বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০ মরুভূমি, কোথায় এগুলোর অবস্থান

মরুভূমির কথা উঠলেই আমাদের মনে হয় জায়গাটি খুবই গরম হবে, আবহাওয়া হবে প্রচণ্ড শুষ্ক, চারদিকে শুধু বালু আর বালিয়াড়ি, প্রাণের চিহ্ন তেমন দেখা যাবে না। এটা ঠিক যে কয়েকটি অঞ্চলে মরুভূমি এমনই হয়। তবে সব মরুভূমির চিত্র এই বর্ণনার সঙ্গে মিলবে না। মরুভূমি কেমন হবে, সেটা শুধু বৃষ্টি, বালু বা তাপমাত্রা দিয়ে নির্ধারণ করা যাবে না। বিশ্বের সব মহাদেশেই মরুভূমি আছে। সেগুলোর প্রতিটির আকার, ভূপ্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য একেবারেই আলাদা।

অ্যান্টার্কটিক মরুভূমি

বরফে ঢাকা অ্যান্টার্কটিক মরুভূমি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

অ্যান্টার্কটিক দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের একটি মরুভূমি। হিমশীতল এই মরুভূমি ১ কোটি ৪২ লাখ বর্গকিলোমিটার (৫৫ লাখ বর্গমাইল) এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমি। এখানে যেদিকে চোখ যাবে শুধু বরফ আর বরফ। অ্যান্টার্কটিক মরুভূমি পুরো মহাদেশজুড়েই বিস্তৃত। এমনকি এই মহাদেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ এলাকা স্থায়ীভাবে শক্ত বরফের আবরণ দিয়ে ঢাকা। এই মরুভূমিতে বালুর চিহ্ন নেই, নেই গরমও। এটিকে মরুভূমি বলা হয় কারণ, এখানে বছরে গড়ে মাত্র ০ দশমিক ৩৯৪ ইঞ্চি (১০ মিলিমিটার) বৃষ্টি হয়। এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম স্থান। শীতকালে অ্যান্টার্কটিকার তাপমাত্রা মাইনাস ৮৯ ডিগ্রিতে পৌঁছায়। এখানে কোনো মানুষের বসবাস নেই; তবে মাঝেমধ্যে বিজ্ঞানীরা গবেষণার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই মরুভূমিতে ঘাঁটি গাড়েন।

আর্কটিক মরুভূমি

আর্কটিকের রাশিয়া অংশে দায়িত্বরত এক রুশ সেনা

বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুই মরুভূমিই মেরু অঞ্চলে অবস্থিত। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ শীতল মরুভূমি আর্কটিক মরুভূমি। এটি আলাস্কা, কানাডা, গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে ও রাশিয়াজুড়ে বিস্তৃত। এর আয়তন প্রায় ১ কোটি ৩৯ লাখ বর্গকিলোমিটার (৫৪ লাখ বর্গমাইল)। এখানকার তাপমাত্রা অনেক ঠান্ডা এবং বাতাস অনেক শুষ্ক হওয়ায় বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যদিও এখানে তুষার পড়ে। কিন্তু তা গলে পানি হয় না। বরফই থেকে যায়। এখানে নানা প্রজাতির পাখি ও মেরু ভালুক দেখা যায়।

সাহারা মরুভূমি

সাহারা মরুভূমির এই বালিয়াড়ি নাইজারের ফাচি শহরকে ঘিরে রেখেছে

আফ্রিকা অঞ্চলের সাহারা মরুভূমি আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মরুভূমি হলেও এটিই সবচেয়ে বড় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মরুভূমি। এর আয়তন ৯০ লাখ বর্গকিলোমিটার (৩৫ লাখ বর্গমাইল)। আফ্রিকার উত্তরে মিসর, মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, সুদান, মালিসহ প্রায় ১১টি দেশজুড়ে রয়েছে সাহারা মরুভূমি।
আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশজুড়ে সাহারা মরুভূমির বিস্তার। এ মরুভূমির লিবিয়া ও আলজেরিয়া অংশে প্রচুর তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায়। এ ছাড়া তামা, লোহা ও ফসফরাস রয়েছে। এখানে বছরে গড় বৃষ্টি প্রায় ৪ থেকে ১০ ইঞ্চি। সাহারায় ২টি নদী ও ২০টি মৌসুমি হ্রদ রয়েছে।

আরব মরুভূমি

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মরুভূমির মধ্যে আয়তনের দিক দিয়ে দ্বিতীয় বৃহৎ আরব মরুভূমি। এশিয়ায় আরব উপদ্বীপের বেশির ভাগ অংশজুড়ে এই মরুভূমির বিস্তার। আরব মরুভূমি ইয়েমেন থেকে পারস্য উপসাগর, ওমান ও জর্ডান হয়ে ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত। আয়তন প্রায় ২০ লাখ ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার (১০ লাখ বর্গমাইল)।
এখানে ১০২ প্রজাতির স্থানীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ৩১০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। আরও রয়েছে প্রায় ৩৭ প্রজাতির উদ্ভিদ। এর মধ্যে ২০ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায় বালুতে। মরুভূমিটি সাহারা মরুভূমির কাছাকাছি হওয়ায় দিনে এখানকার তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে রাতে তাপমাত্রা অনেক কমে যায়। এই মরুভূমি বিপুল পরিমাণে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। এখানে তেল, সালফারসহ অনেক খনিজ পাওয়া যায়।

গোবি মরুভূমি

আকাশ থেকে তোলা ছবিতে গোবি মরুভূমিতে চীনের একটি মহাকাশ প্রকল্প

এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় এ মরুভূমি রয়েছে চীন ও মঙ্গোলিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলজুড়ে। এর আয়তন প্রায় ১০ লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার (৫ লাখ বর্গমাইল)। এই মরুভূমির বেশির ভাগ অঞ্চলের ভূমি রুক্ষ পাথুরে পাহাড়। ইতিহাসজুড়ে এটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যের পথ ছিল। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার আবহাওয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। শীতকালে যেখানে তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, গ্রীষ্মকালে সেখানে তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। হিমালয়ের কারণে এখানে জলীয়বাষ্পসমৃদ্ধ বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। এ কারণে এখানে বৃষ্টি প্রায় হয় না বললেই চলে।

পাতাগোনিয়ান মরুভূমি

দক্ষিণ আমেরিকার পাতাগোনিয়ান মরুভূমি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম মরুভূমি। মূলত এই মরুভূমির বেশির ভাগ অংশ আর্জেন্টিনায়, তবে প্রতিবেশী দেশ চিলিতেও এ মরুভূমি বিস্তৃত। আয়তনে প্রায় ৬ লাখ ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার (২ লাখ ৬০ হাজার বর্গমাইল)। এ মরুভূমির দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে আন্দিজ পর্বতমালা এবং পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগর। পাতাগোনিয়ান মরুভূমির ভূপ্রকৃতি অনেকটা গোবি মরুভূমির মতো। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক এ মরুভূমিতে ভ্রমণে আসেন। এখানে নানা ধরনের উদ্ভিদ ও প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়।

গ্রেট ভিক্টোরিয়া মরুভূমি

অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় মরুভূমি এটি। মোট আয়তন ৬ লাখ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার (২ লাখ ৫০ হাজার বর্গমাইল)। এখানে রয়েছে লবণাক্ত হ্রদ, ছোট পাহাড় ও ঘাসে ঢাকা উপত্যকা। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। তবে শীতে তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম থাকে। এখানে বছরে গড়ে ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি বৃষ্টি হয়।

কালাহারি মরুভূমি

কালাহারি মরুভূমি আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মরুভূমি। এই মরুভূমির বিস্তার নামিবিয়া, বতসোয়ানা ও দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে। আয়তন ৫ লাখ ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার (২ লাখ ২০ হাজার বর্গমাইল)। এটি একটি আধা শুষ্ক মরুভূমি। এই মরুভূমিতে প্রতিবছর গড়ে চার থেকে আট ইঞ্চি বৃষ্টি হয়। তবে অপেক্ষাকৃত আর্দ্র বছরগুলোতে বৃষ্টি ২০ ইঞ্চিতেও পৌঁছায়। এই মরুভূমিতে অনেক প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়।

গ্রেট বেসিন মরুভূমি

উত্তর আমেরিকার বড় চার মরুভূমির একটি গ্রেট বেসিন মরুভূমি। আয়তন প্রায় ৪ লাখ ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার (১ লাখ ৯০ হাজার বর্গমাইল)। এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯ হাজার ফুট বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা ও উটাহ অঙ্গরাজ্যের বেশির ভাগটাই এই মরুভূমির অংশ। আশপাশের আরও কয়েকটি অঙ্গরাজ্যেও এই মরুভূমি বিস্তৃত। মরুভূমি হলেও শীতকালে এখানে বেশ বরফ পড়ে।

সিরীয় মরুভূমি

সিরিয়ায় সিরিয়ান মরুভূমির একাংশ

সিরিয়া, জর্ডান, সৌদি আরব, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশজুড়ে সিরীয় মরুভূমির বিস্তার। এটির আয়তন প্রায় ৫ লাখ বর্গকিলোমিটার (১ লাখ ৯০ হাজার বর্গমাইল)। সিরীয় মরুভূমি নাম হলেও এর বেশির ভাগ অংশ রয়েছে জর্ডানে, যা দেশটির স্থলভাগের ৮৫ শতাংশ। অন্যদিকে সিরিয়ার স্থলভাগের ৫৫ শতাংশজুড়ে রয়েছে এই মরুভূমি। এর সীমানা গিয়ে মিশেছে আরব মরুভূমিতে। খরা ছাড়াও শিকারসহ মানুষের কিছু কর্মকাণ্ডের জন্য এই মরুভূমির বাস্তুতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে। সেখানে এখন আর স্থানীয় প্রাণীর দেখা মেলে না বললেই চলে।
অতিরিক্ত খরায় অনেক উদ্ভিদ প্রজাতিও মারা গেছে। কিছু ঘাস অবশ্য এখনো টিকে আছে। ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথম ও চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে বেদুইনরা এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। অনেক বেদুইন উপজাতি এখনো এখানে রয়ে গেছেন।
তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস