
ইরানে ইসরায়েলি হামলা শুরু হয় ১৩ জুন। এর পর থেকে তেহরানবাসীর স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটে। আতঙ্কে অনেকেই ঘরবন্দী জীবন কাটান। আর কেউবা ঘর হারিয়ে ছোট্ট সন্তানকে বুকে চেপে ধরে খুঁজেছেন নিরাপদ আশ্রয়; কেউ সাবওয়ে স্টেশনে ঢুকেছেন রাত কাটানোর আশায়। এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কী করেছেন ইরানের জেন-জিরা? কেমন ছিল তাঁদের জীবন?
আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের তরুণেরা বাইরে বের হতে না পেরে আশ্রয় খুঁজেছেন ভার্চ্যুয়াল জগতে। এটা তাঁদের কাছে তখন একমাত্র নিরাপদ জায়গা ছিল। ডিসকর্ড, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্যান্য চ্যাটিং অ্যাপেই তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন একধরনের ডিজিটাল আশ্রয়কেন্দ্র। এই আশ্রয়কেন্দ্রের আলোচনায় ছিল বেঁচে থাকার কৌশল, মানসিক সমর্থন ও বন্ধুতা।
তেহরানের ২৪ বছর বয়সী আইটি প্রকৌশলের শিক্ষার্থী মোমো (ছদ্মনাম) ১৮ জুন আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আবাসিক ভবন লক্ষ্য করেও হামলা হচ্ছে। আমরা জানি না কোথায় যাব। আমরা জানি না পাশের বাড়িটা অভিজাত রেভল্যুশনারি গার্ডস কোরের (আইআরজিসি) নাকি গোয়েন্দা দপ্তরের। জানি না, ওপরের ফ্ল্যাটের মানুষটা সাধারণ কেউ, নাকি সরকারের লোক। আমার পাশের ভবনটা হয়তো গোপন সামরিক প্রকল্পের অংশ।’
তবে এরপরও অন্যদের মতো তেহরান ছাড়েননি মোমো। নীতিগত অবস্থান থেকেই তিনি এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতে তেহরানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কোথায় যাব আমি? আমার ঘর এখানে, জীবন এখানে। আমরা কোনো দমনমূলক শাসনের কাছে বা ইসরায়েলি আগ্রাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করব না। আমরা অনেকেই তেহরানে আছি। জানি না কত দিন এ অবস্থা চলবে। কিন্তু আমি চাই, আমার ঘরই হোক আমার কবর, তবু উদ্বাস্তু হয়ে বাঁচতে চাই না।’
ইন্টারনেটই একমাত্র আশ্রয়
ইরানে তখন যোগাযোগব্যবস্থাও নজরদারির ভেতর ছিল। কোথাও কোথাও ছিল বিচ্ছিন্ন। সেখানে ইরানের জেন-জিরা ডিজিটাল জগতে তৈরি করেছিল নতুন নিরাপদ আশ্রয়। এসব অনলাইন ফোরাম হয়ে উঠেছিল একেকটা ভার্চ্যুয়াল আশ্রয়কেন্দ্র, থেরাপির ঘর ও সংগঠনের কেন্দ্র। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০১০–এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত যাঁদের জন্ম, তাঁরাই হলেন জেন-জি বা জেনারেশন জেড। বর্তমানে এই প্রজন্মের সদস্যদের বয়স ১২ থেকে ২৭ বছর।
সাত বছর ধরে ডিসকর্ড অ্যাপ ব্যবহার করছেন মোমো। সংঘাত চলাকালে অনলাইনে পরিবারের চেয়েও বেশি সময় একসঙ্গে থাকতেন তাঁরা। মাঝেমধ্যে বোমা বিস্ফোরণের সময় তাঁরা একসঙ্গে সিনেমা বা সিরিজ দেখতেন। কখনো কখনো একসঙ্গে অনলাইনে ঘুমিয়ে পড়তেন।
ইরানের এই তরুণ প্রজন্ম নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সেন্সরশিপের মধ্যে বেড়ে উঠেছে। দেশটিতে পুলিশি হেফাজতে ২০২২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুর পর দেশজুড়ে যে আন্দোলন শুরু হয়, সেখানেও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বড় ভূমিকা পালন করেছে এই প্রজন্ম। সংঘাত চলাকালেও অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো হয়ে উঠেছিল তাঁদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
ইরানের সংবাদপত্র দৈনিক শারঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ইরানি জেন-জি (মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ) গেমার ও ডিসকর্ড অ্যাপ ব্যবহারকারী। সরকারি নিষেধ থাকলেও তারা ভিপিএন ও এনক্রিপটেড অ্যাপ দিয়ে সংঘাতের সময় অনলাইনে সক্রিয় ছিলেন।
ইরানের ২৩ বছর বয়সী তরুণ সামিন (ছদ্মনাম) বলেন, ‘হামলা শুরুর সময় আমরা গেম খেলছিলাম। তাই শুরুতে আমরা বুঝতে পারছিলাম না যে বিস্ফোরণের শব্দ গেম থেকে আসছে নাকি বাস্তবে হচ্ছে। এ কারণে গেমগুলোতেও গুলি ও বোমা বিস্ফোরণ থাকে। কল অব ডিউটি খেলছিলাম। শেষ পর্যন্ত বুঝেছি, বাস্তবেই বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে।’
ইরানে ২০২৪ সালের এপ্রিলে ডিসকর্ড অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হয়। সরকার বলেছে, অশালীন কনটেন্টের জন্য অ্যাপটি বন্ধ করা হয়েছে। যদিও অনেকে মনে করেন, প্রতিবাদ সংগঠিত করার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহারের কারণেই এটি বন্ধ করা হয়। তবু এতে দমে যাননি জেন-জিরা।
সংঘাতের সময়কার দিনগুলোর কথা মনে করে সামিন বলেন, ‘ভিপিএন খুঁজে বের করে লগইন করে আমরা অনেক কিছু করি। নিজেদের চ্যানেলে ঢুকি। কেউ অনলাইনে না এলে আমরা ফোন করি। কল মাঝপথে কেটে গেলে বুক কেঁপে ওঠে। মনে হয়, ওই ব্যক্তি হয়তো বোমা বিস্ফোরণে মারা গেছেন।’
অন্তঃসত্ত্বা নারীদের পাশে
ইরানের সঙ্গে সংঘাত চলাকালে তেহরানে সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে মায়েদের যোগব্যায়ামের জন্য একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ নারীদের জন্য হয়ে উঠেছিল অপ্রত্যাশিত এক সহমর্মিতার কেন্দ্র। এর সদস্যরা অন্তঃসত্ত্বা। যাঁরা রাজধানী তেহরান ছাড়তে পারেননি, তাঁদের জন্য এই গ্রুপে ছিল শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার কৌশল ও জরুরি পরামর্শ। ছিল ভয়েস মেসেজে কথা বলারও সুযোগ।
আমিনাহ ও তাঁর বন্ধু জোহরা দুজনই পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডধারী। দুজনই তাঁদের মা-বাবার ভিসা অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁদের দুজনেরই সন্তান হবে। আমিনাহ যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে থেকে সন্তানের জন্ম দিতে চান; আর জোহরা ইরানে ফিরে আসেন সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় পরিবারের সহায়তা নেওয়ার জন্য।
ইসরায়েলি হামলার কারণে দুজনেই হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তবে তাঁরা হোয়াটসঅ্যাপে ‘ইয়োগা ফর প্রেগন্যান্সি’ নামের একটি গ্রুপে যুক্ত ছিলেন।
আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা জোহরা সে সময়ের কথা মনে করে বলেন, ‘আমরা পরস্পরকে ভয় কাটানোর পরামর্শ দিই। একসঙ্গে অনলাইনে ইয়োগা করি, মোম জ্বালাই আর ভয়েস মেসেজ পাঠাই।’
জোহরা বলেন, এক রাতে বিস্ফোরণের শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তখন এক বন্ধু বলেছিল, ‘শ্বাস ও হৃৎস্পন্দনের ওপর মনোযোগ দাও, তাহলে কনট্র্যাকশন কমে যাবে।’ আরেকবার পেটের ভেতর বাচ্চা নড়ছিল না। তখন তারা বলল, ‘গান চালাও, মালিশ করো এবং আবারও ইয়োগা করে দেখো।’
১২ দিন ধরে চলে ইসরায়েল-ইরান সংঘাত। এরপর ২৪ জুন হয় যুদ্ধবিরতি। সংঘাতের এ সময় ইরানিদের বিদ্রোহ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নীরব ও গভীরভাবে মানবিকভাবে বেঁচেছিল। কোনো সতর্কবার্তা নেই; নেই কোনো বোমা আশ্রয়কেন্দ্র। তবু দেশটির তরুণ প্রজন্ম একে অপরকে খুঁজে নিয়ে দিচ্ছেন মানসিক আশ্রয়, বেঁচে থাকার কৌশল ও শুশ্রূষা।