প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয় করে তুলেছে বিশ্বের এই ১০ দেশকে

দৃষ্টিনন্দন সমুদ্রতট, পাহাড়ি উপত্যকা থেকে রঙিন সব গ্রাম বা প্রাচীন নগরী—নানা কারণে একটি দেশ ছবির মতো সুন্দর হয়ে ওঠে। নিজের চোখে সেই সৌন্দর্য দেখতে ভ্রমণপিপাসু মানুষ সেসব দেশে ভ্রমণে যান। নিজের চোখে না দেখলে, নিজের পায়ে ঘুরে না বেড়ালে কারও পক্ষে কোন দেশ কত সুন্দর, তা নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। কোনো দেশে বেড়াতে গিয়ে চোখজুড়ানো কোনো দৃশ্য দেখে যদি পর্যটকদের মনে প্রশ্ন জাগে, যা দেখছি, তা কী সত্যি? তবেই না বেড়ানোর সার্থকতা।

এসব দেশ থেকে ফিরে যাওয়ার পরও পর্যটকদের মনে অনেক দিন সেদেশ ভ্রমণের রেশ থেকে যায়। তাঁরা বারবার সেখানে ফিরে যেত চান। পর্যটকদের চোখে সবচেয়ে সুন্দর ১০টি দেশ নিয়ে আজকের আয়োজন। ট্রাভেলবিঞ্জার ডটকম এই তালিকা প্রস্তুত করেছে।

নিউজিল্যান্ড

নিউজিল্যান্ডের গ্লো ওয়ার্ম কেভ

সুপরিচিত ট্রাভেল কোম্পানি ‘রাফ গাইডসের’ ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর দেশের তালিকায় এক নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে নিউজিল্যান্ড। ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্য, স্থাপত্য, সংস্কৃতি ও মানুষ বিবেচনায় ধরে এই জরিপ পরিচালিত হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া পাঠকেরা নিউজিল্যান্ডের অসাধারণ ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্য, তুষারে ঢাকা দুর্গম পর্বতশৃঙ্গ, সোনালি সৈকতের প্রশংসা করেছেন।

নিউজিল্যান্ডের প্রধান দুই দ্বীপের একটি সাউথ আইল্যান্ডে রয়েছে হিমবাহ সৃষ্ট উপসাগর, আলপাইন হ্রদ। নর্থ আইল্যান্ডে রয়েছে গ্লো-ওয়ার্ম কেভস (এসব গুহার ভেতর জোনাকির মতো নীলচে আলো জ্বালা একধরনের পোকা থাকে, গুহার অন্ধকারে সেগুলো নীলচে আলোয় ঝলমল করে), আগ্নেয়গিরি পার্ক এবং মাওরি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ। এসব কারণেই পরিচালক পিটার জ্যাকসন তাঁর ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ সিনেমার পটভূমি হিসেবে নিউজিল্যান্ডকে বেছে নেন।

গ্রিস

গ্রিসের প্রাচীন স্থাপনা পর্যটকদের মুগ্ধ করে

ভ্রমণবিষয়ক নানা সমীক্ষায় সবচেয়ে সুন্দর দেশগুলোর তালিকায় বরাবরই গ্রিসের নাম থাকে। গ্রিসের দুর্গম পাহাড়, শান্ত হ্রদ এবং আঁকাবাঁকা নদীপ্রবাহ প্রকৃতি ও শান্তিপ্রিয় পরিবেশে ভ্রমণপ্রেমীদের মন কাড়ে। ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর দেশটিতে খুব একটা বৃষ্টি হয় না, গড় তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশটি প্রায় সারা বছর রৌদ্রোজ্জ্বল থাকে।
গ্রিসে অনেক সৈকত রয়েছে।

সেগুলোয় সাদা, কালো, গোলাপি, লালসহ বিচিত্র রঙের বালু দেখতে পাওয়া যায়। ভূমধ্যসাগরের নীল জলঘেরা দেশটির পাথুরে গঠন ও পাহাড়গুলোও দারুণ আকর্ষণীয়। স্যান্টোরিনি দ্বীপের ঐতিহ্যবাহী সাদা-নীল বাড়ির ওপর ছড়িয়ে পড়া সূর্যের সোনালি আভা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। আইকনিক নীল গম্বুজ, প্রাচীন মন্দির ও এথেন্সের ধ্বংসাবশেষ দেখতেও প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক গ্রিসে আসেন।

ইতালি

পিসার হেলানো টাওয়ার

অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ইতালিতে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষিত স্থানের সংখ্যা বেশি। ইউরোপের দেশটির প্রতিটি শহর যেন কিছু না কিছু অনন্য ও মনোমুগ্ধকর উপহার নিয়ে বসে আছে।

এখানে রোমের কোলোসিয়াম ও অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, পিসার হেলানো টাওয়ার, ফ্লোরেন্সের ক্যাথেড্রাল বা রঙিন গন্ডোলাভরা ভেনিসের খালগুলোয় ঘুরে বেড়ানো যে কাউকে দেবে রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা। ইতালির প্রাকৃতিক দৃশ্যও মনোমুগ্ধকর।

জাপান

জাপানে চেরির স্নিগ্ধ সৌন্দর্য

এশিয়ার দেশ জাপান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। শিজুওকাওয়ার দিগন্তরেখা দখল করে থাকা ফুজি পর্বতমালা থেকে শুরু করে সাকুরা (ফুলভর্তি চেরিগাছ) উৎসব—সবই আপনাকে সৌন্দর্য আর পবিত্রতার অনুভূতি দেবে।

শরতে কায়ো মৌসুমে জাপানের উদ্যানগুলো লালচে সোনালি রং ধারণ করে। বসন্তে চেরি ফোটার মৌসুমে সারি সারি চেরিগাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। এ ছাড়া আছে নারার হরিণ পার্ক আর জাপানি আল্পস। সুন্দর দেশের যেকোনো তালিকায় তাই জাপানের অবস্থান প্রায় পাকা।

সুইজারল্যান্ড

সুইজারল্যান্ডের গ্রামগুলো এমন ছবির মতো সুন্দর

সুইজারল্যান্ডে আয়নার মতো স্বচ্ছ পানির হ্রদের ধার ঘেঁষে ছোট ছোট গ্রাম যেন ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে উঠে এসেছে। এখানে ইউনেসকো ঘোষিত ১৩টি ঐতিহ্যবাহী স্থান রয়েছে।

ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো সুইজারল্যান্ডেও আল্পস পর্বতমালার একটি অংশ রয়েছে। স্কি ও হাইকিংয়ের জন্য যা দারুণ জনপ্রিয়।

নরওয়ে

নরওয়েতে তীব্র শীতের রাতগুলোয় আকাশে প্রাকৃতিক আলোর এমন নৃত্য দেখা যায়

অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ নরওয়ে। বিখ্যাত সব সমুদ্র খাঁড়ি আর আশ্চর্য সুন্দর সব ঝরনা সারা বিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তবে নরওয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় এর নর্দার্ন লাইট বা উত্তরী আলোর কারণে। তীব্র শীতের রাতগুলোয় আকাশে প্রাকৃতিক আলোর এই নৃত্য দর্শনার্থীরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন।

নরওয়ের রাজধানী অসলো বন ও পানি দিয়ে ঘেরা। তাই সেখানে মূল শহর থেকে খুব একটা দূরে না গিয়েই হাইকিং, স্কি, সাঁতার ও কায়াকিং করার সুযোগ মেলে। দেশটির ‘গাইরানগারফিয়র্ড’ বা গাইরানগার সমুদ্র খাঁড়ি ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। গাইরানগারফিয়র্ডে আছে ঘন বন, পাহাড়ের উঁচু চূড়া আর ৮০০ ফুট উচ্চতার ঝরনা।

ইন্দোনেশিয়া

ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের একটি সৈকত

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাকৃতিক রত্নগুলোর একটি ইন্দোনেশিয়া। প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশটির বিখ্যাত দ্বীপ বালি। তবে বালি ছাড়াও এখানে আরও বহু দ্বীপ আপনাকে মুগ্ধ করবে। যেমন গোলাপি বালুকাবেলার দ্বীপ কোমোডো, খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘরের দ্বীপ সুম্বা, জাভা দ্বীপের ব্রোমো ও ইজেন আগ্নেয়গিরির ভোরের দৃশ্যের সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।

পশ্চিম পাপুয়ার উপকূলে অবস্থিত রাজা আমপাত দ্বীপপুঞ্জে রয়েছে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ প্রবালপ্রাচীর ও ‘ব্লু চ্যানেল’। দ্বীপপুঞ্জটি স্কুবা ডাইভারদের জন্য স্বপ্নের গন্তব্য। আরেকটি দর্শনীয় স্থান হলো ফ্লোরেস। কম ভিড়ের এই দ্বীপে দেখতে পাওয়া যাবে খাড়া সবুজ পাহাড় আর সাদা বালুর সৈকত।

শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, ইন্দোনেশিয়ায় বন্য প্রাণী দেখতেও বহু পর্যটক ভিড় জমান। দেশটিতে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্যগুলোয় প্রাকৃতিক আবাসে ওরাংওটাং, সামুদ্রিক কচ্ছপ ও কোমোডো ড্রাগন (বিশাল আকারের একধরনের গিরগিটি) দেখা যায়।

কানাডা

কানাডার একটি হ্রদের পানিতে পাহাড়ের ছায়া পড়েছে

২০২৪ সালে ভ্রমণসংক্রান্ত নানা র‍্যাঙ্কিংয়ে কানাডা ধারাবাহিকভাবেই সবচেয়ে সুন্দর দেশের তালিকায় ওপরের দিকে স্থান পেয়েছে। এর কারণ, দেশটির বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতি ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

কানাডা নিঃসন্দেহে উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে সুন্দর দেশ। আয়তনে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশটি সবুজ উপকূলরেখা এবং ‘বে অব ফন্ডি’ চূড়ার কারণে বিখ্যাত।

কানাডায় রয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৫৬৬ মাইল দীর্ঘ উপকূলরেখা। আর কোনো দেশের এত দীর্ঘ উপকূলরেখা নেই। এ ছাড়া অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় এখানে বেশি হ্রদ রয়েছে। আর এর জাতীয় উদ্যানগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সত্যিকারের নিদর্শন।

আইসল্যান্ড

আইসল্যান্ডের বরফে ঢাকা প্রান্তর

ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র আইসল্যান্ডের বুনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে খুব কম দেশের তুলনা চলে। সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, হিমবাহ, উষ্ণ প্রস্রবণ, বরফে ঢাকা প্রান্তর, উষ্ণ জলপ্রপাত, লাভা সুড়ঙ্গসহ অন্যান্য ভৌগোলিক বিস্ময়ের কারণে প্রায়ই আইসল্যান্ডকে ‘অগ্নি ও বরফের দ্বীপ’ নামে ডাকা হয়। উত্তর আটলান্টিকে অবস্থিত এই দেশ উত্তরী আলো দেখার জন্য পৃথিবীর সেরা স্থানগুলোর একটি।

দেশটির পর্যটকপ্রিয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে স্কাফটাফেল বরফ গুহা, ডেটিফস জলপ্রপাত, হিমবাহ থেকে তৈরি জোকুলসার্লন লেগুন ও কালো রঙের বালুর রেইনিসফজারা সৈকত।

ভারত

ভারতের তাজমহল

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত একদিকে যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূপ্রকৃতির অধিকারী, তেমনি দেশটিতে রয়েছে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় বহু স্থাপনা।

প্রাচীন শহর বারানসির নৈসর্গিক সূর্যাস্ত, তাজমহলের স্থাপত্যশৈলীর চমক, গোয়ার সৈকত আর কেরালার চিরহরিৎ ভূপ্রকৃতি ভারতকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর দেশের একটিতে পরিণত করেছে।

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে চিরহরিৎ বন, উত্তরে অপূর্বসুন্দর হিমালয় আর রাজস্থানের প্রাণবন্ত মরুভূমি আপনাকে একনজরে সারা বিশ্বের ভূবৈচিত্র্য দেখে ফেলার অনুভূতি দেবে।