
প্রায় চার বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ২৮-দফার একটি শান্তি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ইউক্রেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছেন।
তবে তথাকথিত এই ২৮-দফা পরিকল্পনা মেনে নিতে যুক্তরাষ্ট্র চাপ দেওয়ায় ইউক্রেন ও তাদের মিত্রদেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। দেশগুলো মনে করছে, এই পরিকল্পনা মেনে নেওয়ার অর্থ রাশিয়ার চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ করা।
বিশেষ করে এই পরিকল্পনা অনুসারে, রাশিয়াকে ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়া কিংবা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর আকার ছোট করার প্রস্তাব মেনে নিতে হবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর শান্তি পরিকল্পনা মেনে নিতে ইউক্রেনকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন। তবে ইউরোপীয় নেতাদের বিরোধিতার মুখে তিনি কিছুটা সুর নরম করেছেন। গত শনিবার ট্রাম্প বলেছেন, তাঁর পরিকল্পনাটি ইউক্রেনের জন্য চূড়ান্ত কোনো প্রস্তাব নয়।
ট্রাম্পের এই মন্তব্য জেনেভায় শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে কূটনৈতিক সমঝোতার উপায় খুঁজে বের করার সুযোগ করে দিয়েছে।
ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্ররা কেন যুক্তরাষ্ট্রের এই খসড়া পরিকল্পনার বিরোধিতা করছেন? জেনেভার আলোচনায় কারা অংশ নিয়েছেন? জেনেভা বৈঠকের এজেন্ডা কী? চলুন এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা যাক।
জেনেভায় চলমান আলোচনার মূল লক্ষ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বিতর্কিত শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে সমঝোতার উপায় খোঁজার চেষ্টা করা। ইউরোপীয় মিত্ররা ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন।
জেনেভা বৈঠকের এজেন্ডা কী
জেনেভায় চলমান আলোচনার মূল লক্ষ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বিতর্কিত শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে সমঝোতার উপায় খোঁজার চেষ্টা করা। ইউরোপীয় মিত্ররা ইউক্রেনের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।
জেনেভার বৈঠকে ইউক্রেন, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, বৈঠকে রুশ প্রতিনিধিরাও থাকবেন।
আল-জাজিরার সাংবাদিক হাশেম আহেলবারা জেনেভা থেকে বলেছেন, ইউক্রেনের জন্য এই বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন প্রশাসনের ২৮-দফা খসড়া পরিকল্পনা নিয়ে ইউক্রেন ও ইউরোপজুড়ে তীব্র উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। পরিকল্পনায় রাশিয়াকে নিজেদের ভূখণ্ডের কোনো একটি অংশ ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, স্থায়ী শান্তিচুক্তির বিনিময়ে ইউক্রেনকে লুহানস্ক, দোনেৎস্ক ও ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দিতে হবে। একই সঙ্গে খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ার রণাঙ্গনে যুদ্ধরত বাহিনী আর অগ্রসর হতে পারবে না।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর আকার ছোট করার প্রস্তাবও বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইউক্রেনের সেনা সক্ষমতা ৯ লাখ থেকে কমিয়ে ৬ লাখ করতে হবে। অস্ত্রও কমাতে হবে।
প্রস্তাব দুটির একটিও ইউক্রেনের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলো মেনে নিলে নিরাপত্তা ব্যাপক মাত্রায় বিঘ্নিত হবে বলে মনে করছে দেশটি।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর আকার ছোট করার প্রস্তাবও বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইউক্রেনের সেনা সক্ষমতা ৯ লাখ থেকে কমিয়ে ৬ লাখ করতে হবে।
জেনেভা বৈঠকে কারা অংশ নিয়েছেন
জেনেভার আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন মার্কিন সেনাবাহিনীর সচিব ড্যানিয়েল ড্রিসকোল।
ইউক্রেনের পক্ষে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন মোট ৯ জন কর্মকর্তা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের দপ্তরের প্রধান অ্যান্ড্রি ইয়ারমাক, ইউক্রেনের প্রধান আলোচক ও বিশেষ দূত রুস্তম উমেরভ। জেলেনস্কি তাঁদেরকে সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করার অনুমতি দিয়েছেন।
ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির নিরাপত্তা উপদেষ্টারা আলোচনায় যোগ দিয়েছেন, আছেন ইতালিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারাও।
ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে কেন ইউরোপীয় নেতারা উদ্বিগ্ন
ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্ররা মনে করছে, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট নয়। তারা বলছে, রাশিয়ার কাছে কোনো ভূমি ছেড়ে দেওয়া হবে না। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন বলেন, ‘যেকোনো গ্রহণযোগ্য ও টেকসই শান্তি পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা এবং যুদ্ধ শেষ করা, ভবিষ্যৎ সংঘাতের বীজ বপন করা নয়।’
উরসুলা ভন ডার লেন আরও তিনটি মূল নীতির কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো কোনো রাষ্ট্রকে জোরপূর্বক সীমান্ত পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া যাবে না। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার ওপর কোনো সীমা বেঁধে দেওয়া যাবে না। শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় রাখতে হবে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন বলেন, ইউক্রেনের তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম অধিকার থাকতে হবে।
জোহানেসবার্গে আয়োজিত জি২০ সম্মেলনে ইউরোপীয় ও অন্যান্য পশ্চিমা নেতারা ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছেন এবং বলেছেন, এটি আরও সমন্বয় ও পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
এক যৌথ বিবৃতিতে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, জাপান, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ড বলেছে, ‘ভবিষ্যতে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমরা আলোচনা করতে প্রস্তুত। তবে আমাদের মূলনীতি স্পষ্ট, জোরপূর্বক সীমান্ত পরিবর্তন করা যাবে না।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে ছোট করার প্রস্তাব তাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করছে। কারণ, এটি ইউক্রেনকে ভবিষ্যতে হামলা মোকাবিলার ক্ষেত্রে দুর্বল করে ফেলবে। এ ছাড়া ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সম্মতি ছাড়া নেওয়া যাবে না।
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস বলেন, গত শুক্রবার তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ফোনে কথা বলেছেন। তিনি ট্রাম্পকে জানিয়েছেন, ইউরোপকেও শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ করতে হবে। ইউক্রেনের নিঃশর্ত সম্মতির মাধ্যমেই কেবল যুদ্ধের অবসান করতে হবে।
জোহানেসবার্গে আয়োজিত জি২০ সম্মেলনে ইউরোপীয় ও অন্যান্য পশ্চিমা নেতারা ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছেন এবং বলেছেন, এটি আরও সমন্বয় ও পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
উরসুলা ভন ডার লেন বলেন, ইউক্রেনের মিত্রদের মূলনীতি হলো ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে তাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার সাংবাদিকদের বলেন, রাশিয়া বারবার শান্তির প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তাদের কথার সঙ্গে কাজের মিল পাওয়া যায় না।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনা মেনে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর আকার ছোট করা হলে রাশিয়া তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আবার আগ্রাসন চালাবে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এই পরিকল্পনা আরও শক্তিশালী হওয়া দরকার। ইউক্রেনকে কোনো অবস্থাতেই কমজোর করা যাবে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক নীতি প্রধান কাজা ক্যালাস বলেন, রাশিয়াই ইউক্রেনে আক্রমণ করেছে। তাদের কোনো ছাড় পাওয়ার অধিকার নেই।