকায়। এটি খুবই পুরোনো ও ঐতিহাসিক একটি মসজিদ। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারীরা আবিসিনিয়ায় হিজরত করার পর পরই এটি নির্মাণ করা হয়।
মসজিদ আল–কিবলাতায়েন নামের অর্থ ‘দুই কিবলার মসজিদ’। দুটি কিবলার একটি মক্কার দিকে, আর আরেকটি জেরুজালেমের দিকে।
বর্তমানে মসজিদটি অনেকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে এর অবশিষ্টাংশ এবং শেখ বাবু দেনার কবর দেখলে মসজিদটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য বোঝা যায়।
মালিক দিনার নামের এক আরব মুসলিম ধর্মপ্রচারক ভারতের কেরালা রাজ্যের মেথালা এলাকায় ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদ নির্মাণ করেন। ইসলাম ধর্মের প্রসারের আগেই আরব উপদ্বীপের সঙ্গে ভারতের মালাবার উপকূলীয় অঞ্চলের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়।
চের রাজবংশের রাজা চেরামান পেরুমাল আরব ভ্রমণে গিয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করে নিজের নাম পরিবর্তন করে তাজউদ্দিন রাখেন। তবে মসজিদটি আজও সে পুরোনো নাম ‘চেরামান’ নামেই পরিচিত।
চেরামান মসজিদের মতো করে পালাইয়া জুমাপল্লিও ভারতবর্ষের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি। ৬২৮-৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মসজিদটি নির্মিত হয়। তামিলনাড়ুর প্রাচীন বন্দর শহর কিলাকারাইয়ে মসজিদটির অবস্থান।
ইয়েমেনি বণিকেরা এ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। মরক্কোর খ্যাতনামা পর্যটক ইবনে বতুতা ভারতবর্ষে ভ্রমণকালে এ মসজিদ পরিদর্শন করেছিলেন।
সৌদি আরবের হফুফ এলাকার কাছে আল-কিলাবিয়ায় জওয়াথা মসজিদের অবস্থান। মসজিদটি ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে নির্মিত হয়। ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে কারমাতিয়ানরা কাবার হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) চুরি করার পর প্রায় ২২ বছর এটি এখানে রাখা হয়েছিল। এ কারণে মসজিদটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
মসজিদের মূল কাঠামোর একটা বড় অংশ নাই হয়ে গেছে। এখানে সংস্কারকাজ করা হয়েছে। আজও মুসলিমরা এখানে ইবাদত করেন।
কুফা গ্রেট মসজিদের অবস্থান ইরাকের কুফায়। সপ্তম শতকে এটি নির্মাণ করা হয়। চতুর্থ খলিফা আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) এখানে থাকতেন। মসজিদ এলাকায় মুসলিম ইবনে আকিল, হানি ইবনে উরওয়া এবং আল-মুখতারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের সমাধি রয়েছে।
সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সংযোগের কারণে মসজিদটি মুসলিমদের অনেকের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়।
তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড এটলাস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া টুডে