
বিজ্ঞান বলছে, আমরা জন্মগতভাবে পরোপকারী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সত্যিই সব সময় অন্যদের কথা ভাবতে বাধ্য?
উড়োজাহাজ উড়াল দেওয়ার আগমুহূর্তে যাত্রীদের সচেতন করার জন্য নিরাপত্তাবিষয়ক কিছু ঘোষণা দেওয়া হয়। যেমন ‘স্বাগতম’ এবং ‘এই বাঁশিটি বাজিয়ে সাহায্য চান’। এসবের মাঝখানে বলা হয়, ‘আগে নিজের অক্সিজেন মাস্ক পরুন, তারপর অন্যকে সাহায্য করুন।’
এই কথাকে বলা চলে ‘স্বার্থপরতা’ দেখানোর একরকম আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা। যদি আপনি আকাশে ৩৩ হাজার ফুট উচ্চতায় এবং ঘণ্টায় ৫৫০ মাইল গতিতে থাকা অবস্থায় কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে পড়েন, তাহলে এ নির্দেশনা ভালো কাজে দেবে।
ধরুন, পরিস্থিতি এমন হলো যে হঠাৎ করে কেবিনের ভেতরে চাপ কমে গেল। এই পরিস্থিতিতে যদি আপনি আগে নিজের অক্সিজেন মাস্ক না পরেন, তাহলে হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন। আর তখন আপনি আর কাউকে সাহায্য করার মতো অবস্থাতেই থাকবেন না।
বিজ্ঞান বলছে, আমাদের বেশির ভাগের মধ্যেই নিঃস্বার্থ হওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। কখনো কখনো তা আশ্চর্য রকমের বেশি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা সব সময় নিঃস্বার্থ হতে পারি বা হওয়া উচিত।
কিন্তু অন্যভাবে ভেবে দেখলে, এই কথাটাতে অনেকে ভুল বার্তাও পেতে পারেন। আজকের দুনিয়ায় যেখানে আত্মকেন্দ্রিক মানুষদেরই অনেক সময় বেশি সফল বলে মনে হয়, সেখানে এই লাইন যেন বলছে, সব সময় আগে নিজের কথা ভাবো আর নিজের স্বার্থই সবচেয়ে বড়।
সামাজিক মনোবিজ্ঞানী গির্ট হফস্টেডের মতে, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা হলো মানুষ কতটা নিজেকে স্বাধীন মনে করে, সেটির পরিমাপ। অর্থাৎ বড় একটি গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল থাকার বিপরীত দৃশ্য এটি।
বিশ্বের অনেক জায়গায়, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রবণতা দিন দিন প্রবল হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি ভালো, না খারাপ?
লিডস বেকেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক স্টিভ টেলর বলেন, ‘শুধু সেলফিশ জিন’ ও ‘নিও-ডারউইনিজম’ তত্ত্বই নয়; মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও জীববিজ্ঞানের বেশ কিছু তত্ত্ব এই বিশ্বাসকে স্বাভাবিক করে তুলেছে যে প্রতিযোগিতা মানেই মানুষ স্বভাবতই নিষ্ঠুর, নির্মম বা স্বার্থপর।
তবে টেলর এটাও মনে করেন যে মানুষ অবশ্যই স্বার্থপর হতে পারেন। কারণ, আমাদের মস্তিষ্কের প্রথম কাজই হলো আমাদের বাঁচিয়ে রাখা। তবে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো আরও আশাব্যঞ্জক কথা বলছে। এসব গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ যে সব সময় নিজের কথাই আগে ভাবেন, এই ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়।
আমরা কখন নিজের কথা আগে ভাবি আর কখন অন্যের কথা আগে ভাবি, তা অনেকটাই পরিস্থিতি, আমাদের আগের অভিজ্ঞতা এবং সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে।
১৯৬০-এর দশকে ‘বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট’ নামের একটি তত্ত্ব আলোচনায় আসে। এই তত্ত্বে বলা হয়, কেউ বিপদে পড়লে আশপাশের মানুষেরা খুব কমই এগিয়ে যান। ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্কে কিটি জেনোভেস নামের ২৮ বছরের এক নারী বারকর্মীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর তত্ত্বটি দেওয়া হয়েছিল। তত্ত্ব অনুসারে, কিটি জেনোভেসকে হত্যার দৃশ্যটি প্রায় ৪০ জন মানুষ দেখেছেন, কিন্তু কেউই তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি।
‘বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট’-এর পেছনের ঘটনাটি নিয়ে যে গল্প সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে, তার শেষাংশ এখন অনেকটাই বিতর্কিত বলে ধরা হয়। হ্যাঁ, কিটি জেনোভেসকে যে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছিল, এটা সত্যি এবং তা মর্মান্তিক। তবে তদন্তে দেখা গেছে, ৩৮ জন নির্লিপ্ত প্রত্যক্ষদর্শীর কথাটি সত্য নয়। ২০০৭ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জেনোভেসের হত্যাকাণ্ড যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা কেউই কিছু করেননি, এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি।
গবেষকেরা মনে করেন, এই গল্প একধরনের আধুনিক উপকথা হয়ে গেছে। তাঁদের মতে, এ ধারণা আসলে জরুরি পরিস্থিতিতে মানুষের সহানুভূতি বা সাহায্য নিয়ে আরও গভীরভাবে গবেষণার সুযোগকে সীমিত করে দিয়েছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক পরিস্থিতিতে মানুষ আসলে নিজের নিরাপত্তার চেয়েও অন্যের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতে প্রস্তুত থাকে।
২০২০ সালের এক গবেষণার অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস ও দক্ষিণ আফ্রিকায় সংঘটিত কিছু সহিংস হামলার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হয়। এতে দেখা যায়, প্রতি ১০টি হামলার মধ্যে ৯টিতেই অন্তত একজন ব্যক্তি ভুক্তভোগীকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি দেখা গেছে, যত বেশি ভিড় ছিল, তত বেশি সহায়তা করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
আপনি হয়তো যুক্তি দেখাবেন, এই তথাকথিত ‘সাহসী নায়ক’দের ভেতরেও হয়তো কিছুটা নিজের স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। সমাজের স্বীকৃতি অর্জনের চেষ্টায় মানুষ এমন করে থাকতে পারে। তবে ২০১৪ সালের এক গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা। এই গবেষণার অংশ হিসেবে ‘কার্নেগি হিরো’ পদক পাওয়া মানুষদের নিয়ে কাজ করা হয়েছে। যাঁরা অন্যকে বাঁচাতে নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেন, তাঁদের এই পদক দেওয়া হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের চরম পরোপকারী মানুষের অনেকেই বলেছেন, তাঁরা ঘটনার মুহূর্তে কোনো কিছু না ভেবেই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে অন্যকে বাঁচাতে এগিয়ে গেছেন।
ডিসকানেক্টেড বইয়ের লেখক স্টিভ টেলর বলেন, ‘আমরা অনেক সময় নিজের স্বার্থে কাজ করি, এটা সত্যি। কিন্তু এই স্বার্থপরতার মাত্রাটা হলো আমাদের অহং বা সমাজের তৈরি করা পরিচয়ের অংশ।’
টেলরের মতে, মানুষের ভেতরে হঠাৎই পরোপকারী হয়ে ওঠার স্বাভাবিক সক্ষমতাও আছে।
উদাহরণ হিসেবে টেলর ২০১৭ সালের মে মাসে তাঁর শহর ম্যানচেস্টারে আরিয়ানা গ্র্যান্ডের কনসার্টে আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। এতে ২২ জন নিহত ও ১ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন। হামলার পর ঝুঁকি নিয়েই অনেকে অন্যদের সাহায্য করতে এগিয়ে যান। এই ঘটনার স্বাধীন পর্যালোচনার ভিত্তিতে তৈরি কার্সলেক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে শত শত মানুষ সাহসিকতা ও নিঃস্বার্থতার পরিচয় দিয়েছেন। ২০০১ সালের নাইন ইলেভেন হামলা বা ২০১৫ সালের প্যারিস হামলার সময়েও একই ধরনের সাহসিকতার দৃশ্য দেখা গেছে।
টেলর মনে করেন, মানুষের পরোপকারিতার পেছনে বিবর্তনগত কারণ রয়েছে। প্রাচীন যুগে মানুষ দলবদ্ধভাবে শিকারে যেতেন এবং একে অপরকে সহযোগিতা করতেন।
কিছু নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায়, যাঁরা এখনো আমাদের পূর্বসূরিদের মতো করে জীবনযাপন করেন, তাঁরা সম্পদ ভাগাভাগিতে সমতা বজায় রাখেন।
বিজ্ঞান বলছে, ‘আমাদের বেশির ভাগের মধ্যেই নিঃস্বার্থ হওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। কখনো কখনো তা আশ্চর্য রকমের বেশি। তবে তার অর্থ এই নয় যে আমরা সব সময় নিঃস্বার্থ হতে পারি বা হওয়া উচিত।’
আমরা কখন নিজের কথা আগে ভাবি আর কখন অন্যের কথা আগে ভাবি, তা অনেকটাই পরিস্থিতি, আমাদের আগের অভিজ্ঞতা এবং সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে।
যেমন যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্রের মতো কিছু দেশের মানুষ অন্যদের তুলনায় বেশি আত্মকেন্দ্রিক। আবার এশীয় অঞ্চলের অনেক দেশ আছে যেখানকার মানুষেরা সামষ্টিক চিন্তা করে। তারা নিজেদের চেয়ে গোষ্ঠীর কল্যাণকে বেশি গুরুত্ব দেয়। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ মহামারির সময় গবেষকেরা দেখেছেন, সামষ্টিক সংস্কৃতির মানুষেরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্কৃতির মানুষের তুলনায় মাস্ক পরার ক্ষেত্রে বেশি সচেতন ছিলেন। তাঁরা অন্যদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন।
সবশেষে বলা যায়, ‘আমাদের অনেকেই অন্যের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে পারেন, আর এটা আমাদের জন্য ভালোও। এই কারণেই আমরা অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা আর সফল হয়েছি। অন্যের খেয়াল রাখা ভালো, তবে নিজের প্রতিও যত্নবান হতে হবে।’