
ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে চলচ্চিত্র আর রাজনীতি যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। রুপালি পর্দার জনপ্রিয়তা প্রায়ই মানুষকে টেনে আনে রাজনীতির মঞ্চে। একসময় যাঁরা নায়ক-নায়িকা হিসেবে দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন, পরে তাঁরা হয়ে ওঠেন লাখো মানুষের রাজনৈতিক আশ্রয়। তখন দর্শকেরা হয়ে ওঠেন ভোটার। এএমজিআর থেকে জয়ললিতা, রজনীকান্ত থেকে কমল হাসান এমনকি বর্তমান সময়ের থালাপতি বিজয়—তাঁরা সবাই অভিনয়জগৎ থেকে রাজনীতিতে পা রেখেছেন।
রাজনীতিতে এসেও সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছেন এসব তারকা। তাঁদের সমাবেশে ভক্ত-অনুরাগীদের ব্যাপক ভিড় দেখা যায়। গত শনিবারও তেমনটা ঘটেছিল। কারুর-রোড মহাসড়কের ভেলুসামাইপুরামে থালাপতি বিজয়ের ওই জনসভায় হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন।
এদিন ভারতের তামিলনাড়ুতে অভিনেতা থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া থালাপতি বিজয়ের দল তামিলাগা ভেত্রি কাজাগামের (টিভিকে) জনসভায় পদদলিত হয়ে ৪০ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তামিলনাড়ুতে অভিনয়জগৎ থেকে রাজনীতিতে আসা মানুষদের জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গটি আবারও সামনে এসেছে।
তামিলনাড়ুতে অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া এমন কয়েকজন মানুষ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
১৯৫০ সালে ‘মালাইক্কালান’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সেলুলয়েড–জগতে পা রাখেন মারুথুর গোপালান রামচন্দ্রন। তিনি এমজিআর নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনা ও প্রযোজনাও করতেন। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত জেমিনি গণেশন ও শিবাজি গণেশনের সঙ্গে মিলে তামিল চলচ্চিত্রের বক্স অফিস কাঁপিয়েছেন এ অভিনেতা।
১৯৬২ সালে এমজিআর রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি তখন সিএন আন্নাদুরাই প্রতিষ্ঠিত দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) দলে যোগ দেন। নিজের বন্ধু এম করুনানিধির পরামর্শে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এমজিআর ও করুনানিধির মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। আর এ দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে একসময় এমজিআরকে ডিএমকে থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এরপর ১৯৭২ সালে এমজিআর অল ইন্ডিয়া আন্না দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (এআইএডিএমকে) নামে একটি দল প্রতিষ্ঠা করেন। ৫ বছরের মাথায় ১৯৭৭ সালে এমজিআর তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হন। এমজিআর ছিলেন তামিল চলচ্চিত্রশিল্পের প্রথম কোনো অভিনেতা, যিনি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন।
১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে মৃত্যুর আগপর্যন্ত এমজিআর দুই মেয়াদে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৭০ বছর। এমজিআর এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর পর ৩০ জনের মতো ভক্ত-অনুরাগী আত্মহত্যা করেছিলেন। তাঁদের কেউ বিষ পান করে মারা গেছেন, আবার কেউ শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।
এমজিআর-এর হাত ধরেই চলচ্চিত্রজগতে পা রেখেছিলেন তামিলনাড়ুর জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়ললিতা। তিনি ১৪০টির বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রে সফল ক্যারিয়ারের পাশাপাশি জয়ললিতার রাজনৈতিক জীবনও কম আকর্ষণীয় ছিল না। চলচ্চিত্রের মতো রাজনীতিতেও তাঁকে পরিচয় করিয়েছিলেন এমজিআরই।
জয়ললিতা ১৯৮২ সালে এআইএডিএমকে-তে যোগ দেন। এরপর তিনি ১৯৮৪ সালে রাজ্যসভার সদস্য হন। ১৯৮৭ সালে এমজিআরের মৃত্যুর পর দলের অভ্যন্তরে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সে লড়াইয়ে জয়ললিতা বিজয়ী হন।
১৯৯১ সালে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হন জয়ললিতা। ২০১৬ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছয়বার এই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সমর্থকেরা তাঁকে ‘আম্মা’ বলে সম্বোধন করতেন। তবে সমালোচকেরা অভিযোগ করতেন, জয়ললিতা নিজের চারপাশে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভক্তির পরিবেশ তৈরি করেছিলেন।
বিতর্ক জয়ললিতার রাজনৈতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। তবু তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা তামিলনাড়ুর রাজনীতির ইতিহাসে একটি বিশেষ ও উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হিসেবে থেকে গেছে। এমজিআরের মতো করে জয়ললিতার মৃত্যুতেও তাঁর ভক্ত-অনুরাগীদের আহাজারি করতে দেখা গেছে।
তামিল চলচ্চিত্রের তারকা অভিনেতা কমল হাসান। তামিল চলচ্চিত্রের পাশাপাশি তিনি বলিউডেও কাজ করেছেন। দীর্ঘ অভিনয়জীবনে তিনি ‘বিশ্বরূপম’, ‘চাচি ৪২০’, ‘মহানদী’, ‘বিক্রম’, ‘ইন্ডিয়ান’-এর মতো জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
১৯৮৭ সালে ‘নায়কান’ চলচ্চিত্রের জন্য সেরা অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। কমল হাসান সব সময়ই তাঁর রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতেন। কিন্তু তিনি কখনো ডিএমকে বা এআইএডিএমকে-তে যোগ দেননি। ত্রুটিপূর্ণ নীতি ও কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি দুই দলেরই সমালোচনা করতেন।
২০১৬ সালে জয়ললিতার মৃত্যুর পর ক্ষমতাসীন এআইএডিএমকে ভেঙে পড়তে শুরু করে। রাজ্যের রাজনীতি অস্থির অবস্থার মধ্যে পড়ে। এই পরিস্থিতিতেই কমল হাসান তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ২০১৮ সালে নিজের রাজনৈতিক দল মাক্কাল নিধি মাইয়াম (এমএনএম) গঠন করেন। বর্তমানে কমল হাসান তামিলনাড়ু রাজ্যসভার একজন সদস্য।
দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী খুশবু সুন্দর। মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া খুশবুর পারিবারিক নাম নাখাত খান। চলচ্চিত্রজগতে তিনি খুশবু নামে পরিচিতি পান। খুশবু চলচ্চিত্রজগতে পা রাখেন একজন শিশুশিল্পী হিসেবে। জনপ্রিয় এ অভিনেত্রী ১৮৫টির বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।
খুশবু দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তবে রাজনৈতিক জীবনে তিনি বিভিন্ন সময়ে দল পরিবর্তন করেছেন। ২০১০ সালে খুশবু ডিএমকে দলে যোগ দেন। পরে ২০১৪ সালে দল পরিবর্তন করে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন।
খুশবু ২০২০ সালে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-তে যোগ দেন। ২০২১ সালে তিনি তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। চলতি বছর তামিলনাড়ু বিজেপির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন খুশবু।
রজনীকান্ত তামিল, হিন্দি, তেলেগু, কন্নড়, বাংলা এবং মালয়ালম চলচ্চিত্রে ১০০টির বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তাঁর কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে—‘বাশা’, ‘শিবাজি: দ্য বস’, ‘কালা’, ‘চন্দ্রমুখী’, ‘আন্ধা কানুন’, ‘এনথিরান’, ‘লিঙ্গা’ এবং ‘জেলার’।
রজনীকান্ত ২০১৭ সালে রাজনীতির মাঠে পা রাখেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক দল রজনী মক্কাল মন্দ্রম (আরএমএম) গঠন করেন। তবে তাঁর এ রাজনৈতিক যাত্রা কেবল ২০২১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এরপর তিনি দলটি ভেঙে দেন। তিনি আর রাজনীতিতে ফিরে আসার কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করেননি।
তামিল অভিনেতা বিজয়কান্তকে অনেক দেশপ্রেমসংক্রান্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে দেখা গেছে। সেখানে তিনি সেনা ক্যাপ্টেন বা পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ভক্তদের কাছে ‘ক্যাপ্টেন’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন বিজয়কান্ত। তিনি অনেক তামিল সিনেমায় অভিনয় করেছেন।
১৯৯১ সালে বিজয়কান্তের অভিনীত ১০০-তম চলচ্চিত্র ‘ক্যাপ্টেন প্রভাকরন’ মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক ছিল। এটি তামিল চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি রেকর্ড গড়েছিল। তার আগে কোনো অভিনেতার ১০০তম চলচ্চিত্র এতটা হিট হয়নি।
বিজয়কান্ত ২০০৫ সালে তাঁর রাজনৈতিক দল দেসিয়া মুরপোক্কু দ্রাবিড় কাজাগাম গঠন করেন। রাজনৈতিক যাত্রাটা সফলভাবে শুরু করেন বিজয়কান্ত। তিনি ২০১১ সালে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ ও ২০১১ সালে বিজয়কান্ত দুবার তামিলনাড়ু বিধানসভায় নির্বাচিত হন। ২০২৩ সালে ৭১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
শিবাজি গণেশন ছিলেন তামিল চলচ্চিত্রের একজন জনপ্রিয় তারকা। তবে তিনি এমজিআরের মতো এতটা খ্যাতি অর্জন করতে পারেননি। তিনি তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় আন্দোলনের নেতা পেরিয়ার ই ভি রামাসামীর ভাবাদর্শে আকৃষ্ট ছিলেন। মূলত শিবাজির একটি অভিনয় দেখার পরই পেরিয়ার তাঁকে ‘শিবাজি’ নামে ডাকেন।
আন্নাদুরাই ডিএমকে দল প্রতিষ্ঠা করলে শিবাজি এতে যোগ দিয়েছিলেন। তবে ১৯৬২ সালে তিনি কংগ্রেসকে সমর্থন করতে শুরু করেন এবং দলটির লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৮৮ সালে কংগ্রেস এআইএডিএমকে-এর সঙ্গে জোট গঠন করলে শিবাজি নিজের রাজনৈতিক দল থামিজাগা মুনেত্রা মুন্নানি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। এক বছর পর নির্বাচনে পরাজিত হলে তিনি দলটিকে জনতা দলের সঙ্গে একীভূত করেন।
তামিল চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন নেপোলিয়ন। নিজের চাচা ও ডিএমকের জ্যেষ্ঠ নেতা কে এন নেহরুর হাত ধরে রাজনীতিতে তাঁর অভিষেক ঘটে। ২০০১ সালে তিনি ভিল্লিভাক্কাম আসনে বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ডিএমকের এমএলএ নির্বাচিত হন। পরবর্তী নির্বাচনে তিনি হেরে যান।
২০০৯ সালে আবার নির্বাচনে জিতে ডিএমকে সরকারের মন্ত্রী হন। ২০১৪ সালে নেপোলিয়ন বিজেপিতে যোগ দেন।
উদয়নিধি স্টালিন একজন তামিল অভিনেতা ও প্রযোজক। তিনি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাঁর দাদা ও চিত্রনাট্যকার করুণানিধি তামিলনাড়ুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী। আর তাঁর বাবা এম কে স্টালিন তামিলনাড়ুর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান উদয়নিধি নিজেও অভিনেতা থেকে রাজনীতিক বনে যান। রাজনৈতিক অঙ্গনেও ইতিমধ্যে সাফল্য পেয়েছেন এ অভিনেতা। তিনি তামিলনাড়ু বিধানসভার একজন সদস্য। ২০২২ সালে উদয়নিধি রাজ্যের যুবকল্যাণ ও ক্রীড়া উন্নয়নমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। ২০২৪ সাল থেকে তিনি তামিলনাড়ুর উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তামিলনাড়ুর চলচ্চিত্রজগৎ থেকে রাজনীতিতে পা রাখা ব্যক্তিদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন জোসেফ বিজয় চন্দ্রশেখর। ভক্তদের কাছে তিনি থালাপতি বিজয় নামে পরিচিত। শিশু অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে অভিষেক হয় বিজয় থালাপতির। তাঁর বাবা এস এ চন্দ্রশেখর একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। বাবার কয়েকটি চলচ্চিত্রে তিনি শিশু অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছেন।
বিজয় সর্বপ্রথম মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন ১৯৯২ সালে, ‘নালাইয়া থিরপু’ চলচ্চিত্রে। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৮ বছর। বিজয় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর রাজনৈতিক দল তামিলাগা ভেত্রি কাজাগাম (টিভিকে) গঠন করেন। এই দলটি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।
তথ্যসূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য হিন্দু, দ্য উইক, দ্য ইকোনমিস্ট