
নেপাল গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক অস্থির সময় পার করছে। তরুণদের দুই দিনের বিক্ষোভের পর এখন দেশটির রাজধানী কাঠমান্ডুর রাস্তায় টহল দিচ্ছেন সেনাসদস্যরা।
গত মঙ্গলবার নেপালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ধীরে ধীরে অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতায় রূপ নেয়। বিক্ষোভের মুখে ওই দিন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করেন। বিক্ষোভকারীরা রাজনীতিবিদদের বাড়িঘরে ভাঙচুর চালান। সরকারি ভবন ও পার্লামেন্টে আগুন ধরিয়ে দেন। দুই দিনের সহিংসতায় ৩০ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন ১ হাজারেরও বেশি মানুষ।
এই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া ‘জেন-জি’র তরুণেরা বলেছেন, তাঁরা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে ছিলেন। সুযোগসন্ধানীদের হাতে তাঁদের বিক্ষোভ ছিনতাই হয়ে গেছে।
গতকাল বুধবার কাঠমান্ডু বিমানবন্দর আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। এদিন রাজধানীতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছিল। কারণ, কারফিউর কারণে শহরের বেশির ভাগ বাসিন্দা বাড়িঘর থেকে বের হননি। আর পুড়ে যাওয়া ভবনগুলো থেকে তখনো ধোঁয়া বের হচ্ছিল।
সেনাবাহিনী বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তারা ‘জেন-জি’র তরুণদের শান্তিপূর্ণ আলোচনায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ছাত্রনেতারা নতুন দাবিদাওয়ার একটি তালিকা প্রস্তুত করছেন বলে তাঁদের এক প্রতিনিধি বিবিসিকে জানিয়েছেন।
দেশজুড়ে আজ বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত কারফিউ থাকবে। সেনাবাহিনী সতর্ক করে বলেছে, নতুন করে কেউ সহিংসতা বা ভাঙচুর করলে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সহিংসতা ও লুটপাটের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ও ৩১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনী তল্লাশিচৌকি বসিয়েছে। চালানো হচ্ছে যানবাহনে তল্লাশি। মানুষদের ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন সেনাসদস্যরা। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোথাও যেতে নিষেধ করা হচ্ছে।
এরপরও গতকাল কিছু তরুণ বাইরে বেরিয়েছিলেন। মুখে মাস্ক পরে ও হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে বিক্ষোভে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিষ্কার করতে দেখা গেছে তাঁদের।
১৪ বছর বয়সী কসাং লামা বিক্ষোভে অংশ নেয়নি। সে বলেছে, ‘নেপাল দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতিতে জর্জরিত। আমি মনে করি, দেশকে পরিবর্তনের এখনই উপযুক্ত সময়। আশা করি, এ আন্দোলন কিছুটা ইতিবাচক ফল আনবে।’
২৪ বছর বয়সী পরশ প্রতাপ হামাল বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। তিনি মনে করেন, নেপালে স্বাধীন রাজনৈতিক নেতার প্রয়োজন। কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহকে (বালেন শাহ নামে বেশি পরিচিত) একজন ভালো নেতা হিসেবে দেখছেন এই তরুণ।
পূর্ব নেপালের ৩৬ বছর বয়সী রাকেশ নিরুলা বলেন, ‘এই বিপ্লবের পর মানুষ এখন আশাবাদী। অপেক্ষাকৃত ভালো শাসনব্যবস্থার আশা তৈরি হয়েছে। আমরা মনে করি, এটি নেতাদের জন্য একটি শিক্ষা, তাঁরা নিজেদের যোগ্যতা বাড়াতে এ বিক্ষোভ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। আর এতে করে দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।’
পরিবর্তনের এ সম্ভাবনাকে স্বাগত জানালেও নেপালের অনেক মানুষ বিবিসিকে বলেছেন, বিক্ষোভে সহিংসতা ও ভাঙচুরের ঘটনা তাঁদের অবাক করেছে। এ বিষয়ে রাকেশ নিরুলা বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এটি হওয়া উচিত ছিল না।’
ললিতপুরের বাসিন্দা উদ্যোক্তা প্রভাত পাওডেল বলেন, সুপ্রিম কোর্টের মতো সরকারি ভবন পুড়িয়ে দেওয়ায় তিনি অবাক হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ।’
তবে অনেক বিক্ষোভকারী আশঙ্কা করছেন, অনুপ্রবেশকারীরা এই আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেনাবাহিনীও একই দাবি করেছে।
সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রাজারাম বাসনেত বিবিসিকে বলেন, ‘পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে যাঁরা লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নানা ঘটনা ঘটিয়েছেন, আমরা মূলত তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি।’
বিক্ষোভকারীরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এই আন্দোলন অহিংস ছিল ও থাকবে। শান্তিপূর্ণ নাগরিক অংশগ্রহণের নীতির ওপর ভিত্তি করে এটি পরিচালিত হয়েছে।’ তাঁরা আরও বলেছেন, দায়িত্বশীলভাবে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও সরকারি সম্পদ রক্ষায় তাঁরা কাজ করছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, বুধবারের (গতকাল) পর থেকে তাঁদের আর কোনো বিক্ষোভের পরিকল্পনা নেই। তাঁরা সেনাবাহিনী ও পুলিশকে প্রয়োজনমতো কারফিউ কার্যকর করার আহ্বান জানান।
আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেপালে দুর্নীতি, বেকারত্ব, বৈষম্য ও রাজনীতিবিদদের স্বজনপ্রীতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। এরই মধ্যে সম্প্রতি ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এতে ক্ষোভ চরমে পৌঁছায়। পরে গত সোমবার থেকে বিক্ষোভে নামে তরুণদের একাংশ।