কাঠমান্ডুর রাস্তায় বুধবার সেনাসদস্যদের টহল
কাঠমান্ডুর রাস্তায় বুধবার সেনাসদস্যদের টহল

নেপালে কি এখন ক্ষমতায় সেনাবাহিনী

নেপালে তরুণদের দুই দিনের বিক্ষোভের পর ‘পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ’ নিয়েছে সেনাবাহিনী। বুধবার রাজধানী কাঠমান্ডুর সড়কে দেখা যায় সেনাসদস্যদের উপস্থিতি। এদিনও দেশটিতে কারফিউ জারি ছিল। বিক্ষোভের জেরে দুই দিন ধরে সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর মানুষকে ঘরে থাকতে বলেছে সেনাবাহিনী।

নেপালে দুর্নীতি, বেকারত্ব, বৈষম্য ও রাজনীতিবিদদের স্বজনপ্রীতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। এরই মধ্যে সম্প্রতি ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এতে ক্ষোভ চরমে পৌঁছায়। সোমবার থেকে বিক্ষোভে নামেন তরুণদের একাংশ। এর জেরে মঙ্গলবার পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি।

নেপালের সিংহ দরবার এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল। গতকাল রাজধানী কাঠমান্ডুতে

নেপালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয় মঙ্গলবার রাত ১০টার পরে। নেপালের গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেপাল সেন্টার ফর কনটেমপোরারি রিসার্চের (এনসিসিআর) পরিচালক বিষ্ণু রাজ উপরেতি বলেন, নেপালে সেনা সমাবেশের ঘটনা আগে সচরাচর দেখা যায় না। তবে এর আগেও দেশটির রাস্তায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল।

বিষ্ণু রাজ বলেন, সেনা মোতায়েনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ দেখা যায় ‘মাওবাদী বিদ্রোহের শেষের অর্ধেক’ সময়ে। নেপালে ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ চলেছিল। এই গৃহযুদ্ধের শুরু হয়েছিল রাজতন্ত্র ও সরকারের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী) সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করলে। ওই বিদ্রোহ শেষে ২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্রের পতন নয়। যাত্রা শুরু করে প্রজাতন্ত্র।  

নেপালের সিংহদরবার প্রাঙ্গণে আগুন জ্বলছে। এখানেই দেশটির প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ও অন্যান্য মন্ত্রণালয় অবস্থিত। ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সোমবার বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর সেনাবাহিনী প্রথম দিকে ব্যারাকেই ছিল। পরে বিক্ষোভ থামাতে পুলিশ ব্যর্থ হলে সেনাসদস্যদের সড়কে নামান প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেল। বিষ্ণু রাজ বলেন, ‘পরিস্থিতি বেসামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। তাই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সমন্বয় করে এগিয়ে আসে সেনাবাহিনী। এটি সংকট থেকে পরিত্রাণের একটি উপায়।’

সেনা মোতায়েনের আগে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নেপালের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর প্রধানেরা বিবৃতি দেন। তাতে সবাইকে সংযত থাকার এবং শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে সেনাবাহিনী বলে, ‘জাতীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি রক্ষা করতে এবং জনজীবন স্বাভাবিক করতে নিজ দায়িত্ব পালনের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী নেপালের সেনাবাহিনী।’

সেনাবাহিনীই কি এখন ক্ষমতায়

কে পি শর্মা অলির পদত্যাগের পর নেপালের সংবিধান অনুযায়ী এখন নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নিতে হবে। মাঝের এই সময়টাতে নেপালে একটি প্রশাসনিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। নেপালের পোখরা ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক যোগরাজ লামিচানে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী শুধু শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজ করবে। প্রশাসনিক শূন্যতা পূরণের ভূমিকা পালন করবে না।

গবেষক বিষ্ণু রাজ বলেন, তবে বাস্তবতা হলো বর্তমানে কার্যত সেনাবাহিনীই দেশের দায়িত্বে রয়েছে। কারণ, আন্দোলকারীরা যাদের ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য রাস্তায় নেমেছিলেন, সেই শাসকগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেলকে। নেপালে পরিবর্তন আনার জন্য তাঁর ওপর আস্থার ঘাটতি রয়েছে আন্দোলনকারীদের।

বিষ্ণু রাজ বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাবাহিনীর ওপর প্রেসিডেন্টের অবস্থান। তবে তরুণ আন্দোলনকারীরা তাঁকে মেনে নিচ্ছেন না। ফলে তাঁকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তাই সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নেপালের দায়িত্বে থাকলেও কার্যত দায়িত্ব পালন করছে সেনাবাহিনী।

পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া টুপি পরছেন এক বিক্ষোভকারী। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কীভাবে সরকার গঠন হতে পারে

নেপালের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য বিক্ষোভকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনী। নেপালের ইংরেজি সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্টের সাংবাদিক অনীশ ঘিমরে বলেন, এ আলোচনায় কারা অংশ নেবে এবং কী নিয়ে আলোচনা হবে, সে বিষয়ে বর্তমানে ৩ হাজার ২০০ জনের বেশি তরুণ বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ ডিসকর্ডে কথা বলছেন।

অনীশ ঘিমরে বলেন, তরুণদের সম্ভাব্য দাবিগুলোর মধ্যে থাকতে পারে—পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া, ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করা এবং সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের একটি পদ্ধতি বের করা। এ ছাড়া তরুণেরা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ কমানো এবং পার্লামেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করার দাবিও করতে পারেন।

তবে যদি সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করতে হয়, তাঁকে বর্তমান পার্লামেন্টের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করতে হবে বলে জানান সহকারী অধ্যাপক যোগরাজ লামিচানে। তিনি বলেন, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে যদি সংবিধানের বিধির বাইরে যাওয়া হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী পদে সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন সাবেক প্রধান বিচারপতিরা।

কাঠমান্ডুর মেয়র ও সাবেক র‍্যাপার বালেন্দ্র শাহ কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ারে ইন্দ্রযাত্রা উৎসবে যোগ দেন (মাঝখানে কালো ব্লেজার ও কালো চশমা পরিহিত)। ৬ সেপ্টেম্বর, কাঠমান্ডু

নেপালের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তরুণদেরও পছন্দ রয়েছে। তাঁদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছেন ৩৫ বছর বছর বয়সী র‌্যাপার বলেন্দ্র শাহ। তিনি ২০২২ সালে কাঠমান্ডুর মেয়র নির্বাচিত হন। এ ছাড়া গত কয়েক মাসে নেপালে রাজতন্ত্রপন্থী আন্দোলনেরও পুনর্জাগরণ হতে দেখা গেছে। গত মার্চে কাঠমান্ডুর রাস্তায় অনেককে ৭৭ বছর বয়সী সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহকে স্বাগত জানাতে দেখা যায়।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চান না বিক্ষোভকারীরা। যোগরাজ লামিচানে বলেন, ‘এটি আন্দোলনের দাবি নয়। আলোচনার কাঠামোর ভেতরে এখনো প্রজাতন্ত্রই রয়েছে।’