Thank you for trying Sticky AMP!!

বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার মুখে চাপে আছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা

রোহিঙ্গাদের যেভাবে মানববর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে মিয়ানমারের জান্তা

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই সপ্তাহেই সতর্ক করে বলেছেন, মিয়ানমারে নতুন করে যুদ্ধ ও সেনাবাহিনীর বিমান হামলায় রোহিঙ্গারা আবার জানমালের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।

২০২১ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সামরিক জান্তা। পরে এই জান্তা সরকারকে হটাতে লড়াই শুরু করে দেশটির বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী। গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে এই লড়াই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রচণ্ড লড়াইয়ের মুখে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গত জানুয়ারিতে দেশটিতে জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ায়। পরের মাসে (ফেব্রুয়ারি) তারা আইন করে নতুন একটি কর্মসূচি ঘোষণা করে।

এই আইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে তরুণ-তরুণীদের যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। এই পদক্ষেপ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অসামঞ্জস্যভাবে প্রভাব ফেলতে পারে বলে তখনই অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর শুধু নির্বিচারে বোমা হামলাই করা হচ্ছে না, তাঁদের জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হচ্ছে। যদিও তাঁরা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃত নন এবং দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছেন।

কী ঘটছে মিয়ানমারে

আজকের মিয়ানমার আগে বার্মা নামে পরিচিত ছিল। ২০১৫ সালের নির্বাচনের আগে প্রায় পাঁচ দশক ধরে সামরিক শাসনের অধীনে ছিল মিয়ানমার। সেই নির্বাচনে দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ভূমিধস বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় এসেছিল। ২০২০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও সু চির দল বিপুল ব্যবধানে জয় পেয়েছিল। তবে নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ তোলে দেশটির সেনাবাহিনী। তারা নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে।

এই পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সু চির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ক্ষমতা দখলের পরপরই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। গণবিক্ষোভ দমনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে জান্তা সরকার। এর জেরে মিয়ানমারে জান্তা সরকারবিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়।

মিয়ানমারে জান্তা সরকারবিরোধী দমন-পীড়নের তথ্য নথিভুক্ত করছে দ্য অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারস (এএপিপি) নামের একটি সংগঠন। এএপিপির তথ্যমতে, অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ৪ হাজার ৬৮০ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে দেশটির জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো একটি জোট গঠন করেছে। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামের এই জোটে আছে আরাকান আর্মি (এএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও তাঙ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)। ২০২৩ সালে অক্টোবরে এই জোট সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান শুরু করে।

থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন ১০২৭ ’। গত বছরের ২৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই অভিযানে জান্তা বাহিনীর ১০০ টির বেশি সেনাচৌকি ও ঘাঁটির পতন ঘটেছে। তীব্র হামলার মুখে জান্তার সেনারা পিছু হটেছেন। তাঁরা ভারী অস্ত্র ও উল্লেখযোগ্য গোলাবারুদ ফেলে যেতে বাধ্য হন।

এনএলডি ও দেশটির নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত প্রবাসী জাতীয় ঐক্যের সরকারের (এনইউজি) সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্সসহ (পিডিএফ) অভ্যুত্থানবিরোধী প্রতিরোধ বাহিনীগুলোও এই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে, যা জেনারেলদের চাপে ফেলে দিয়েছে।

২০২৩ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী স্বীকার করে, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে কয়েক দিনের লড়াইয়ের পর তারা চিনশওয়েহাওর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এই এলাকাটি চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তবর্তী শহর। মিয়ানমার থেকে চীনে বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু এই শহর।

আরাকান আর্মি মিয়ানমারের পশ্চিম রাখাইন রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছে। গত জানুয়ারিতে আরাকান আর্মি বলেছে, তারা চীন প্রদেশের পাশে গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর পালেতোয়ার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীও পাল্টা জবাব দিচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাকি রোহিঙ্গাদের অনেকেই রাখাইন রাজ্যের আশ্রয়শিবিরে বসবাস করছেন। সেখানে তাঁদের চলাফেরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।

রোহিঙ্গা অধিকারকর্মীদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা নে সান লুইন বলেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকার রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন জনপদে রোহিঙ্গা এলাকায় নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করছে।

স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে নে সান লুইন বলেন, গত সোমবার রাখাইন রাজ্যের মিনবিয়া শহরে বোমা হামলা চালায় সামরিক জান্তা বাহিনী। এতে শিশুসহ অন্তত ২৩ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩০ রোহিঙ্গা। সর্বত্রই রোহিঙ্গাদের ওপর এমন হামলার ঘটনা ঘটছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে তরুণ-তরুণীদের যোগদান বাধ্যতামূলক করার সাম্প্রতিক আদেশ দেশজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান এড়াতে দেশটির অনেক বাসিন্দা পালানোর উপায় খুঁজছেন। রোহিঙ্গাদের চলাফেরা যেহেতু সীমিত, তাই তাঁদের পক্ষে এই আদেশ এড়ানো বিশেষভাবে কঠিন।

নে সান লুইন আল-জাজিরাকে বলেন, স্থানীয় সূত্রের মাধ্যমে তিনি জানতে পেরেছেন, রোহিঙ্গা সম্প্রদায় থেকে অন্তত এক হাজার ব্যক্তিকে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়েছে। বুথিডং, সিতওয়ে ও কিয়াউকফিউ শহর থেকে তাঁদের নেওয়া হয়েছে।

নে সান আরও বলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের দুই সপ্তাহের সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্রে নামানো হয়েছে। তাঁদের অনেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াইয়ে নিহত হয়েছেন। রাথেডংয়ে তাঁদের মানববর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে সামরিক জান্তা। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এর আগে কুলি-মজুরদের মানববর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

রোহিঙ্গা কারা

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের একটি মুসলিম জাতিগোষ্ঠী। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা মাইনরিটি রাইটস গ্রুপের তথ্যমতে, মিয়ানমারে ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠী আছে। দেশটিতে সাতটি জাতিগত সংখ্যালঘু রাজ্য আছে। এর মধ্যে বর্মিরা সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী জাতিগোষ্ঠী।

১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর এই তালিকায় রোহিঙ্গাদের নাম নেই। ১৯৮২ সাল থেকে মিয়ানমারে তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত। প্রায় সব রোহিঙ্গাই মিয়ানমারের উপকূলীয় রাজ্য রাখাইনে বসবাস করে। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই এলাকা আরাকান নামে পরিচিত ছিল।

গত শতকের সত্তরের দশক থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে আসছে। আশা করা হচ্ছিল, গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি নির্বাচনে জয়লাভের ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর জান্তা সরকারের বৈষম্য ও অন্যায্য আচরণের অবসান হবে। কিন্তু সু চি ক্ষমতায় এসে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে নীরব থাকেন।

২০১৭ সালে রাখাইনে সহিংস-রক্তক্ষয়ী সামরিক অভিযান চালায় সেনাবাহিনী। এই অভিযানের মুখে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দমন-পীড়নকালে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, হত্যাকাণ্ড চালায় বলে অভিযোগ করেছে রোহিঙ্গারা।

এই ঘটনার জেরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে নেদারল্যান্ডসের হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা করে গাম্বিয়া। এই মামলার বিচারকাজ চলছে।