
কাবুলে বড় আকারের বোমা হামলার দায় স্বীকার করেছে তালেবান। বুধবার তারা এ দায় স্বীকার করে। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার তারা দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিসমিল্লাহ খান মোহাম্মদির বাড়ি লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এর মধ্য দিয়ে কাবুল শহর নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই শুরু করল তালেবান। মঙ্গলবারের ওই হামলা ছিল কাবুলে গত কয়েক মাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলা। দেশটির দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে তালেবান ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে। বোমা হামলার মধ্য দিয়ে এবার সে লড়াই দেশটির রাজধানীতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, আফগান ও মার্কিন সামরিক বাহিনী তালেবানকে পিছু হটাতে সম্প্রতি বিমান হামলা চালিয়েছে। তালেবান বলছে, কাবুলে হামলা ওই ঘটনার জন্য তাদের পাল্টা জবাব।
তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘কাবুল প্রশাসনের যাঁরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিমান হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁদের লক্ষ্য করে প্রতিশোধমূলক হামলা শুরু করা হয়েছে।’
মঙ্গলবার দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছাড়াও অন্য আইনপ্রণেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালান তালেবান সদস্যরা।
রয়টার্স জানায়, কাবুলে মঙ্গলবার রাতে শহরের কেন্দ্রে প্রথম বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ওই সময় একটি আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার দুই ঘণ্টা পর সুরক্ষিত গ্রিন জোন এলাকায় আরও বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়।
নিরাপত্তাকর্মীদের একটি সূত্র জানায়, কয়েকজন আইনপ্রণেতার বাড়ি লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়। এর মধ্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বাড়িও রয়েছে।
এএফপি জানায়, বর্তমান প্রশাসনের বেশ কয়েকজন আইনপ্রণেতা উত্তরাঞ্চলে তালেবান হামলা ঠেকাতে পরিকল্পনা করছিলেন।
ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে এ হামলার জন্য তালেবানের দিকে আঙুল তোলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছেন, ‘আমরা বোমা হামলার নিন্দা জানাচ্ছি। আমরা আফগানিস্তানের সরকারের পাশে আছি।’
বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তালেবানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছেন আশরাফ গনির প্রশাসন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আয়োজিত ওই আলোচনায় তালেবান এবং কাবুল সরকারের মধ্যে মতপার্থক্য দূর হচ্ছে না। তালেবানের পক্ষ থেকে যেকোনো নতুন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সিংহভাগ ক্ষমতা দাবি করা হচ্ছে। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত এ তথ্য জানান।
আফগান বংশোদ্ভূত মার্কিন কূটনীতিক জালমি খালিদজাদ অ্যাসপেন সিকিউরিটি ফোরামের এক অনলাইন সম্মেলনে বলেছেন, এ মুহূর্তে তালেবানের পক্ষ থেকে অনেক বেশি ক্ষমতার দাবি করা হচ্ছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি মঙ্গলবার টেলিফোনে কথা বলেন। তাঁদের আলোচনার বিষয় ছিল দোহায় তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে আলোচনায় গতি সঞ্চার করা।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, ব্লিঙ্কেন ও গনি বেসামরিক মানুষজনকে বাস্তুচ্যুত করে তালেবান হামলার নিন্দা জানান।
আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর লস্করগাহ থেকে তালেবানকে হটাতে বুধবার পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা করে সরকারি বাহিনী। আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় হেলমান্দ প্রদেশের রাজধানী লস্করগাহ ছাড়তে সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। মঙ্গলবার এ আহ্বান জানানো হয়।
হেলমান্দের রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী ও তালেবানের মধ্যে সম্প্রতি ব্যাপক লড়াই চলছে। এ লড়াই গত সোম ও মঙ্গলবার ব্যাপক আকার ধারণ করে। সেখানকার পরিস্থিতি তুলে ধরে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ৪০ জন বেসামরিক নাগরিক মারা গেছেন। আর আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের হামলায় তালেবানের ৭৭ জন নিহত হয়েছেন।
আফগানিস্তানের এ এলাকায় সরকারি বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জেনারেল সামি সাদাত। তিনি লস্করগাহের বাসিন্দাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘দয়া করে যত দ্রুত সম্ভব এ এলাকা ছেড়ে চলে যান, যাতে আমরা অভিযান শুরু করতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানি, এভাবে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া কঠিন। এটা আমাদের জন্যও কঠিন। আপনারা যদি অল্প কয়েক দিনের জন্য বাস্তুচ্যুত হন, তবে আমাদের ক্ষমা করবেন।’
সাদাত বলেন, ‘আমরা তালেবানের সঙ্গে লড়াই করছি। আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। তাদের একজনকেও আমরা জীবিত ছাড়ব না।’
মঙ্গলবার রাতে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বাড়ির কাছে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। একই সময় তাঁর বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালায় বন্দুকধারীরা। এ সময় আফগানিস্তানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে চার বন্দুকধারী নিহত হয়।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় সময় মঙ্গলবার মধ্যরাতে এ হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। তবে হামলার সময় বাড়িতে ছিলেন না প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিসমিল্লাহ খান মোহাম্মদি। হামলার পর বাড়িতে থাকা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আফগানিস্তানের বিভিন্ন শহরে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তালেবান যোদ্ধাদের চলমান তুমুল লড়াইয়ের মধ্যে এ হামলার ঘটনা ঘটল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে সহিংসতা বন্ধ করে দ্রুত এর কোনো সমাধানের আহ্বান করা হয়েছে।
এদিকে এ হামলার পর বিসমিল্লাহ খান এক টুইট বার্তায় বলেন, চিন্তার কিছু নেই। সব ঠিকঠাক আছে।
এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর কাবুলের বাসিন্দারা সড়কে নেমে আসেন। অনেকে বাড়ির ছাদে জড়ো হন। তাঁরা ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। গত সোমবার একই দৃশ্য দেখা যায় আফগানিস্তানের হেরাত শহরে। সেখানেও তালেবান ও আফগান বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে।
এএফপি বলছে, লস্করগাহ দখল করতে পারলে তা হবে তালেবানের জন্য বড় পুরস্কার। আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার শুরুর পর থেকেই দেশজুড়ে হামলা জোরদার করেছে তালেবান গোষ্ঠী। ইতিমধ্যে দেশটির সীমান্ত এলাকার বিশাল অংশ দখলে নিয়েছে তারা। এখন তালেবানের পক্ষ থেকে শহর এলাকা দখলের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। গত সপ্তাহ থেকে ইরান সীমান্তের কাছে হেরাতের বিভিন্ন শহর, দক্ষিণে কান্দাহার ও হেলমান্দের লস্করগাহসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালানো হচ্ছে।
বিপদে সাধারণ মানুষ
হেলমান্দের রাজধানীতে প্রায় দুই লাখ মানুষের বসবাস। তাঁরাও জীবন নিয়ে শঙ্কিত। এ নিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন বাসিন্দারা। লস্করগাহের এক বাসিন্দা সেখানকার পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, ‘এখানে তালেবান আমাদের প্রতি কোনো অনুকম্পা দেখাবে না। আর সরকারি বাহিনীও তাদের হামলা বন্ধ করবে না।’
নিরাপত্তার স্বার্থে বিবিসি ওই ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেনি। এমন নাম প্রকাশ না করা আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘রাস্তায় সেনারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা ঠিক জানি না, এরা সরকারি বাহিনী, নাকি তালেবান।’ দুই পক্ষের লড়াই থেকে বাঁচতে অনেকেই শহর ছেড়ে হেলমান্দ নদীতীরবর্তী এলাকায় অবস্থান নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।