জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরুর সঙ্গে বৈঠকের আগে করমর্দন করেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিউং। টোকিও, জাপান, আগস্ট ২৩
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরুর সঙ্গে বৈঠকের আগে করমর্দন করেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিউং। টোকিও, জাপান, আগস্ট ২৩

দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্টের প্রথমেই জাপান সফর কী ইঙ্গিত দিচ্ছে

দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট লি জে মিউং সম্প্রতি জাপানে ২৪ ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফর করেছেন। ১৯৬১ সালের পর এবারই প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ার কোনো প্রেসিডেন্ট বিদেশ সফরে ওয়াশিংটনের পরিবর্তে টোকিওকে বেছে নিলেন। তাঁর এ সফরকে এ কারণে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।

১৯৬১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পাক চুং হি ওয়াশিংটনের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পথে টোকিওতে যাত্রাবিরতি দিয়ে দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে জাপানের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়েছিলেন। এর পর থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় সব প্রেসিডেন্টই যুক্তরাষ্ট্রকে তাঁদের বিদেশ সফরের প্রথম গন্তব্য ধরে নিয়েছিলেন।

ফলে প্রেসিডেন্ট লির সদ্য জাপান সফরকে ভিন্ন আলোকে বিবেচনা করা যেতে পারে। তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় লাভ করে গত জুন মাসের শেষ দিকে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জাপানের সঙ্গে অতীতের সংকট নিষ্পত্তি না হওয়ায় কিছু সমস্যা নিয়ে কট্টর অবস্থান গ্রহণের জন্য দলটি সুপরিচিত।

দলের সেই অবস্থানের কারণে এর আগের ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট মুন জে ইনের দায়িত্ব পালনের পুরো সময় জাপান দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আয়োজিত নিয়মিত শীর্ষ বৈঠক স্থগিত রেখেছিল। কোরিয়া উপদ্বীপ জাপানের উপনিবেশ থাকা অবস্থায় কোরীয়দের জাপানের বিভিন্ন খনিজ প্রকল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক কাজ করার জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান, কোরীয় নারীদের জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের যৌনসেবা প্রদানে বাধ্য করার জন্য টোকিওর ক্ষমা প্রার্থনা এবং বেঁচে থাকা যৌনদাসীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া—দুই দেশের অমীমাংসিত সমস্যা।

জাপান বলে আসছে যে ১৯৬৫ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় এ ধরনের সব সমস্যার আনুষ্ঠানিক নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এসব বিষয় নতুন করে সামনে নিয়ে আসা অযৌক্তিক।

তবে দক্ষিণ কোরিয়া জাপানের সেই দাবি মেনে নিতে নারাজ। বিশেষ করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া এক রায়ে বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত কোরীয়দের ক্ষতিপূরণ দিতে জাপান ব্যর্থ হলে জাপানের যেসব কোম্পানি তাদের নিয়োগ দিয়েছিল, সেসব কোম্পানির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কথা বলা হয়। এ কারণে এক দশকের বেশি সময় ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাপানের কাছে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে আন্তরিকতা প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। আর সেই সব রাজনৈতিক দলের অগ্রভাগে রয়েছে ডেমোক্রেটিক পার্টি। ফলে সেদিক থেকেও লির জাপান সফর ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট গত শুক্রবার সকালে টোকিওতে পৌঁছান। এরপর তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরুর সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে দেশ দুটি ১৭ বছর পর প্রথমবারের মতো একটি যৌথ বিবৃতি দেয়। বিবৃতিতে বলা হয়, জনসংখ্যা সংকট ও মন্থর আঞ্চলিক প্রবৃদ্ধির মতো অভিন্ন সমস্যাগুলো সমাধান করে নেওয়ার লক্ষ্যে একটি পরামর্শ দল গঠন করে নিতে দুই নেতা সম্মত হয়েছেন।

এ ছাড়া সিউল ও টোকিও হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো অগ্রসর ক্ষেত্রগুলোয় সহযোগিতা এগিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে। একই সঙ্গে নাগরিকভিত্তিক আদান–প্রদান আরও এগিয়ে নিতে তরুণ সমাজের প্রতিনিধিদের ছুটির সময় একে অন্যের দেশের কাজে নিয়োজিত হওয়ার দ্বিপক্ষীয় ‘ওয়ার্কিং হলিডে’ কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে নিতেও দুই দেশের নেতারা সম্মত হয়েছেন।

পূর্বনির্ধারিত সময় অতিক্রম করে দুই ঘণ্টা ধরে চলা বৈঠক জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তোলার বাইরে আস্থার পরিবেশ তৈরি করে নিতে সাহায্য করেছে। বৈঠকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি ছিল অমীমাংসিত কিছু সমস্যার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করার মধ্য দিয়ে সময়ের অপচয় না করা। সেদিক থেকে বৈঠককে ইতিবাচক আখ্যায়িত করা যেতে পারে।

যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট বৈঠকের একপর্যায়ে উল্লেখ করেছেন, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক হচ্ছে এমন, যেখানে অপ্রয়োজনীয় সমস্যাগুলো সংশোধন করে নেওয়া হয় এবং সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক আস্থা অর্জন করে নিতে সহযোগিতা করা হয়।

অতীতের নেতারা যেসব সমস্যার ওপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট লি সেগুলোর ওপর অগ্রাধিকার না দেওয়ার দিকে আলোকপাত করা সত্ত্বেও সেসব সমস্যা সমাধানের গুরুত্ব এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। সেদিক থেকে বৈঠকে উভয় পক্ষের মনোভাব অতীতে দেখা দেওয়া সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার প্রচেষ্টার গুরুত্ব অনুধাবন করা নিয়ে উভয় পক্ষের মনোভাবে দেখা দেওয়া পরিবর্তন পরিষ্কার তুলে ধরেছে।

ফলে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ এই শীর্ষ বৈঠককে বরফ গলার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা যেতে পারে। দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত পারস্পরিক সফর বিনিময়ের শাটল ডিপ্লোমেসি আবারও শুরু করার মধ্য দিয়ে দুই দেশের নেতারা যেখানে সে ধরনের ধারণাকে কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে এর বাস্তব রূপ তুলে ধরতে অনেক বেশি চেষ্টা করে গেছেন।