টোকিওর একটি বিমানবন্দরের সামনে চীন ও জাপানের পতাক উড়ছে
টোকিওর একটি বিমানবন্দরের সামনে চীন ও জাপানের পতাক উড়ছে

জাপান-চীন সম্পর্কের আকাশে হঠাৎ দেখা দিয়েছে ‘কালো মেঘ’

আগামী মাসে চীনে আয়োজিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ৮০তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে জাপান সরকার। গতকাল সোমবার জাপানি বার্তা সংস্থা কিওদো নিউজ কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে এ সংবাদ প্রকাশ করেছে।

জাপান মনে করছে, সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখের সেই আয়োজনকে সামনে রেখে চীনা কর্তৃপক্ষ জাপানবিরোধী প্রচারণা জোরদার করবে। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে একটি সামরিক কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে চীন সরকার ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা যুদ্ধে দেশের বিজয়ের ৮০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন করবে। চীন সেই যুদ্ধকে ‘জাপানি আগ্রাসন প্রতিরোধ করা যুদ্ধ’ ছাড়াও ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী বৈশ্বিক যুদ্ধ’ আখ্যায়িত করে থাকে। স্মারক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে দেশটি।

কিওদো নিউজের খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে বিদেশে নিজেদের দূতাবাসের মাধ্যমে জাপান বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে এ ধরনের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে যে চীনের স্মারক অনুষ্ঠানের সুস্পষ্ট জাপানবিরোধী অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় সেখানে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সেসব দেশের নেতাদের যত্নের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা উচিত।

৩ সেপ্টেম্বরের স্মারক অনুষ্ঠানের আগে ১ সেপ্টেম্বর থেকে চীন সাংহাই সহযোগিতা সংগঠনের দুই দিনব্যাপী শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা করছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনসহ এশিয়া ও ইউরোপের বেশ কিছু দেশের নেতারা সেখানে উপস্থিত থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত এ দুই আয়োজনের এক সপ্তাহ আগে জাপানের সংবাদমাধ্যমে সরকারের পরোক্ষ উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত এই খবর নিয়ে চীনে ইতিমধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। চীন সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দেশটির বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম গুরুত্বের সঙ্গে এটা প্রচার করায় জাপানবিরোধী মনোভাব দেশজুড়ে তীব্র আকার নেওয়ার আভাস ইতিমধ্যে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠতে দেখা যাচ্ছে।

চীনের ইংরেজি ভাষার অনলাইন দৈনিক গ্লোবাল টাইমসে ২৬ আগস্ট প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, প্রকাশিত সংবাদ সত্য প্রমাণিত হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং চীনসংক্রান্ত জাপানের ভ্রান্ত ধারণাই কেবল তা তুলে ধরবে না, একই সঙ্গে এশিয়া মহাদেশ এবং বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তিকে নস্যাৎ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যমূলক অপচেষ্টা হিসেবেও সেটাকে দেখা হবে।

সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়েছে, জাপান সরকারের উচিত হবে সেই সংবাদ নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা। সরকার তা করতে ব্যর্থ হলে এটা কেবল জাপান-চীন সম্পর্কের ক্ষতিই করবে না, একই সঙ্গে জাপানের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করবে।

গ্লোবাল টাইমসে এক দিন আগে প্রকাশিত এ–সংক্রান্ত সংবাদে জাপানবিষয়ক চীনের একাধিক বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, জাপান সরকার সংশ্লিষ্ট সেই সংবাদ নিয়ে কোনো ধরনের মন্তব্য না করায় তারা মনে করছে দেশের একটি নেতৃস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সরকারের চলমান ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে জাপান সরকার হয়তো পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়, তার ইঙ্গিত পাওয়ার উদ্দেশ্যে এ ধরনের একটি ‘পরীক্ষামূলক বেলুন’ ছুড়ে থাকবে।

চীনের বিশেষজ্ঞরা আরও বলেছেন, দেশের নেতৃস্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা জাপান সরকার অনুরূপ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশের সঙ্গে কতিপয় বিষয় নিয়ে টানাপোড়েন চলতে থাকা অন্যান্য দেশের চিন্তাভাবনা নিয়ে ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করে থাকে।

জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত সেই সংবাদ নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও এর কোনো উল্লেখ নেই। তবে চীনজুড়ে চীনা ভাষায় প্রকাশিত সংবাদমাধ্যম কিওদো নিউজের সেই সংবাদ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করায় দেশটির নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে এটা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই জাপানের তীব্র সমালোচনা করে যাচ্ছেন। সে রকম সমালোচনা ধারালো হয়ে উঠতে থাকায় জাপান সরকার এটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চীনের প্রতি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অনুরোধ করেছে।

জাপানের চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ইয়োশিমাসা হায়াশি আজ মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংযুক্ত কিছু ভিডিও একেবারেই ‘মানানসই’ নয়। জাপান সরকার কূটনৈতিক যোগসূত্রের মাধ্যমে চীনের প্রতি এর বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত একটি ভিডিওতে জাপানের প্রয়াত সম্রাট হিরোহিতোকে জেনারেল ম্যাকআর্থারের মূল্যবান পোষা কুকুর হিসেবে দেখিয়ে নিচে এ রকম একটি বাক্য যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, ‘আমি হচ্ছি বিরাট বড় এক জাপানি কুকুর।’

ধারণা করা হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের বার্ষিকী এগিয়ে আসা অবস্থায় চীনের লোকজনের মধ্যে জাপানবিরোধী সে রকম মনোভাব হয়তো আরও তীব্র হয়ে উঠতে পারে। ফলে জাপান এবং চীন উভয় দেশের সরকারের উচিত হবে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়া বন্ধ করতে এখনই শক্ত হাতে লাগাম চেপে ধরা।