সৌদি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক জামাল খাসোগি
সৌদি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক জামাল খাসোগি

জামাল খাসোগি হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান স্ত্রী হানানের

সৌদি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক জামাল খাসোগি ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে খুন হন। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তাঁকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। তবে মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে যুবরাজের সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, বিন সালমান এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তাঁর এই বক্তব্যের পর স্বামী হত্যার ন্যায়বিচার পেতে সহায়তা করতে ট্রাম্পের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন জামাল খাসোগির স্ত্রী হানান আলআতর খাসোগি।

সৌদি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক জামাল খাসোগির স্ত্রী হানান আলআতর খাসোগি তাঁর স্বামী হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁর স্বামীর হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুবরাজ কিছুই জানেন না বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা শুনে তিনি হতাশ হয়েছেন।

সিএনএন, সিবিএস নিউজসহ কয়েকটি মার্কিন গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হানান আলআতার এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘জামালকে হারানোর পর আমার জীবনে সব শেষ হয়ে গেছে। শুধু আমার ভালোবাসার মানুষকেই নয়, আমি হারিয়েছি আমার জীবিকা, আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং আমার বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ। কখনো কখনো বাতাসে চুরুটের গন্ধ ভেসে এলে আমার তাঁর কথা মনে পড়ে, আর একমুহূর্তের জন্য আমি বিশ্বাস করি, তিনি এখনো বেঁচে আছেন।’

হানান আলআতর বলেন, ‘আমি চাই পৃথিবী জানুক, জামাল কেবল একজন সাংবাদিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন আমার প্রিয় স্বামী, চার সন্তানের গর্বিত বাবা, আর তিন নাতির স্নেহের দাদা। পরিবারই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর এই গুণটিই ২০০৯ সালে আমাদের প্রথম সাক্ষাতে আমাকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। তারপর বছরের পর বছর ধরে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল এবং আমরা আরব বিশ্বের পরিবার ও সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতাম।’

সাংবাদিক জামাল খাসোগির স্ত্রী হানান আলআতর খাসোগি

জামাল খাসোগির স্ত্রী বলেন, ‘২০১৮ সালের মার্চ মাসে তিনি আমাকে তাঁর ৫৯তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর পর আমার প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা স্বীকার করেন। ওয়াশিংটন ডিসি এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় তাঁর ২০ জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মধ্যে আমরা জন্মদিন উদ্‌যাপন করি। যখন তিনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, তখন সিদ্ধান্ত নিতে আমার কোনো দ্বিধা ছিল না। আলেকজান্দ্রিয়া, ভার্জিনিয়াতে আমাদের বিয়ের সুন্দর অনুষ্ঠান হয় এবং আমরা ভার্জিনিয়ায় আমাদের বাড়ি বসবাস শুরু করি।’

হানান বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রে সুখে ছিলাম। তবে ইস্তাম্বুলে চলে যাওয়ার কথাও আলোচনা করেছিলাম। কারণ, সেখানে আমাদের পরিবারগুলোর কাছে থাকা যেত এবং জামাল আমাদের জন্য একটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনার পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, সেখানে সম্পত্তি কিনলে সহজেই তুরস্কের নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে এবং তাঁর সৌদি পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায়, এটি তাঁকে প্রয়োজনীয় ভ্রমণ নথি, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিমা সরবরাহ করবে, যা তাঁর খুব দরকার ছিল।’

খাসোগির স্ত্রী বলেন, ‘কিন্তু আমাদের ভবিষ্যতের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর, যখন আমি জামালের নিখোঁজ হওয়ার ভয়ংকর খবরটি পেলাম। আমি পাগলের মতো তাঁর সেলফোনে বারবার ফোন করলাম, কিন্তু তিনি ধরলেন না। আমি তথ্য জানতে জামালের সন্তানদের ফোন করলাম। পরিচিত সবার কাছে ফোন করে মরিয়া হয়ে আমার স্বামীর খবর জানতে চাইলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিন আর সপ্তাহ পার হতে থাকল এবং আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল, জামাল আর কখনো ফিরে আসবেন না।’

জামাল খাসোগির সঙ্গে হানান আলআতর খাসোগি

হানান বলেন, ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট সাংবাদিক জামালকে সৌদি এজেন্টরা ইস্তাম্বুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে হত্যা করেন। তাঁর দেহ টুকরা টুকরা করেন তাঁরা। তাঁকে আর কখনোই ভবনটি থেকে বের হতে দেখা যায়নি, তাঁর মরদেহও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই সময় আমাদের বিয়ের মাত্র চার মাস হয়েছিল।’

খাসোগির স্ত্রী বলেন, ‘আমি কখনো শোক শেষ করতে পারিনি। ২০২১ সালে আমার দুঃখ আরও বেড়ে যায়, যখন ইন্টারনেট পর্যবেক্ষক সিটিজেন ল্যাব ও ওয়াশিংটন পোস্টের তাঁর সাবেক সহকর্মীরা আমাকে জানান, আমার ডিভাইসগুলোতে ইসরায়েলি সাইবার-আর্মস সংস্থা এনএসও গ্রুপে তৈরি স্পাইওয়্যার পেগাসাস দিয়ে নজরদারি করার লক্ষণ দেখা গেছে।’

হানান বলেন, ‘আমার ডিভাইসগুলো যে সুরক্ষিত ছিল না, তা জানতে পেরে আমি ভেঙে পড়েছিলাম। জামাল আর আমি যখন আমাদের ভবিষ্যতের ভ্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতাম, তখন কে আমাদের কথা শুনছিল? এভাবেই কি তারা তাঁর প্রতিটি গতিবিধি ও ভ্রমণের পরিকল্পনা জানতে পেরেছিল?’

এই নারী বলেন, ‘এখন আমি নিশ্চিত, জামালের ফোনগুলোও স্পাইওয়্যারে আক্রান্ত হয়েছিল। এ কারণেই আমি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কাছে তাঁর সেলফোন, ল্যাপটপ এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত জিনিস ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছি। তাঁর স্ত্রী হিসেবে আমার জানার অধিকার আছে, তাঁর ডিভাইসগুলোতে সত্যিই স্পাইওয়্যার ছিল কি না।’

জামাল খাসোগির সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল হানান আলআতর খাসোগি

হানান বলেন, ‘আজ সৌদি যুবরাজ যখন ওয়াশিংটন ডিসিতে আসছেন তখন আমি চাই তিনি জানুন, আমাদের কিছু অসমাপ্ত কাজ বাকি আছে। যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে, তাদের প্রকৃত জবাবদিহির পাশাপাশি, আমি আমার স্বামীর দেহাবশেষ ফিরে পেতে চাই, যাতে আমি তাঁকে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সমাহিত করতে পারি।’

খাসোগির স্ত্রী বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে যুবরাজের দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং অস্ত্র বিক্রির ওপর গুরত্ব থাকবে। তবে আমি এই সুযোগটি ব্যবহার করে আমার ও আমার স্বামীর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’

হানান আলআতর বলেন, ‘আমি তাঁর (জামাল খাসোগি) বিধবা হিসেবে আমার ন্যায্য ক্ষতিপূরণও দাবি করছি। যুবরাজ ২০১৯ সালে “৬০ মিনিটস” অনুষ্ঠানে স্পষ্ট বলেছিলেন, সৌদি আরবের কার্যত নেতা হিসেবে তিনি “জামাল খাশোগির হত্যার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিচ্ছেন”...বিশেষ করে যেহেতু এটি সৌদি সরকারের কর্মরত ব্যক্তিরা করেছেন।’

খাসোগির স্ত্রী বলেন, ‘ওই ঘটনার একটি মীমাংসা বা ক্ষতিপূরণ হবে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে আমার ও আমার স্বামীর প্রতি জবাবদিহি বাস্তবায়নের একটি সদিচ্ছা, যার মাধ্যমে বিষয়টি চিরতরে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব হবে।’

সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার বিচার দাবিতে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের সামনে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী তাওয়াক্কুল কারমানের নেতৃত্বে বিক্ষোভ। ২০১৮, ইস্তাম্বুল

হানান আরও বলেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা আছে, আমার জন্য চূড়ান্ত মীমাংসার মধ্যস্থতা করতে সাহায্য করার। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি যুবরাজকে আমার স্বামীকে যাঁরা হত্যা করেছেন, তাঁদের প্রকৃত জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এবং সৌদি আরবের সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে রাজি করাতে পারবেন।’

হানান আলআতর আরও বলেন, ‘আমি আশা করছি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বিধবার আকুতি শুনবেন।’