বিশ্বে চোখজুড়ানো ১০ গ্রন্থাগার

দুনিয়ায় কিছু গ্রন্থাগার আছে, যেগুলো শুধু বই ধার নেওয়ার জায়গা নয়; এগুলো এমন জায়গা, যেখানে লুকিয়ে আছে ইতিহাস, স্থাপত্য আর গল্পের বাইরের গল্প। ওয়ান থাউজেন্ড লাইব্রেরি ২০২৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর গ্রন্থাগারগুলোর একটি তালিকা তৈরি করেছে। অনলাইনে ভোটাভুটির ভিত্তিতে তালিকাটি করেছে তারা। প্রায় দুই লাখ মানুষ এ ভোটাভুটিতে অংশ নেন।

ওয়ান থাউজেন্ড লাইব্রেরি অ্যাওয়ার্ডস নামের সংগঠনটি একসময় একটা ছোট ব্লগ ছিল। কিন্তু এখন এটি বিশ্বজুড়ে বইপ্রেমীদের একটি বড় সংগঠন হিসেবে কাজ করছে। সংগঠনটির তালিকায় স্থান পাওয়া ১০টি নান্দনিক গ্রন্থাগার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

ট্রিনিটি কলেজ গ্রন্থাগার

ট্রিনিটি কলেজ গ্রন্থাগার

ট্রিনিটি কলেজের গ্রন্থাগারটি আয়ারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার। এর অবস্থান ডাবলিনে। এখানে হাজার হাজার বিরল পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নবম শতকের বিখ্যাত ‘বুক অব কেলস’। ট্রিনিটি কলেজ গ্রন্থাগারটি ‘লংরুম’-এর জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এ ‘লংরুম’ হলো ৬৫ মিটার দীর্ঘ একটি করিডর। সেখানে প্রায় দুই লাখ বই সাজানো রয়েছে।

ট্রিনিটি কলেজের এ গ্রন্থাগারে ঢুকতে হলে টিকিট বাবদ ন্যূনতম ২২ ডলার গুনতে হবে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৭০০ টাকা।

স্টেট লাইব্রেরি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়া

স্টেট লাইব্রেরি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়া

গ্রন্থাগারটির অবস্থান অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে। এটি কেবল বইয়ের জন্যই নয়, বরং আরও অনেক দারুণ জিনিসের জন্য পরিচিত। এখানে রয়েছে ঐতিহাসিক বোর্ড গেমের সংগ্রহ। ১৮৬৬ সালে ভিক্টোরিয়ান নকশায় তৈরি মর্টলক চেম্বারের জন্য এটি বেশ সুপরিচিত। গ্রন্থাগারের বেজমেন্টও যেন এক বিশাল সম্পদের ভাণ্ডার। একসময় সেখানে দক্ষ প্রাণিদেহ সংরক্ষণবিদেরা কাজ করতেন। আর এখন সেখানে আছে ৪০ হাজারের বেশি বইয়ের সংগ্রহ।

সেন্ট গ্যালেন অ্যাবি লাইব্রেরি

সেন্ট গ্যালেন অ্যাবি লাইব্রেরি

সেন্ট গ্যালেন অ্যাবি লাইব্রেরি বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থাগারগুলোর একটি। এখানে রয়েছে মধ্যযুগীয় পাণ্ডুলিপির বিশাল সংগ্রহ। সুইজারল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সেন্ট গ্যালেন অ্যাবি একসময় ছিল একটি বড় মঠ।

ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুসারে, অষ্টম শতাব্দী থেকে শুরু করে ১৮০৫ সাল পর্যন্ত এটি ছিল ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ১৯৮৩ সালে স্থানটিকে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে ঘোষণা করে।

ডিউক হামফ্রে’স লাইব্রেরি

ডিউক হামফ্রে’স লাইব্রেরি

এটি মূলত এক গ্রন্থাগারের ভেতর আরেক গ্রন্থাগার। এটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গবেষণা গ্রন্থাগার বডলিয়ান লাইব্রেরির সবচেয়ে পুরোনো পাঠকক্ষ। গ্রন্থাগারটির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একসময় হামফ্রে’স লাইব্রেরির বইগুলো তাকের সঙ্গে শেকল দিয়ে বাঁধা থাকত। আজও এই বইগুলো শুধু বডলিয়ান লাইব্রেরির নির্দিষ্ট পাঠকক্ষেই পড়া যায়।

ডিউক হামফ্রে ছিলেন রাজা চতুর্থ হেনরির ছোট ছেলে। তিনি ১৪৪৭ সালে মৃত্যুর আগে তাঁর সংগ্রহে থাকা ২৮১টি পাণ্ডুলিপি এই গ্রন্থাগারে দান করেন। তবে পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টীয় প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন চলাকালে এই পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে মাত্র তিনটি রেখে বাকিগুলো গ্রন্থাগার থেকে সরিয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়।

অ্যাডমন্ট অ্যাবি লাইব্রেরি

অ্যাডমন্ট অ্যাবি লাইব্রেরি

অ্যাডমন্ট অ্যাবি লাইব্রেরি হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় মঠভিত্তিক গ্রন্থাগার। এর ৭০ মিটার দীর্ঘ হলওয়েতে রয়েছে ৬০ হাজারের বেশি বইয়ের সংগ্রহ। গ্রন্থাগারটি বারোক স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন। এর ছাদজুড়ে রয়েছে সাতটি চমৎকার ফ্রেস্কো চিত্রকর্ম। অস্ট্রিয়ার চিত্রশিল্পী বার্তোলোমেও আল্তোমোন্তে এগুলো এঁকেছেন।

বেনেডিক্টাইন মঠটি এখনো সক্রিয় আছে। সেখানে এখনো সন্ন্যাসীরা বসবাস করেন।

কাইপার্স লাইব্রেরি

কাইপার্স লাইব্রেরি

এ গ্রন্থাগারের অবস্থান নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম শহরে রাইকসমিউজিয়াম নামের জাদুঘরের ভেতরে। যেখানে রেমব্রান্টসহ অন্য ডাচ শিল্পীদের বিখ্যাত চিত্রকর্ম দেখা যায়।

রাইকসমিউজিয়ামের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, কাইপার্স লাইব্রেরি হলো নেদারল্যান্ডসের শিল্প ইতিহাসবিষয়ক সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন গ্রন্থাগার। দর্শনার্থীরা এখানে থাকা বইগুলো পড়তে পারেন এবং নিও-গথিক স্থাপত্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। জাদুঘরের সংগ্রহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দর্শনার্থীরা সেখানে থাকা আইপ্যাডও ব্যবহার করতে পারেন।

স্টেট লাইব্রেরি ভিক্টোরিয়া

স্টেট লাইব্রেরি ভিক্টোরিয়া

স্টেট লাইব্রেরি ভিক্টোরিয়া হলো অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে পুরোনো গণগ্রন্থাগার। এটি বিশ্বের প্রথম দিকের বিনা মূল্যের গণগ্রন্থাগারগুলোর একটি। এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো ‘লা ট্রোব’পাঠ কক্ষ। অষ্টভুজ আকৃতির এ কক্ষের ছাদ ছয়তলার সমান উঁচু। এখানে ৩২০ জন বসে বই পড়তে পারেন। এখানকার তাকগুলোতে ৩২ হাজার বই রাখার জায়গা আছে।

ওয়ান থাউজেন্ড লাইব্রেরি অ্যাওয়ার্ডসের প্রতিষ্ঠাতা ভিনসেন্ট ফান ছাত্রাবস্থায় সেখানে পড়াশোনা করতে যেতেন। সে কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘এখানে ঢুকলে মনে হয় যেন কোনো গির্জায় হাঁটছি...এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে জ্ঞানকে পবিত্র মনে করা হয়…আর গল্পগুলোকে যেন উপাসনা করা হয়।’

রয়েল পর্তুগিজ কেবিনেট অব রিডিং

রয়েল পর্তুগিজ কেবিনেট অব রিডিং

গ্রন্থাগারটির অবস্থান ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে। পর্তুগালের ষোড়শ শতাব্দীর সময়কার একটি মঠের আদলে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে আছে অনেক পুরোনো আর দুর্লভ সব বইপত্র।

পর্তুগালের বাইরে এটিই পর্তুগিজ ভাষার সবচেয়ে বড় বইয়ের সংগ্রহ। এটি শুধু বই পড়ার জায়গা নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রও। এখানে নিয়মিত নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।

ভিব্লিংগেন মনাস্টারি লাইব্রেরি

উইব্লিংগেন মনাস্টারি লাইব্রেরি

গ্রন্থাগারটির অবস্থান জার্মানির উলমে। এই গ্রন্থাগারে ভিড় কম হওয়ার কারণে এটিকে লুকানো রত্ন বলে বিবেচনা করা হয়। ভিব্লিংগেন মঠের উত্তর ভাগে এর অবস্থান।

ভিব্লিংগেন মঠ হলো ১০৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি প্রাচীন বেনেডিকটাইন মঠ। রোকোকো শৈলির নকশার জন্য বিখ্যাত এই গ্রন্থাগার। এর গ্যালারিতে রয়েছে পৌরাণিক ও বাইবেলের চরিত্রদের মূর্তি ও চিত্রকর্ম।

সাঁত-জেনেভি লাইব্রেরি

সাঁত-জেনেভি লাইব্রেরি

ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রন্থাগারটি তৈরি করা হয়েছে। এটির অবস্থান প্যারিসের ব্যস্ততম লাতিন কোয়ার্টারে।

সাঁত-জেনেভি ভে গ্রন্থাগারের ছাদটি দুই পাশ থেকে ঢালু এবং মাঝখানে উঁচু করা। নিচ থেকে লোহার খুঁটি দিয়ে ছাদের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে।

গ্রন্থাগারটির সৌন্দর্য দেখে ভিনসেন্ট ফান বলেছেন, ‘প্রতিবার এখানে এলে বিশাল গম্বুজগুলো আমাকে মুগ্ধ করে। মনে হয় যেন গম্বুজগুলো আকাশ স্পর্শ করছে।’