মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে একটি স্কুল ভবনে বোমা হামলার পর শিক্ষার্থীদের ব্যাগ পড়ে আছে। মে মাস
মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে একটি স্কুল ভবনে বোমা হামলার পর শিক্ষার্থীদের ব্যাগ পড়ে আছে। মে মাস

মিয়ানমারের একের পর এক অঞ্চল দখল করছে জান্তা সরকার, কেন পিছু হটছে বিদ্রোহীরা

মিয়ানমারের চীন সীমান্তে বছর কয়েক মাস ধরে কঠিন লড়াইয়ের পর বিদ্রোহীরা জান্তা বাহিনীকে হটিয়ে কিয়াউকম শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। চীন সীমান্ত থেকে মিয়ানমারের বাকি অংশে যাওয়ার প্রধান বাণিজ্য রুট এ অঞ্চলে অবস্থিত। তখন এটি ছিল বিদ্রোহীদের জন্য এক বড় জয়।

কিয়াউকম এশিয়ান হাইওয়ে ১৪-এর ওপর অবস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি ‘বার্মা রোড’ নামে বেশি বিখ্যাত ছিল। তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এ শহর দখল করার পর অনেকে বিরোধীদের জন্য এটিকে গুরুত্বপূর্ণ বিজয় হিসেবে দেখেছিলেন। মনে করা হয়েছিল, এর ফলে ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তার মনোবল ভেঙে পড়ছে।

তবে এ মাসেই মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে সেনাবাহিনী কিয়াউকম বিদ্রোহীদের কাছ থেকে পুনর্দখল করেছে।

এই ছোট পাহাড়ি শহরের দখল-পুনর্দখল স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক ভারসাম্য এখন জান্তার অনুকূলে কতটা সরে গেছে।

কিয়াউকম অঞ্চলকে এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। টিএনএলএর নিয়ন্ত্রণে থাকাকালে সামরিক বাহিনী প্রায় দিনই সেখানে বিমান হামলায় চালিয়েছে। এতে শহরের বিশাল অংশ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। যুদ্ধবিমান থেকে ৫০০ পাউন্ড ওজনের বোমা ফেলা হয়েছিল। অন্যদিকে কামান ও ড্রোন দিয়ে শহরের বাইরে বিদ্রোহীদের অবস্থানে হামলা চালানো হয়েছিল।

জান্তা বাহিনীর হামলার তীব্রতায় শহরের বাসিন্দাদের বেশির ভাগই পালিয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য সামরিক বাহিনী শহরটি বিদ্রোহীদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করার পর এখন তাঁরা ফিরতে শুরু করেছেন।

টিএনএলএর এক মুখপাত্র টার পার্ন লা চলতি মাসের শুরুতে বিবিসিকে বলেন, ‘কিয়াউকম এবং হিসিপাওতে প্রতিদিন তীব্র লড়াই চলছে। বিদ্রোহীদের তুলনায় সেনাবাহিনীর বেশি সেনা, ভারী অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান রয়েছে। আমরা হিসিপাওকে রক্ষা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’

বিবিসি যখন পার্ন লার সঙ্গে কথা বলেছিল, তখন জান্তা বাহিনী হিসিপাও এলাকাও পুনর্দখল করেছে। গত বছর টিএনএলএর দখলে থাকা শেষ শহর ছিল হিসিপাও। এভাবে চীন সীমান্তের রাস্তায় জান্তা বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে।

চীনের সমর্থন থাকার কারণেই জান্তা বাহিনী এসব শহর পুনর্দখল করতে পেরেছে। চীন আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে জান্তার পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। তবে দেশে-বিদেশে এই পরিকল্পনার ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। কারণ, এই নির্বাচনে অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসিকে (এনএলডি) বাদ দেওয়া হয়েছে।

এনএলডি মিয়ানমারে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল। জান্তা বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সরকারকে উৎখাত করেছিল। তখন থেকে মিয়ানমারের বেশির ভাগ অংশেই গৃহযুদ্ধ চলছে।

সামরিক বাহিনী যতটা সম্ভব হারানো এলাকা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে, যাতে এসব অঞ্চলে নির্বাচন আয়োজন করা যায়। এই বছর তারা লড়াইয়ে আরও বেশি সাফল্য পাচ্ছে। কারণ, তারা অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে। এ ছাড়া নতুন ও মারাত্মক প্রযুক্তি হাতে পেয়েছে।

কিয়াউকম শহরের দখল-পুনর্দখল স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে, মিয়ানমারের সামরিক ভারসাম্য এখন জান্তার অনুকূলে কতটা সরে গেছে।

বিশেষ করে জান্তা সরকার বিরোধীদের সস্তা ড্রোন ব্যবহারের প্রাথমিক সুবিধার জবাবে চীন থেকে হাজার হাজার আধুনিক ড্রোন কিনেছে। তাদের অগ্রবর্তী ইউনিটগুলোকে এসব অস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

জান্তা বাহিনী ধীর ও সহজে উড়তে পারা মোটরচালিত প্যার‍্যাগ্লাইডারও ব্যবহার করছে, যা হালকাভাবে সুরক্ষিত এলাকার ওপরে চক্কর দিতে পারে এবং অত্যন্ত নির্ভুলভাবে বোমা ফেলতে পারে। তারা চীনা ও রাশিয়া থেকে পাওয়া বিমান দিয়ে অবিরাম বোমা ফেলছে।

জান্তা বাহিনীর বিমান হামলায় চলতি বছর বেসামরিক মানুষের হতাহতের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই বছর কমপক্ষে এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। তবে মোট সংখ্যা সম্ভবত আরও বেশি।

সাগাইং অঞ্চলে বিমান হামলার আশঙ্কায় বাংকারে আশ্রয় নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এ অঞ্চলে বিদ্রোহীদের শক্ত অবস্থান রয়েছে

অন্যদিকে অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে খণ্ডিত বিরোধী আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

স্থানীয় গ্রামবাসী বা শহর থেকে পালিয়ে আসা তরুণ কর্মীরা ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস’ বা পিডিএফ গঠন করেছিল। এতে বহু দশক ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে আসা জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অভিজ্ঞ যোদ্ধারাও রয়েছেন। তবে এই গোষ্ঠী দুর্বলভাবে সংগঠিত বলে মনে হচ্ছে।

পিডিএফের নিজস্ব লক্ষ্য রয়েছে। তারা জাতিগত বার্মিজ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতি গভীর অবিশ্বাস পোষণ করে থাকে। তারা ২০২১ সালের অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকার থেকে গঠিত জাতীয় ঐক্য সরকারের কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি দেয় না। তাই তাদের আন্দোলনের কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই।

চার বছর ধরে চলা এই গৃহযুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু এবং লাখ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুতির পর পরিস্থিতি আবার নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে।

চীনের সমর্থন থাকার কারণেই জান্তা বাহিনী এসব শহর পুনর্দখল করতে পেরেছে।

কীভাবে জান্তা ক্ষতি পুষিয়ে নিল

২০২৩ সালের অক্টোবরে শান রাজ্যের তিনটি জাতিগত গোষ্ঠী ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ নামে জোট গঠন করে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ১০২৭’ অভিযান শুরু করেছিল। ওই সময় জান্তার বিরুদ্ধে দেশের বেশির ভাগ অংশে সশস্ত্র প্রতিরোধ চলছিল। এর আগে দুই বছর নানাভাবে চেষ্টা করলেও খুব কম অগ্রগতি হয়েছিল।

অপারেশন ১০২৭ শুরুর পরপরই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত এই তিনটি গোষ্ঠী তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) জান্তার বিরুদ্ধে প্রচুর ড্রোন ও ভারী কামান মোতায়েন করে।

এই জোট সামরিক জান্তাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেয় এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ১৮০টি ঘাঁটি দখল করে নেয়। উত্তর শান রাজ্যের বিশাল অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় ব্রাদারহুড। এ সময় তারা হাজার হাজার সৈন্যকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে।

এসব চমকপ্রদ বিজয় বৃহত্তর বিরোধী আন্দোলনে অস্ত্র হাতে নামতে অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে। পিডিএফ তাদের নিজস্ব এলাকায় জান্তার ওপর আক্রমণ শুরু করে। তারা সামরিক বাহিনীর ভেঙে পড়া মনোবলের সুবিধা নেয়।

মিয়ানমারের কারেন রাজ্যে একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে জান্তাবিরোধী বামার পিপলস লিবারেশন আর্মির (বিপিএলএ) নতুন সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৬ মার্চ ২০২৪, কারেন

যখন ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এশিয়ান হাইওয়ে ১৪ ধরে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন সামরিক শাসনের পতন হতে পারে বলে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে তা হয়নি।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা ফেলো মরগান মাইকেলস বলেন, এই সংঘাতের শুরুতে দুটি বিষয়কে বাড়িয়ে বলা হয়েছিল।

প্রথমটি হচ্ছে ‘শান’-এর তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর একসঙ্গে কাজ করার দীর্ঘ ইতিহাস ছিল। ২০২৩ সালে অন্যান্য গোষ্ঠী যখন তাদের সাফল্য দেখল, তখন তারাও সমন্বিতভাবে জান্তাবিরোধী আক্রমণ শুরু করল। তবে এটিকে ঐক্যবদ্ধ, দেশব্যাপী বিরোধীদের বিজয় হিসেবে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে সামরিক মনোবল ভেঙে পড়েছিল বলে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। তাদের মনোবল ভেঙে পড়েছিল ঠিক। তবে এমন পর্যায়ে নয় যে কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল।

জান্তা সরকার ২০২৩ সালের শেষের দিকে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাহিনীতে জোরপূর্বক নিয়োগ শুরু করে। হাজার হাজার তরুণ বার্মিজ পুরুষ পালিয়ে যেতে, লুকিয়ে থাকতে বা বিদেশে নির্বাসনে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সবাই সেটি পারেননি। ফলে অনেককে প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দিতে হয়েছিল।

ড্রোন জান্তাকে চূড়ান্ত সুবিধা দিয়েছে। এ প্রযুক্তি আকাশে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।

৬০ হাজারের বেশি তরুণ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁরা ক্লান্ত সেনাবাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁরা অনভিজ্ঞ হলেও পার্থক্য এনে দিয়েছেন। বিদ্রোহী সূত্র বিবিসিকে নিশ্চিত করেছে, নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সেনারা ড্রোন ও বিমান হামলার পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিস্থিতি পাল্টে দিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন।

আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্টের (অ্যাকলেড) জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক এবং সশস্ত্র সংঘাতের তথ্য সংগ্রহে বিশেষজ্ঞ সু মনের মতে, ড্রোন জান্তাকে চূড়ান্ত সুবিধা দিয়েছে। এই প্রযুক্তি আকাশে তার অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।

সু মন সামরিক বাহিনীর ড্রোন ব্যবহারের ওপর নজর রাখছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো আমাদের বলছে, প্রায় অবিরাম ড্রোন হামলায় তাদের অনেক যোদ্ধা নিহত হচ্ছেন। এতে তারা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে।’

সু মন বলেন, ‘আমরা তথ্য যাচাই করে দেখছি, জান্তার বিমান হামলা আরও নির্ভুল হচ্ছে। সম্ভবত ড্রোন দিয়ে পথ দেখানোর কারণে বিমান হামলা আরও নির্ভুল হচ্ছে।’

সু মন বলেন, সীমান্তে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং চীনের দ্বৈত ব্যবহারের পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জন্য ড্রোন, এমনকি নিজস্ব ড্রোন তৈরি করার উপাদানগুলো পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

ড্রোনের বা এর উপাদানের দামও অনেক বেড়ে গেছে। এ ছাড়া সামরিক বাহিনীর কাছে এখন অনেক ভালো জ্যামিং প্রযুক্তি রয়েছে। তাই তাদের অনেক ড্রোন হামলা ব্যর্থ হচ্ছে।

মিয়ানমারের কারেন রাজ্যের একটি শিবিরে খাওয়ার জন্য আগুনে খাবার পুড়িয়ে নিচ্ছেন বিপিএলএ যোদ্ধারা। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, কারেন

বহু ফ্রন্টে যুদ্ধ

কেবল বিদ্রোহী গোষ্ঠী টিএনএলএ পিছু হটেনি। গত এপ্রিলে চীনের প্রবল চাপের পর ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের এক মিত্র গোষ্ঠী এমএনডিএএ লাশিও ছেড়ে দেয়। গত বছর বিদ্রোহীরা এ এলাকা দখল করে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। পূর্বে শান রাজ্যের সামরিক সদর দপ্তর এখানে ছিল।

এমএনডিএএ এখন জান্তার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে। শান রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও অস্ত্রসজ্জিত ইউডব্লিউএসএ গোষ্ঠীও চীনের দাবির কাছে নতি স্বীকার করেছে। তারা মিয়ানমারের অন্যান্য বিরোধী গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে।

এসব গোষ্ঠী সীমান্তে কাজ করে। নানা কাজে তাদের নিয়মিতভাবে চীনে যেতে হয়। চীনকে যা করতে হয়েছিল, সেটা হলো সীমান্তের ফটকগুলো বন্ধ করা এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কয়েকজন নেতাকে আটক করা, যাতে তারা তাদের দাবি মেনে চলে।

আরও দক্ষিণে কারেন রাজ্য। এ রাজ্যে থাইল্যান্ডের সঙ্গে সীমান্তের দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিং। এ এলাকায় যাওয়ার রাস্তাটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জান্তা।

প্রায় দেড় বছর আগে রাস্তার ধারে সেনাবাহিনীর ঘাঁটিগুলো দখল করেছিল বিদ্রোহী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন। এখন এসব ঘাঁটি ও জায়গার নিয়ন্ত্রণ হারানোর জন্য ন্যাশনাল ইউনিয়ন নতুন নিয়োগ দেওয়া যোদ্ধা, নতুন ড্রোন ও অন্যান্য কারেন মিলিশিয়া গোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতকতাকে দায়ী করছে।

বেইজিংয়ের নীতি হলো রাষ্ট্রের পতন নয়। সামরিক শাসনের প্রতি তার কোনো বিশেষ ভালোবাসা নেই। কিন্তু যখন মনে হয়, রাষ্ট্র টলতে এবং পড়ে যেতে পারে, তখন চীন এটিকে রাষ্ট্রের পতনের সমতুল্য মনে করে এবং হস্তক্ষেপ করে।

কারেন বিদ্রোহীরা এমনকি লে কে কও শহরও হারিয়েছে। কেএনইউর জন্য ২০১৫ সালে জাপানি অর্থায়নে নতুন এ শহর গড়ে তোলা হয়েছিল। তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে এ শহর নির্মিত হয়েছিল।

বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর একটি জোট দুই বছর ধরে প্রতিবেশী কায়াহ রাজ্যের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। সামরিক বাহিনী ডেমোসো শহর ও শান রাজ্যের ঠিক ভেতরে অবস্থিত মোবে শহর পুনর্দখল করেছে। জান্তা বাহিনী এখন উত্তরে কাচিন রাজ্য এবং সাগাইং ও মান্দালয়ের বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

তবে মিয়ানমারের এমন অনেক অংশ রয়েছে, যেখানে জান্তা বাহিনী খুব বেশি সফল হতে পারেনি। সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো রাখাইন ও চিন রাজ্যের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব রাজ্যে তারা সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখছে, এমনকি কিছু জায়গায় তাদের পিছু হটতেও বাধ্য করছে।

মরগান মাইকেলস মনে করেন, সামরিক বাহিনীর সাম্প্রতিক বিজয়ের একটি কারণ হলো, তারা শুধু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় তাদের বাহিনী জড়ো করছে। যেমন প্রধান বাণিজ্য রুট এবং যেসব শহরে তারা নির্বাচন করতে চায়, সেখানে সেনা বাড়াচ্ছে।

কিয়াউকম ও হিসিপাও এমন স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে, যেখানে জান্তা নির্বাচন আয়োজন করতে চায়। জান্তা স্বীকার করেছে, মিয়ানমারের ৩৩০টি অঞ্চলের মধ্যে ৫৬টিতে ভোট দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে বিরোধীরা মনে করে, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

মিয়ানমারের কাউকারিকের জঙ্গলে পিডিএফের গেরিলা যোদ্ধারা। ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, কাউকারিক

‘বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে চীন’

সীমান্ত অঞ্চলে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর ওপর চীন প্রভাব খাটিয়ে ‘অপারেশন ১০২৭’ দুই বছর আগে বন্ধ করতে পারত। সে সময় নিশ্চিতভাবেই ‘অনলাইন প্রতারণাকেন্দ্র’ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি হতাশার কারণে চীন তা করেনি। এ কারণে সংঘাত জান্তার মিত্র গোষ্ঠী–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নিশ্চিত করেছিল, এসব ‘প্রতারণাকেন্দ্রগুলো’ বন্ধ করা তাদের অগ্রাধিকার ছিল।

তবে এখন চীন জান্তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে। তারা নির্বাচনের জন্য প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি এবং প্রকাশ্যে কূটনৈতিক সমর্থন দিচ্ছে। এ বছর জান্তা নেতা মিন অং হ্লাইং এবং শি চিন পিংয়ের মধ্যে দুই দফা বৈঠকের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থান ও এর ধ্বংসাত্মক পরিণতি নিয়ে চীনের অস্বস্তি সত্ত্বেও এ বৈঠক করা হচ্ছে।

গত আগস্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছিলেন, চীন মিয়ানমারে বিশৃঙ্খলা ও যুদ্ধের বিরোধী।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যে চীনের উদ্বেগের বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

মাইকেলস বলছেন, বেইজিংয়ের নীতি হলো রাষ্ট্রের পতন নয়। সামরিক শাসনের প্রতি তার কোনো বিশেষ ভালোবাসা নেই। কিন্তু যখন মনে হয়, রাষ্ট্র টলতে ও পড়ে যেতে পারে, তখন চীন এটিকে রাষ্ট্রের পতনের সমতুল্য মনে করে এবং হস্তক্ষেপ করে।

মিয়ানমারে চীনের স্বার্থ সুবিদিত। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। মিয়ানমারকে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রবেশদ্বার এবং দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের জন্য তেল ও গ্যাস সরবরাহের রুট হিসেবে দেখা হয়। অনেক চীনা কোম্পানির মিয়ানমারে বড় বিনিয়োগ রয়েছে।

অন্য কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগ মিয়ানমারে কোনো অগ্রগতি আনতে পারেনি। তাই নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক শাসনকে শক্তিশালী করার চীনের এ উদ্যোগকে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ সমর্থন করতে পারে বলে মনে হচ্ছে।

তবে চীনের পক্ষেও যুদ্ধ শেষ করা কঠিন হবে। মিয়ানমারের জনগণের ওপর সামরিক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক দুর্ভোগ জেনারেলদের বিরুদ্ধে এমন ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে পারে।

মাইকেলস বলছিলেন, সামরিক বাহিনী শুধু শুষ্ক অঞ্চলে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা ফেলো মরগান মাইকেলস বলেন, ‘সহিংসতা ছিল ব্যাপক। সেই দেশে এমন লোক খুব কমই আছেন, যাঁরা জান্তার ক্ষতির শিকার হননি। এ কারণেই এ মুহূর্তে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুমান করা কঠিন। আক্ষরিক অর্থে আপনি আপনার ফ্রন্টলাইন ধরে রাখতে পারছেন না বলে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য হচ্ছেন, সেটা এক জিনিস। আবার শান্তির জন্য রাজনৈতিক দর–কষাকষি করা আরেক জিনিস। তবে শান্তি এখনো অনেক দূরে বলে মনে হচ্ছে।’