
টানাপোড়েনের পর দুই ‘ভালো বন্ধু’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্ক কি চেনা ছন্দে ফিরছে? দুই দেশের মধ্যে বরফ কি শেষ পর্যন্ত গলতে শুরু করেছে? ভারতে এখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে এই দুই প্রশ্ন। আর এর পেছনে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিকতম পোস্ট এবং তারপর মোদির জবাব।
ঘটনার শুরু যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে সাম্প্রতিক এক পোস্টে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘খুব ভালো’ বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করেন। তিনি উল্লেখ করেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে আলোচনা চলছে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে তিনি অত্যন্ত আশাবাদী।
জবাব দিতে দেরি করেননি নরেন্দ্র মোদিও। এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লিখেছেন, ‘ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং অংশীদার।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে তিনিও আশাবাদী।
প্রসঙ্গত, ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে যেন কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। আর তার ধারাবাহিকতা চলতে থাকে একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে।
তবে সর্বশেষ ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়ে ভারতকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলার পর ভারত চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মন দেয়। সেই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের এ উদ্যোগ কি না, সে প্রশ্নও তুলছেন বিশ্লেষকেরা। সেই সঙ্গে ট্রাম্প ও মোদি—এ দুই শীর্ষ নেতার বক্তব্যে বন্ধুত্বের কথা বলা হলেও তা কতটা বাস্তবে রূপ নেবে, তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে বলে তাঁরা মনে করেন।
প্রসঙ্গত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্কনীতির বিরুদ্ধে মার্কিন আদালতে মামলা হয়েছিল। বিভিন্ন দেশের ওপরে যে শুল্ক আরোপ তিনি করেছেন, তার অধিকাংশই বেআইনি বলে জানিয়েছিল নিউইয়র্কের আদালত। সে রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। শিগগিরই এ বিষয়ে রায় আসার কথা, তার আগেই ভারতের প্রতি সুর নরম করেছেন ট্রাম্প।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিশেষজ্ঞ উপমন্যু বসু মনে করেন, কূটনীতিতে কিছুই স্থায়ী নয়—না বন্ধুত্ব না শত্রুতা। তিনি বলেন, এর বড় উদাহরণ হলো গালওয়ানের ঘটনার পরও ভারত ও চীনের মধ্যে সাম্প্রতিক সমীকরণ।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, কূটনীতি কিন্তু মেজার্ড আর্ট (মাপা পদক্ষেপ অর্থে)। কিন্তু ট্রাম্প অন্য পথে হাঁটেন। সেই কারণেই সমস্যা। শুধু ট্রাম্প প্রশাসনই ভারতের তরফ থেকে মার্কিন পণ্যে চড়া শুল্ক নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে, তা তো নয়, ওবামার সময়ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য শুল্ক নিয়ে ইস্যু (বিরোধ) ছিল। কিন্তু তাঁর মতে, ওই সময়ের সঙ্গে তফাতটা ‘ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাপ্রোচে (কূটনৈতিক রীতি)’।
উপমন্যু বসু বলেন, ট্রাম্পের কূটনীতি অনেকটা ইনআর্টিকুলেট ডিপ্লোম্যাসি—যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে অস্পষ্টতা রাখা হয়, পেনালাইজ করার প্রবণতা থাকে। অনেকটা কোল্ড ওয়ারের মতো মনোভাব। তিনিই আবার হঠাৎ ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন, মোদি তাঁর ভালো বন্ধু এবং ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব রাখেন ইত্যাদি।
ভারতের বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞ গীতাঞ্জলি সিনহা রায় মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ভিন্ন ধরনের রাষ্ট্রনেতা, তাঁকে কিছুটা মুডভিত্তিক (মনমতো) সিদ্ধান্তও নিতে দেখা গেছে এর আগে। তিনি বলেন, তবে তিনি ভারতবিরোধী নন। তাহলে ভারতের সঙ্গে সমস্ত ধরনের সম্পর্ক ছেদ করত যুক্তরাষ্ট্র, তা কিন্তু হয়নি। বরং মহাকাশ গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত আদান-প্রদানের বিষয়ে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক রাতারাতি বদলাবে না। উপমন্যু বসু বলেন, ‘একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে বরফ গলছে এবং দুই দেশ আবার ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, দিল্লির কিছুটা সতর্ক থাকাটা ভালো।’
উপমন্যু বসু আরও বলেন, ‘সতর্ক থাকার কারণ ট্রাম্প ২.০ তে দুই দেশের মধ্যে শত্রুতা দেখা গিয়েছে তা নয়। ট্রাম্পের পরও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক থাকবে, যেমনটা তিনি ক্ষমতায় আসার আগে ছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাবের কারণে দুই দেশের মধ্যে স্থিতিশীলতায় যে প্রভাব পড়েছিল, সেটা মানতে হবে।’ তিনি মনে করেন, প্রভাব কিছুটা হলেও থাকার আশঙ্কা আছে।
এই বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘একটা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের কারণে সবকিছু ভুলে গিয়ে আগের সম্পর্ক হয়ে যাবে, এটা ভাবার কারণ নেই। একটা মিক্সড ব্যাগেজ (সম্পর্কে মিশ্র প্রভাব বোঝাতে) থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘উদাহরণস্বরূপ ভারত বিকল্প হিসেবে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা ভাববে। যেভাবে কোণঠাসা করা হয়েছিল, তাতে ভারত অন্যান্য বিকল্প যে খুঁজবে, সেটাই স্বাভাবিক।’
গীতাঞ্জলি সিনহা রায় বলেন, ‘আমার মনে হয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ পরিবর্তনের একটা বড় কারণ সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সামিট। সেখানে ভারত নিজের অবস্থান তুলে ধরেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ভারত নিজের সম্পর্ক বজায় রেখেছে।’
তাঁর মতে, পাশাপাশি এসসিও কিন্তু পেহেলগাম হামলার তীব্র নিন্দা করেছে এবং সেটাও পাকিস্তানের উপস্থিতিতেই। এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটা বার্তা দেয়। কারণ, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভালো সম্পর্ক। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছেন, সে বিষয়ে সম্মতিও জানিয়েছিল পাকিস্তান। তৃতীয় কারণ হিসেবে জাপানের কথা বলেছেন তিনি।
গীতাঞ্জলি সিনহা রায়ের কথায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু চীনে যাওয়ার আগে জাপান সফরে গিয়েছেন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও অংশীদারত্ব বেড়েছে। আবার জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোট রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এদিকে ভারত-জাপানের অংশীদারত্ব বাড়লে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাপ্লাই চেইনের ওপর প্রভাব পড়বে। আগে ‘জেএআই’ মানে জাপান-আমেরিকা-ইন্ডিয়া বলা হতো, এখন ‘জে-আই’ হবে। এ বিষয়গুলো কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনও বোঝে। পাশাপাশি চীনও একটা কারণ বলে মনে করেন তিনি।
এই বিশেষজ্ঞের কথায়, ভারত-চীনের নৈকট্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ভালো নয়, এটা মার্কিন কর্মকর্তাদের বলতে শোনা গেছে। এদিকে উপমন্যু বসু বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাবের কারণে চীনের লাভ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তা বুঝতে পেরেছে। তিনি বলেন, ‘বহুপক্ষীয় বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমরা যে বহুপক্ষীয় বিশ্বে বাস করি, সেটা ওয়াশিংটনকে বুঝতে হবে। হয় আমরা বা ওরা—এমন শর্ত দিলে হবে না।’
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের একে অপরকে প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। উপমন্যু বসু বলেন, ‘দুই দেশই নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ভাববে, সেটাই স্বাভাবিক। ভারতের নিজস্ব দেশজ বাজার রয়েছে, যার বিশাল আয়তন। তাকে বাঁচানোর জন্য ভারত মার্কিন পণ্যের ওপর বেশি শুল্ক আরোপ করেছে। আবার ট্রাম্পও নিজের দেশের স্বার্থে এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর পদ্ধতি প্রথাগত কূটনৈতিকে ধারায় নয়। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের একে অপরকে প্রয়োজন। দুই দেশের কৌশলগত চাহিদাকে ভুলে গেলে হবে না।’
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ভারত যে গুরুত্বপূর্ণ ইন্দো-প্যাসিফিক পার্টনার, সেটা যুক্তরাষ্ট্রকে মানতে হবে। তা ছাড়া কোয়াডের কথাও ভুলে গেলে হবে না। ভারত, জাপানের মতো সদস্যদেশ যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘আবার যুক্তরাষ্ট্রকেও ভারতের দরকার। বাণিজ্যের দিক থেকে তাদের ওপর আমরা নির্ভরশীল। ভারত বিকল্প হিসেবে অন্যান্য দেশের কথা ভাবছে, কিন্তু সেটা রাতারাতি হবে না।’ তবে চীন যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে না বলে মনে করেন তিনি।
তাঁর কথায়, চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তত দিন ভালো হবে না, যত দিন না সীমান্তবিরোধের স্থায়ী সমাধান হচ্ছে।