আন্তর্জাতিক পদকপ্রাপ্ত কুস্তিগিরদের দিল্লির যন্তর মন্তরে ধরনায় বসতে দেবে না পুলিশ। দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে আজ সোমবার এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর আগে গতকাল রোববার কুস্তিগিরদের ধরপাকড়ের পর যন্তর মন্তরে তাঁদের ধরনাস্থল ভেঙে দেওয়া হয়। পদকপ্রাপ্ত কুস্তিগিরদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা বাধানো, সরকারি কাজে বাধা ও বেআইনি সমাবেশের অভিযোগে মামলাও করা হয়।
ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ তুলে চার মাস ধরে আন্দোলন করছেন এই কুস্তিগিরেরা। তাঁদের অভিযোগ, ব্রিজভূষণ সাতজন নারী কুস্তিগিরের শ্লীলতাহানি করেছেন। অথচ আজও তাঁকে বরখাস্ত বা গ্রেপ্তার করা হয়নি। কারণ, তিনি ক্ষমতাসীন বিজেপির এক নেতা ও সংসদ সদস্য। পুলিশও তদন্তে গতি আনেনি।
ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগটি পুরোনো। গত বছরের শেষ ও চলতি বছরের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদকপ্রাপ্ত কুস্তিগির বিনেশ ফোগত ও সাক্ষী মালিকেরা ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে সরব হন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন বজরঙ্গ পুনিয়ার মতো খ্যাতনামা পুরুষ কুস্তিগিরেরাও। দিল্লির যন্তর মন্তরে তাঁরা অবস্থান নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন।
পরে অবশ্য সরকারের অনুরোধে সেবার আন্দোলন প্রত্যাহার করেছিলেন কুস্তিগিরেরা। সরকার তাঁদের তদন্ত কমিটি গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তিন মাসেও কিছু না হওয়ায় মাসখানেক আগে কুস্তিগিরেরা আবার যন্তর মন্তরে অবস্থান নেন। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে দিল্লি পুলিশ ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দুটি এফআইআর করে।
এমন পরিস্থিতিতে রোববার নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের দিন কুস্তিগিরেরা মিছিল করে সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। তাঁদের অনেককে জবরদস্তি করে আটক করা হয়। রাতেই করা হয় মামলা। পরে আজ সকালে জানিয়ে দেওয়া হয়, আর কখনো কুস্তিগিরদের যন্তর মন্তরে ধরনার অনুমতি দেওয়া হবে না। অন্যত্র বসতে চাইলে পুলিশ বিবেচনা করবে।
এই নিয়ে শুরু হয়েছে প্রবল উতোর-চাপান। বিষয়টিতে রাজনৈতিক রং লেগেছে। কুস্তিগিরেরা অধিকাংশই হরিয়ানার; কৃষক পরিবারের সন্তান। কৃষি আইনকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্যের এই কৃষকসমাজ এমনিতেই ক্ষুব্ধ। কুস্তিগিরদের প্রতি ‘সরকারের উদাসিনতা’ তাদের আরও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কৃষকসমাজ তাদের সমর্থনে নতুন আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে বিজেপির অনীহা প্রবল। ২০২১ সালে কৃষক আন্দোলন চলাকালে উত্তর প্রদেশের লাখিমপুর খেরি জেলায় গাড়িচাপা দিয়ে কৃষক হত্যার ঘটনার পরও তাদের এ অনীহা প্রকট ছিল। গাড়িচাপার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত আশিস মিশ্রর বাবা অজয় মিশ্রকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পদ থেকে আজও বরখাস্ত করেনি বিজেপি। এবার কুস্তিগিরদের আন্দোলন ঘিরে ব্রিজভূষণকে নিয়ে একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই অনীহা ও অনড় মনোভাবে বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়ানোর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। চার মাস আগের আন্দোলনে কুস্তিগিরেরা রাজনৈতিক নেতাদের মঞ্চে উঠতে দেননি। এবার সেই মনোভাব থেকে তাঁরা সরে এসেছেন। ফলে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, সিপিআই, সিপিএম, সমাজবাদী পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা নিয়মিত তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
রোববার পুলিশের জবরদস্তির ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারের পর রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকেই টুইট করে বা বিবৃতি দিয়ে বিজেপি সরকারের সমালোচনা করেছেন, কুস্তিগিরদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ভারতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক সুনীল ছেত্রীও তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘কেন এভাবে কুস্তিগিরদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কারও সঙ্গে এমন ব্যবহার অসমর্থনীয়। বিষয়টির সঠিক মূল্যায়ন হওয়া জরুরি।’
টুইট করেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীও। পুলিশের বলপ্রয়োগের ভিডিও জুড়ে দিয়ে তিনি টুইটে লিখেছেন, ‘অহংকারী রাজার রাজ্যাভিষেক সম্পূর্ণ। রাস্তায় অসম্মানিত জনতার আওয়াজ।’ আর ভিডিওতে শোনা যাচ্ছে রাহুলের স্বর, ‘মেয়েদের বাঁচাও, মেয়েদের পড়াও। কার হাত থেকে বাঁচাতে হবে দেশের মেয়েদের? বিজেপির হাত থেকে। সরকার কিছু করবে না। এটাই হিন্দুস্তানের ছবি।’
এদিকে বিজেপির মতে, এই আন্দোলন পুরোপুরি রাজনৈতিক। স্বার্থান্বেষী মহল কুস্তিগিরদের সামনে এনে ফেডারেশন দখলের চক্রান্ত করছে। তারা মনে করছে, এটা এক অন্যায় ও অযৌক্তিক আন্দোলন। এই রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চীনের হাংঝাউয়ে এশিয়ান গেমস ও ২০২৪ সালে প্যারিস অলিম্পিকে ভারত কুস্তির দল পাঠাতে পারবে কি না। আরও বড় প্রশ্ন, ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশের তদন্ত এশিয়ান গেমস শুরুর আগে শেষ হবে কি না।