বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা
বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা

স্মরণ

ক্ষমতার প্রতি মোহমুক্ত একজন নেলসন ম্যান্ডেলা

বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার প্রয়াণদিবস আজ ৫ ডিসেম্বর। তাঁর স্মরণে আজ পাঠকদের জন্য এ আয়োজন।

বিশ্বের অন্যতম শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রনায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে সেখানে বহুজাতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ২৭ বছর কারাবন্দী ছিলেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ম্যান্ডেলা। অবশেষে ১৯৯০ সালে মুক্তি পান তিনি।

এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাঁর ভালো কাজ শুধু দেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না; বিশ্বের অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি, যার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, রসবোধ ও কঠোর নির্যাতনের পরও প্রতিশোধের কথা ভুলে সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবিরাম সংগ্রাম বিশ্বজুড়ে ম্যান্ডেলাকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিশ্বুজুড়ে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত।

১৯৯৯ সালে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী শুভেচ্ছাদূত হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি প্রাণঘাতী এইডসের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালান। ২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাগতিক দেশ হওয়ার পেছনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ম্যান্ডেলার বেড়ে ওঠা

নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার এম্ভেজে গ্রামে। নিজ গোত্রের কাছে তিনি ‘মাদিবা’ নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্কুলশিক্ষক তাঁর নাম দেন নেলসন।

ম্যান্ডেলার বাবা স্থানীয় রাজপরিবারের একজন কাউন্সিলর ছিলেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। এরপর গোত্রপ্রধানের কাছে বড় হন। ১৯৪১ সালে ২৩ বছর বয়সে স্থানীয় এক তরুণীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু তিনি বিয়ে না করে জোহানেসবার্গে পালিয়ে যান।

পড়াশোনা

এর দুই বছর পর শ্বেতাঙ্গদের জন্য পরিচিত উইটসওয়াটারস্রান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে বিভিন্ন বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি উদারপন্থী, চরমপন্থী ও আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন। পাশাপাশি বর্ণবাদ ও বৈষম্যের অভিজ্ঞতাও লাভ করেন।

রাজনীতি

এসব বিষয় রাজনীতির প্রতি ম্যান্ডেলার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে তোলে। ওই বছরই তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগ দেন। পরের বছর এভলিন এনটোকো মেইসের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তিনি। এরপর একে একে তাঁদের ঘরে চার সন্তান আসে। রাজনৈতিক জীবনে ম্যান্ডেলা সক্রিয় হয়ে উঠলে তাঁদের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৮ সালে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়।

ম্যান্ডেলা আইনজীবী হিসেবে যোগ্যতা অর্জন করেন। ১৯৫২ সালে অলিভার টাম্বোর সঙ্গে জোহানেসবার্গে একটি আইনি পরামর্শ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তাঁরা একসঙ্গে বর্ণবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। তাঁরা কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখতে শ্বেতাঙ্গদের দল ন্যাশনাল পার্টির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন।

বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন করায় ১৯৫৬ সালে ম্যান্ডেলাসহ আরও ১৫৫ জন আন্দোলনকর্মীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। তবে চার বছর ধরে চলা বিচার শেষে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়।

এ সময় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করে। বিশেষ করে নতুন পাস হওয়া একটি আইনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান কৃষ্ণাঙ্গরা। আইনে কৃষ্ণাঙ্গরা কোথায় বসবাস করবেন, কোথায় কাজ করবেন, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল।

রোবেন দ্বীপে এই কারাকক্ষেই দীর্ঘ সময় বন্দী ছিলেন ম্যান্ডেলা

যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

১৯৬০ সালের ২১ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিল এলাকায় বর্ণবাদী আইনের বিরুদ্ধে রাজপথে নামেন প্রায় সাত হাজার কৃষ্ণাঙ্গ। পুলিশ তাঁদের ওপর নির্বিচার গুলি চালায়। এতে ৬৯ জন নিহত হন, যা ‘শার্পভিল হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। আটক করা হয় ম্যান্ডেলাকে। নিষিদ্ধ করা হয় তাঁর দল এএনসিকে।

রিভোনিয়া আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সাম্য সম্পর্কে নিজের ধারণা তুলে ধরেন ম্যান্ডেলা। তিনি বলেন, ‘আমি এমন একটি গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের আদর্শকে লালন করেছি, যেখানে সব মানুষ সৌহার্দ্যের সঙ্গে এবং সমান অধিকার নিয়ে একসঙ্গে বসবাস করবে। এটি এমন এক আদর্শ, যার জন্য আমি বাঁচতে চাই এবং বাস্তবায়ন দেখতে চাই। এটি এমন এক আদর্শ, যে জন্য আমি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত।’

১৯৬৪ সালে ম্যান্ডেলাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯—এই এক বছরে তাঁর জীবনে দুটি বড় ট্র্যাজেডি ঘটে। তাঁর মা মারা যান। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন তাঁর বড় ছেলে। কিন্তু তাঁদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তাঁকে যোগ দিতে দেওয়া হয়নি।

ম্যান্ডেলাকে প্রায় ১৮ বছর রোবেন দ্বীপের কুখ্যাত বন্দিশালায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। ১৯৮২ সালে মূল ভূখণ্ডের পোলসমোর কারাগারে স্থানান্তর করা হয় তাঁকে।

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই

ম্যান্ডেলা ও তাঁর দলের নেতারা কারাগারে কষ্ট ভোগ করছিলেন। তবে কৃষ্ণাঙ্গ–অধ্যুষিত শহুরে এলাকার তরুণেরা শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল। স্কুলশিক্ষার্থীদের বিপ্লব দমনের সময় শত শত মানুষ নিহত হন। আহত হন হাজারো মানুষ।

১৯৮০ সালে নির্বাসিত অলিভার টাম্বোর নেতৃত্বে এএনসি বর্ণবাদবিরোধী একটি আন্তর্জাতিক প্রচার শুরু করে। এর মাধ্যমে কৌশলে ম্যান্ডেলাকে মুক্ত করার দাবি তোলা হয়।

এই প্রচারের অংশ হিসেবে ১৯৮৮ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়। ওই কনসার্টে প্রায় ৭২ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন। টেলিভিশনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ ‘ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা’ গানে কণ্ঠ মিলিয়েছেন।

অব্যাহত চাপের মুখে বিশ্বের নেতারা ১৯৬৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর ফলও পাওয়া যায়। ১৯৯০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক এএনসির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ম্যান্ডেলা কারাগার থেকে মুক্ত হন। দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য নতুন বহুজাতিক গণতন্ত্র গঠনের আলোচনা শুরু হয়।

১৯৯০ সালের ১১ এপ্রিল দক্ষিণ আফ্রিকার ভিক্টর ভার্সটার কারাগার থেকে মুক্তির পর নেলসন ম্যান্ডেলা

নির্বাচনে জয়

১৯৯৪ সালের ২৭ এপ্রিল দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। নির্বাচনে ম্যান্ডেলা ৬২ শতাংশের বেশি ভোট পান। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই দক্ষিণ আফ্রিকায় পুনর্গঠন ও উন্নয়ন প্রকল্প (আরডিপি) চালু করেন ম্যান্ডেলা। বর্ণবাদের কারণে দেশটিতে যে আর্থসামাজিক সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, তাঁর সমাধানই ছিল এ প্রকল্পের লক্ষ্য। আরডিপি প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকায় কর্মসংস্থান, আবাসন ও স্বাস্থ্য খাতে বিপুল অর্থ খরচ করে ম্যান্ডেলা সরকার।

তবে দ্বিতীয় মেয়াদে আর প্রার্থী হতে রাজি হননি ম্যান্ডেলা। ১৯৯৯ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। তখন ম্যান্ডেলার বয়স ৮২ বছর।

এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় সম–অধিকার ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৬ সালে ম্যান্ডেলা সরকারের উদ্যোগে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। ১৯৯৭ সালে কার্যকর হওয়া সংবিধানের মূলনীতি ছিল মানুষের মর্যাদা রক্ষা, মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও সাম্য অর্জন; বর্ণবৈষম্য না করা এবং সংবিধান ও আইনের শাসনের আধিপত্য।

অতীত থেকে শিক্ষা

ম্যান্ডেলা বুঝতে পেরেছিলেন, ক্ষমা করাটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে ইতিহাস কখনোই তাঁর অস্থির অতীত ভুলে যাবে না। নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদ শাসনের অধীন অন্যায়ের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিশোধের পরিবর্তে স্মরণ করে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, একটি জাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার মূল চাবিকাঠি হলো অস্থির অতীত থেকে বোঝা ও শিক্ষা নেওয়া।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ম্যান্ডেলার ভাষণ শুনতে মানুষের ভিড়

এসব বিষয় মাথায় রেখে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ম্যান্ডেলার প্রথম পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি ছিল ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ নামে একটি কমিটি গঠন। এটি ছিল সরকারি একটি সংস্থা, যার কাজ ছিল ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বর্ণবাদী সরকারের আমলের সংঘটিত অপরাধগুলোর তদন্ত করা।

ম্যান্ডেলার এ উদ্যোগকে মানবাধিকার তদন্তকারীদের জন্য একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখা হয়। অতীতের নৃশংসতা থেকে নিরাময় এবং বিভক্ত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ এটি।

জীবনাবসান

ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পর তাঁর ছবি হাতে বিদায় জানান ভক্তরা

অসমসাহস, দক্ষ নেতৃত্ব ও নিঃস্বার্থ নীতির জন্য সারা বিশ্বের মানুষ ম্যান্ডেলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। শান্তির পক্ষে কাজ করা এবং আফ্রিকার নবজাগরণে ভূমিকা রাখার জন্য তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, সিবিএস নিউজ, নেলসন ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশন