
আজ থেকে ছয় বছর আগে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট রাজ্য হিসেবে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় মোদি সরকার। সেই রাতে অভিযান চালিয়ে শত শত কাশ্মীরিকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী।
সেদিন লাদাখের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী ও পরিবেশবাদী আন্দোলনের নেতা সোনম ওয়াংচুক ভারত সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
তৎকালীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে (বর্তমান নাম এক্স) এক পোস্টে ওয়াংচুক লিখেছিলেন, ‘লাদাখের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী আপনাকে ধন্যবাদ।’
ওয়াংচুক লাদাখের একজন উদ্ভাবক ও শিক্ষাসংস্কারক। নানা বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন ও শিক্ষাসংস্কারমূলক কাজের জন্য ভারতজুড়ে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বলিউডের ব্লকবাস্টার সিনেমা ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর ‘র্যাঞ্চো’ চরিত্র তাঁকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে। এ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা আমির খান।
ওয়াংচুক সেদিন লাদাখবাসীর হয়ে নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘লাদাখের অনেক মানুষের বহু দশকের দাবি জম্মু ও কাশ্মীর থেকে তাঁদের অঞ্চলটিকে আলাদা করার। মোদি তাঁদের সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন।’
জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর রাজ্যটিকে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ নামে দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এর আগপর্যন্ত চীন সীমান্তসংলগ্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত লাদাখ জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অংশ ছিল।
কিন্তু রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত হলেও জম্মু ও কাশ্মীর স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন এবং নিজেদের আলাদা আইনসভা গঠনের অনুমতি পেয়েছে। লাদাখকে সেই অনুমতি দেওয়া হয়নি। ফলে আলাদা অঞ্চল হলেও নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলার সুযোগ লাদাখবাসীর কাছে অধরাই থেকে যায়।
ভবিষ্যৎ নির্ধারণে নিজেদের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় ধীরে ধীরে শান্ত লাদাখ রাজনৈতিকভাবে অস্থির হয়ে ওঠে। লাদাখবাসীর হতাশা প্রতিবাদ-বিক্ষোভে রূপ নিতে থাকে। তাঁদের এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ওয়াংচুক।
গত মাসের শেষ দিকে লাদাখে তরুণেরা নিজেদের দাবির পক্ষে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন। ভারতের আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে চার আন্দোলনকারী নিহত হন। ওয়াংচুকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
লাদাখে তরুণদের আন্দোলন দমাতে গত ২৬ সেপ্টেম্বর ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী ওয়াংচুককে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে লাদাখের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হাজার মাইল দূরে রাজস্থানের যোধপুর কারাগারে রাখা হয়েছে।
রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত হলেও জম্মু ও কাশ্মীর স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন এবং নিজেদের আলাদা আইনসভা গঠনের অনুমতি পায়। লাদাখকে সে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
ওয়াংচুকের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কার্যক্রম এবং ‘সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র’ করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অথচ বিজেপি ও মোদি সরকার এর আগে লাদাখে তাদের প্রচারে ওয়াংচুককে ব্যবহার করেছিল। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারগুলো স্থানীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার আনতে একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে ওয়াংচুকের পরামর্শ নিয়েছে।
ওয়াংচুককে সামনে রেখে মোদি সরকার নিজেদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। আজ সেই ওয়াংচুক মোদি সরকারের চোখে একজন ‘দেশদ্রোহী’। ওয়াংচুক লাদাখের পক্ষে যে আন্দোলন করছেন, তার পেছনে ভারত সরকার প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের ‘ইন্ধন’ খুঁজছে।
এ নিয়ে আল-জাজিরাকে ওয়াংচুকের স্ত্রী গীতাঞ্জলি আংমো বলেন, যে সরকার তাঁকে (ওয়াংচুক) সম্মানে ভূষিত করেছিল, হঠাৎ এক মাসের মধ্যে সেই একই সরকার তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলছে।
গীতাঞ্জলি আরও বলেন, ‘এ সংকেত স্পষ্ট: তাঁকে চুপ করাতে, ভয় দেখাতে এটি করা হচ্ছে। কারণ, তাঁকে তারা অর্থ দিয়ে কিনতে পারেনি।’
লেহতে শোক
গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে ওয়াংচুকের নেতৃত্বে লেহর কয়েকজন অধিকারকর্মী অনশন শুরু করেন। ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের (সিক্সথ শিডিউল) অধীন লাদাখকে সুরক্ষা দেওয়ার দাবিতে ওই অনশন শুরু করেছিলেন তাঁরা।
এ আইন ভারতের ওই অঞ্চলগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনিক ও শাসনকাঠামো দেয়, যেখানে মূলত ক্ষুদ্র উপজাতিদের বাস। লাদাখের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ সেখানকার ক্ষুদ্র উপজাতির অন্তর্ভুক্ত।
ওয়াংচুকদের অনশনের ১৫তম দিনে লাদাখের বিক্ষুব্ধ তরুণেরা সড়কে নেমে আসেন। ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁরা অঞ্চলটির রাজধানী লেহতে বিজেপির কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ গুলি চালায়। সেদিনের সংঘাতে চারজন নিহত হন, যাঁদের মধ্যে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যও রয়েছেন। বেশ কয়েকজন আহত হন।
সংঘর্ষের পর স্থানীয় প্রশাসন বড় ধরনের অভিযান চালায়, ৮০ জনের বেশি মানুষকে আটক করা হয়। ওয়াংচুকসহ অহিংস অনশন চালিয়ে যাওয়া কয়েকজন অধিকারকর্মীকেও আটক করা হয়।
যে সরকার তাঁকে সম্মানে ভূষিত করেছিল; হঠাৎ এক মাসের মধ্যে সেই একই সরকার তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলছেগীতাঞ্জলি আংমো, সোনম ওয়াংচুকের স্ত্রী
ওয়াংচুককে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ আইনের অধীন বিচার ছাড়াই এক বছর পর্যন্ত গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কারাবন্দী রাখা যায়।
ওয়াংচুক ও অনশনে বসা অন্য অধিকারকর্মীদের প্রতি সংহতি জানাতে স্থানীয় আরও এক ডজনের বেশি আন্দোলনকারী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
আধুনিক লাদাখের ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ ও দমন–পীড়নের ঘটনা।
একজন জাতীয় বীর
সোনম ওয়াংচুক ১৯৬৬ সালে লেহ থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি গ্রাম উলেতকপোতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৯ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতে তাঁর মায়ের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সোনম ওয়াংয়াল রাজনীতিবিদ ছিলেন। ১৯৭৫ সালে সোনম ওয়াংয়াল জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের মন্ত্রী হন এবং পরিবার নিয়ে সে সময়ের প্রাদেশিক রাজধানী শ্রীনগরে চলে যান।
শ্রীনগরে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ভাষা নিয়ে ওয়াংচুককে দারুণ অসুবিধায় পড়তে হয়। তিনি তখন কেবল লাদাখি ভাষা বুঝতেন। আর স্কুলে পড়ানো হতো উর্দু ও কাশ্মীরি।
সেখান থেকে ওয়াংচুক দিল্লির একটি হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং পরে শ্রীনগরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে যন্ত্র প্রকৌশলে লেখাপড়া করেন।
১৯৮৮ সালে স্নাতক পাস করার পরপর ওয়াংচুক অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলে লাদাখের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্য বিকল্প মডেল স্কুল স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ (এসইসিএমওএল) প্রতিষ্ঠা করেন।
ওয়াংচুকদের ওই স্কুল প্রতিষ্ঠার আগে লাদাখে প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী রাজ্য পর্যায়ের পরীক্ষাগুলোয় অকৃতকার্য হতো। কারণ, সেসব পরীক্ষার পাঠ্যক্রম ছিল উর্দু ভাষায়। লাদাখের অনেকের কাছে যা অচেনা। অন্যান্য সাংস্কৃতিক বাধাও ছিল।
ওয়াংচুকের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কার্যক্রম এবং ‘সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করার’ অভিযোগ আনা হয়েছে।
এসইসিএমওএল প্রতিষ্ঠার সাত বছরের মধ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার ৫ থেকে বেড়ে ৫৫ শতাংশ হয়। পরে তা ৭৫ শতাংশে পৌঁছায়।
ওয়াংচুক লেহর কাছে এসইসিএমওএলের বিকল্প স্কুল ক্যাম্পাসও প্রতিষ্ঠা করেন। ওই স্কুলে ভর্তি হওয়ার একমাত্র শর্ত হলো—সাধারণ স্কুলে অকৃতকার্য হতে হবে। ওয়াংচুকের এই স্কুলে শিক্ষার্থীদের সবকিছু হাতে-কলমে শেখানো হয়।
লাদাখের শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৬ সালে ওয়াংচুককে জম্মু ও কাশ্মীরের গভর্নর পদক দেওয়া হয়।
শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ছাড়াও ওয়াংচুক লাদাখের ভঙ্গুর প্রাকৃতিক পরিবেশের নানামুখী সংকটের বাস্তব সমাধান খোঁজার দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি ২০১৩ সালে বরফের স্তূপা উদ্ভাবন করেন।
স্তূপা হলো কৃত্রিম হিমবাহ, যা পানি সংরক্ষণ করে রাখতে সাহায্য করে। এটি লাদাখের গ্রীষ্মকালে তীব্র পানিসংকটের খুবই কার্যকর ও সহজলভ্য সমাধান হয়ে আসে, বিশেষ করে সেখানকার কৃষকদের জন্য।
এ সংকেত স্পষ্ট: তাঁকে চুপ করানোর জন্য, ভয় দেখানোর জন্য এটি করা হচ্ছে। কারণ, তাঁকে তারা অর্থ দিয়ে কিনতে পারেনিগীতাঞ্জলি আংমো
লাদাখের পরিবেশের প্রতি গভীর আগ্রহ ওয়াংচুককে একজন পরিবেশকর্মীতে রূপান্তর করে। তাঁর এসইসিএমওএল প্রথম কোনো সবুজ ক্যাম্পাস, যেটি সম্পূর্ণরূপে সৌরবিদ্যুতে পরিচালিত।
এ কাজের জন্য ওয়াংচুক ২০১৮ সালে ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পান। প্রচলিত ধারা ভেঙে একজন সংস্কারক হিসেবে ভারতের জাতীয় বীর হয়ে ওঠা ওয়াংচুকের বিরুদ্ধে এখন শুধু প্রচলিত ধারা ভাঙার অভিযোগই নয়; বরং ভারত রাষ্ট্রকেই চ্যালেঞ্জ জানানোর অভিযোগ আনা হয়েছে।
লাদাখ পুলিশের প্রধান এসডি সিং জামওয়াল বলেন, ‘বিশ্বস্ত সূত্র’ থেকে পুলিশ ওয়াংচুকের সঙ্গে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার খবর পায়। তার পর থেকে তাঁর ওপর নজর রাখা হচ্ছিল।
পুলিশ কর্মকর্তা আরও দাবি করেন, গত মাসে গ্রেপ্তার এক পাকিস্তানি গোয়েন্দা ওয়াংচুকের আন্দোলনের ভিডিও প্রচার করেছিলেন।
ইসলামাবাদের সঙ্গে ওয়াংচুকের যোগসাজশের ইঙ্গিত দিতে গিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর পাকিস্তান সফরের কথাও উল্লেখ করেন।
জাতিসংঘের সহযোগিতায় পাকিস্তানের ডন মিডিয়া গ্রুপ আয়োজিত একটি জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিতে ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন ওয়াংচুক। ইসলামাবাদে ওই সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির নানা উদ্যোগের প্রশংসা করেছিলেন তিনি।
এখন সেই ওয়াংচুককে গ্রেপ্তার করেই লাদাখের আন্দোলন দমন করতে চাইছে মোদি সরকার। যদিও তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি; বরং ওয়াংচুকের গ্রেপ্তার লাদাখের সংকটকে আরও তীব্র করেছে।
সেখানে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দলগুলো মোদি সরকারের আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা ওয়াংচুকসহ বাকিদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছে।
লাদাখের বৌদ্ধ অ্যাসোসিয়েশন সদস্য সেরিং দরজে বলেন, ‘(যদি সরকার আমাদের দাবিগুলো মেনে না নেয়) তবে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। এ ছাড়া আমাদের আর কীই–বা করার আছে? আমাদের লোকজন মারা যাচ্ছে। আমাদের লোকজন এবং নেতাদের এখন কারাবন্দী করা হচ্ছে। আমাদের হাতে এখন বিকল্প আর কী আছে?’
ওয়াংচুককে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীন গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ আইনের অধীন বিচার ছাড়াই এক বছর পর্যন্ত গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে কারাবন্দী করে রাখা যায়।
উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে
শিক্ষাসংস্কার ও পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করা ওয়াংচুক নিজেকে রাজনীতি থেকে দূরেই রেখেছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমেই তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান জোরালো হতে শুরু করে।
২০২০ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে গালওয়ানে সংঘর্ষের সময় ওয়াংচুক লাদাখের বাসিন্দাদের তাঁদের ‘পকেটের জোর’ দেখাতে এবং চীনা পণ্য বর্জন করতে বলেছিলেন। এর এক বছর পর তিনি বৈরী পরিবেশে অবস্থান করা ভারতীয় সৈন্যদের জন্য সৌরশক্তি দিয়ে পরিচালিত তাঁবু তৈরি করেন।
২০২৩ সালে বিশ্বের অন্যতম উঁচু পর্বতমালা খারদুং লার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লাদাখের ভঙ্গুর জীববৈচিত্র্যে যে প্রভাব পড়ছে, তা তুলে ধরতে এবং লাদাখের বাসিন্দাদের ভারতীয় সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের (সিক্সথ শিডিউল) অধীন সুরক্ষা দেওয়ার দাবিতে অনশন শুরু করেন। সে সময় তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়েছিল।
গত সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হওয়ার এক সপ্তাহ আগে ওয়াংচুক ২০১৯ সালের আগস্টে মোদি সরকারের জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার সিদ্ধান্তে তাঁর উল্লাস প্রকাশের কথা স্মরণ করেন।
পরে এক ভিডিও বার্তায় ওয়াংচুক বলেন, তিনি বুঝতে পেরেছেন, উত্তপ্ত কড়াই থেকে তাঁরা এখন জ্বলন্ত উনুনে পড়েছেন।
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পুলিশ ওয়াংচুকের সঙ্গে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার খবর পায়। তার পর থেকে তাঁর ওপর নজর রাখা হচ্ছিলএসডি সিং জামওয়াল, লাদাখ পুলিশের প্রধান
লাদাখে কোনো গণতান্ত্রিক ফোরাম আর নেই বলেও ওয়াংচুক মন্তব্য করেন।
কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের মূল সদস্যদের একজন সাজাদ কারগিলি। লাদাখে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনায় যেসব দল নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাদের একটি কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স।
সাজাদ কারগিলি বলেন, ‘সমাজে একজন মানুষ রাজনীতির দিকে চোখ ঘুরিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু রাজনীতি কখনো সেই মানুষকে বাদ দিতে পারে না। আগে হোক বা পরে, সোনম ওয়াংচুককে রাজনীতিতে আসতেই হতো। তিনি নিজের অতীত উদ্ভাবক পরিচয়ের কারণে রাজনীতি থেকে পালাতে পারবেন না। স্বাভাবিকভাবে তাঁকে রাজনীতিতে আসতেই হতো।’
যদিও ওয়াংচুকের রাজনীতির সঙ্গে সাজাদ একমত নন বলে নিজেই জানান। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘তবে আগে আমি যতই তাঁর সমালোচনা করি, আজ আমরা তাঁর সবচেয়ে বড় সমর্থক। কারণ, আমরা একসঙ্গে আমাদের সত্যিকারের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করছি।’
ওয়াংচুককে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বানানোর চেষ্টা করে মোদি সরকার আগুন নিয়ে খেলছে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন সাজাদ।
সাজাদ কারগিলি বলেন, ‘লাদাখ চীন ও পাকিস্তানের কাছের একটি সংবেদনশীল সীমান্ত অঞ্চল। সরকারের জন্য স্থানীয় মানুষদের সমর্থন থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
এভাবে দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে সরকার লাদাখের মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে বলেও মনে করেন এই লাদাখি নেতা। এতে সরকারের ওপর থেকে লাদাখের মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।
লাদাখের অন্যান্য নেতাও গ্রেপ্তার হতে প্রস্তুত বলে মন্তব্য করেন সাজাদ।
সময় ফুরিয়ে আসছে
ওয়াংচুকের স্ত্রী বলেছেন, কর্তৃপক্ষ কয়েক মাস ধরে তাঁর স্বামীর আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ জন্য দাতাদের হুমকি দেওয়া, ভয়ভীতি দেখাতে তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তাদের যাতায়াত, বিদেশি অনুদান গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় নিবন্ধন বাতিলসহ অনেক কিছুই করা হয়েছে।
সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে এবার ওয়াংচুককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর আন্দোলন এখনো টিকে আছে।
ওয়াংচুককে গ্রেপ্তারের পর এখন গীতাঞ্জলি নিরাপত্তা সংস্থার তদন্ত ও আদালতে মামলা চালানো ছাড়াও এসইএমসিওএল ও এইচআইএএলের কার্যক্রম চালু রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কর্তৃপক্ষ কী বলছে
৩০ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে লাদাখ প্রশাসন বলেছে, ওয়াংচুক তাদের দাবি মেনে নেওয়া না হলে আরব বসন্তের মতো করে সরকার উৎখাত করা হতে পারে বলে হুমকি দিয়েছিলেন। এমনকি একাধিকবার তিনি লাদাখের বাসিন্দাদের তিব্বতের বাসিন্দাদের মতো প্রতিবাদ করতে নিজেকে জ্বালিয়ে দেওয়ার কথাও বলেছেন।
স্থানীয় প্রশাসন লেহতে সহিংসতা এবং চারজনের মৃত্যুর জন্য ওয়াংচুককে দায়ী করেছেন। লাদাখ প্রশাসন বলেছে, লাদাখের অন্য নেতারা বিক্ষোভকারীদের শান্ত করতে এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ওয়াংচুক শান্তি ফিরিয়ে আনতে কোনো চেষ্টাই করেননি।
প্রতিপক্ষকে দমন করতে বা সাধারণ মানুষের চোখে ধুলা দিতে ওয়াংচুককে গ্রেপ্তারের প্রশ্নই ওঠে না বলেও দাবি করে লাদাখ প্রশাসন।
বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্বস্ত তথ্যসূত্র ও নথির ভিত্তিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। সংস্থাগুলোকে তাদের তদন্ত নিরপেক্ষভাবে চালিয়ে যেতে দেওয়া উচিত, যাতে প্রক্রিয়াটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
অন্যদিকে গীতাঞ্জলি মনে করেন, সরকার তাঁর স্বামী ও অন্যান্য প্রতিবাদকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে লাদাখে একটি ‘টাইম বোমা বসিয়ে দিয়েছে’।
যেমনটা ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হয়েছে। সেখানে বহু দশক ধরে ভারত সরকারের দমন-পীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন অঞ্চলটিকে স্থায়ী সংকটের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।
ওয়াংচুকের স্ত্রী প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘কেন তারা লাদাখকে কাশ্মীর বানানোর চেষ্টা করছে?’
তবে এত কিছুর মধ্যে গীতাঞ্জলি স্বামীর নিরাপত্তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন বলেও জানান।
ওয়াংচুককে কোন অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা জানতে গীতাঞ্জলি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, তাঁর স্বামীকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো এবং কোন অভিযোগে, তা তাঁকে জানানো হয়নি। তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুমতিও দেওয়া হয়নি।
কেন তা করা হয়নি এবং ওয়াংচুকের গ্রেপ্তার বেআইনি ও অন্যায় দাবি করে গীতাঞ্জলির করা হেবিয়াস কর্পাস (গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করা) মামলা গ্রহণ করেছেন বিচারপতি অরবিন্দ কুমার ও বিচারপতি এনভি আনজারিয়ার বেঞ্চ।
বেঞ্চ গত সোমবার কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি লাদাখ প্রশাসন ও রাজস্থানের যোধপুর সেন্ট্রাল জেলের সুপারকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নোটিশ জারি করেছেন।
গীতাঞ্জলির পক্ষে আইনজীবী কপিল সিব্বাল সেদিন বলেছিলেন, গ্রেপ্তারের কারণ না জানায় তাঁরা সেটিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারছেন না। এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ১৪ অক্টোবর ধার্য করা হয়েছে। তত দিন পর্যন্ত সোনম ওয়াংচুককে কারাগারেই থাকতে হবে।
গীতাঞ্জলি বলেন, ‘আমি তাঁর অবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানি না—তাঁকে কী খেতে দেওয়া হচ্ছে, তাঁকে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে কি না। সত্য বলার থেকে বিরত রাখতে আমাদের ওপর ভয় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে; এটিকে আর গণতন্ত্র বলা যায় না।’