ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন

ফিরে দেখা

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য পোক্ত করার জন্য কতটা দায়ী সাদ্দাম

ফিলিস্তিন ইস্যুতে শক্ত অবস্থান নিয়ে আরবসহ গোটা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে তাঁর অবস্থান ছিল দৃশ্যত মার্কিনবিরোধী। আদতে কি তাই? ১৯৭৯ সালের ১৬ জুলাই সাদ্দাম ইরাকের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। জেনে নেওয়া যাক সেই সময়ের ইরাকের নেপথ্যের রাজনীতি।

মধ্যপ্রাচ্যের সমসাময়িক ইতিহাসে বড় জায়গা করে নিয়েছেন ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন। তাঁর শাসনামলে অস্থির সময় পার করেছে গোটা অঞ্চল। বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে তাঁর অবস্থান ছিল দৃশ্যত মার্কিনবিরোধী। আদতে কি তাই? নাকি নিজের একরোখা মনোভাব আর আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আরব বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য পোক্ত করার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলেন সাদ্দাম। ইরান ও কুয়েতে হামলা করার মাধ্যমে তিনি কার্যত আরব বিশ্বকে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বলয়ে ঠেলে দিয়েছিলেন।

১৬ জুলাই। ১৯৭৯ সালের এই দিনে সাদ্দাম হোসেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। এরপর টানা প্রায় ২৫ বছর তিনি ইরাক শাসন করেন। এ সময়ে তিনি প্রতিবেশী দুটি দেশে আগ্রাসন চালান। সংঘাতে জড়ান ইসরায়েলের সঙ্গেও। তাঁর বিরুদ্ধে নিজ দেশের জনগণের ওপর নিপীড়ন চালানোর অভিযোগ রয়েছে।

কৃষক পরিবার থেকে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে

ইরাকের উত্তরাঞ্চলে তিকরিত শহরের পাশে ১৯৩৭ সালের ২৮ এপ্রিল এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে সাদ্দামের জন্ম। জন্মের আগেই তাঁর বাবা মারা যান। বাগদাদে চাচার কাছে থেকে বড় হয়েছেন তিনি। ২০ বছর বয়সে ইরাকের বাথ পার্টিতে যোগ দেন। বছর দুয়েকের মাথায় ইরাকের প্রধানমন্ত্রীকে উৎখাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন সাদ্দাম ও তাঁর দলীয় সহযোগীরা। আহত অবস্থায় পালিয়ে যান সিরিয়ায়, এরপর মিসরে।

সাদ্দাম মিসরের কায়রো ল স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৯৬৩ সালে ইরাকে বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে। দেশে ফেরেন সাদ্দাম। ভর্তি হন বাগদাদ ল কলেজে। ওই বছরই ক্ষমতা ছাড়তে হয় বাথ পার্টির সরকারকে। সাদ্দামকে কারাগারে যেতে হয়। কয়েক বছর বন্দী ছিলেন তিনি।

একপর্যায়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আত্মগোপনে চলে যান সাদ্দাম। দলের নেতা হন তিনি। ১৯৬৮ সালে বাথ পার্টি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় আসে। এতে নেতৃত্ব দেন সাদ্দাম। তবে ওই সরকারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আহমাদ হাসান আল-বকর। ১৯৭৯ সালের ১৬ জুলাই তাঁকে সরিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেন সাদ্দাম।

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে ইরাকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হয়। তবে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরাকের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে তৎপর হয় ওয়াশিংটন। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে বাগদাদে সাদ্দামের সঙ্গে উষ্ণ সাক্ষাৎ হয় মার্কিন বিশেষ দূত ডোনাল্ড রামসফেল্ডের।

ক্ষমতা দখলে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতা

নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল পলিসি ফোরামের (জিপিএফ) আর্কাইভে থাকা একটি নিবন্ধে বলা হয়, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ১৯৬৩ সালে সাদ্দামের বাথ পার্টিকে প্রথমবারের মতো ক্ষমতা দখল করতে সাহায্য করেছিল। তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায়, সাদ্দাম ১৯৫৯ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) আর্থিক সুবিধাভোগীদের তালিকায় ছিলেন, যখন তিনি ইরাকের প্রভাবশালী নেতা আবদ আল-করিম কাসেমকে হত্যার একটি ব্যর্থ চেষ্টায় অংশ নেন।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, বিশেষ করে ইরাকের রাজনীতি নিয়ে বিস্তর জানাশোনা আছে লেখক হান্না বাতাতুর। তাঁর গবেষণা থেকে জানা যায়, কীভাবে ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাথ পার্টি ক্ষমতা দখল করে নেয়। মার্কিন গোয়েন্দাদের সরবরাহ করা তালিকা নিয়েও কথা বলেন তিনি। ওই তালিকা ধরে বিরোধীদের, বিশেষ করে কমিউনিস্টদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করেছিল বাথ পার্টি।

‘হিউম্যান রাইটস ইন আমেরিকান ফরেন পলিসি: ফ্রম দ্য নাইনটিন সিক্সটি’জ টু দ্য সোভিয়েত কলাপস’ বইয়ের লেখক জো রেনোয়ার্ড। ওয়াশিংটনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স ফোরামের (আইএএফ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিনি লিখেন, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ছিল নিছকই বাস্তববাদী রাজনীতিনির্ভর। ওয়াশিংটন তেলের সরবরাহ অক্ষুণ্ন রাখতে, সোভিয়েত ও ইরানি প্রভাব সীমিত করতে, আরব জাতীয়তাবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ইসলামপন্থার বিস্তার রোধ করতে চেয়েছিল।

জো রেনোয়ার্ড লেখেন, সাদ্দাম হোসেনের বাথপন্থী ইরাক কেবল ধর্মনিরপেক্ষ ও কমিউনিস্টবিরোধীই ছিল না, এটি মস্কো ও তেহরান উভয়ের বিরুদ্ধেই একটি সম্ভাব্য ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি ছিল। দেশটির বিশাল তেলের মজুত পশ্চিমা বিশ্বের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারত। ইতিহাসবিদ জোসেফ সাসুন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে এই পারস্পরিক স্বার্থ সাদ্দাম ও যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সহজাত মিত্রে’ পরিণত করেছিল।

ইরাকের রাজধানী বাগদাদে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে করমর্দন করছেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন বিশেষ দূত ডোনাল্ড রামসফেল্ড। ডিসেম্বর, ১৯৮৩

অপ্রস্তুত ইরানে হামলা কার স্বার্থে

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী কাউন্টার পাঞ্চের অনলাইন সংস্করণে ২০০৪ সালের ১৭ জুন ‘সাদ্দামকে যেভাবে রাসায়নিক অস্ত্রে সজ্জিত করেছেন রিগ্যান (যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান)’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন নর্ম ডিক্সন। এতে তিনি বলেন, ইরাকগেটের (ইরাককে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ও সামরিক সহযোগিতা) প্রেক্ষাপট ছিল ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে ইরানের গণ-অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানে মার্কিনপন্থী শাহ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। ইরানের এই বিপ্লব কৌশলগত তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। ইসরায়েল ছাড়াও ইরান দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের প্রধান মিত্র ছিল।

ওয়াশিংটন তাৎক্ষণিকভাবে ইরানি বিপ্লবকে দুর্বল বা উৎখাত করার অথবা শাহর পতনের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার উপায় খুঁজতে শুরু করে। সাদ্দাম হোসেনের সরকার এতে এগিয়ে আসে। ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরানে আক্রমণ করে বসে ইরাক। আট বছর ধরে চলা এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। এই যুদ্ধে ওয়াশিংটন ইরাককে সমর্থন করেছিল।

মার্ক ফিথিয়ানের ১৯৯৭ সাল প্রকাশিত বই ‘আর্মিং ইরাক: হাউ দ্য ইউএস অ্যান্ড ব্রিটেন সিক্রেটলি বিল্ট সাদ্দামস ওয়ার মেশিন’ বইয়ে বলা হয়, ১৯৮৩ সালে রিগ্যান ইতালির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলিও আন্দ্রেওত্তিকে ইরাকে অস্ত্র সরবরাহের অনুরোধ করেছিলেন।

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে ইরাকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হয়। তবে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ইরাকের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে তৎপর হয় ওয়াশিংটন। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে বাগদাদে সাদ্দামের সঙ্গে উষ্ণ সাক্ষাৎ হয় মার্কিন বিশেষ দূত ডোনাল্ড রামসফেল্ডের। এই সাক্ষাতে রামসফেল্ড বলেন, ইরাকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আরও উন্নত করতে ‘প্রস্তুত’, যা পরবর্তী সময়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক আবার শুরু করার পথ প্রশস্ত করে।

ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সহায়তা পাওয়া সাদ্দাম মনে করেছিলেন, কুয়েতে ইরাকের আগ্রাসন এড়িয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, ওই যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাঁর প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে।

ওয়াশিংটন ইরাককে তাদের সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রের তালিকা থেকে বাদ দেয় এবং ইরানকে সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এ ছাড়া ইরাককে খাদ্যশস্য কেনার জন্য ঋণ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ইরাকের ঋণমান বাড়ানোর জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা হয় এবং তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহের সুবিধা দেওয়া শুরু হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি জাতীয় নিরাপত্তা নির্দেশিকায় স্পষ্ট করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ‘ইরাকের পতন রোধ করতে’ সচেষ্ট ছিল। এ জন্য ইরাককে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করার পাশাপাশি আঞ্চলিক দেশগুলো থেকে আরও সহায়তা আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৮৪ সালের ২৪ মার্চ রামসফেল্ড আবারও বাগদাদে যান। একই দিনে জাতিসংঘ থেকে মার্কিন বার্তা সংস্থা ইউপিআই এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘ইরানি সেনাদের ওপর নার্ভ এজেন্ট-মিশ্রিত মাস্টার্ড গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের একটি দল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।’ আর ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত রামসফেল্ড বাগদাদে ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের ইরানসোর্স ব্লগের সম্পাদক ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষক হলি ড্যাগরেস ২০১৮ সালের ২০ আগস্ট একটি ব্লগে লেখেন, শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সাদ্দামের অতর্কিত আক্রমণে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।

বিপ্লব-পরবর্তী অস্থিরতায় জর্জরিত দুর্বল দেশ হিসেবে ইরান শাহ আমলের সামরিক ব্যক্তিত্বদের হয় নির্বাসন অথবা মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনী থেকে সরিয়ে দেয়। সামরিক বাজেট এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দেয়। এতে সাদ্দাম ধারণা করেছিলেন, নতুন আঞ্চলিক শক্তিধর হিসেবে তাঁর জয় নিশ্চিত এবং সহজেই তিনি জয়লাভ করবেন।

ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন

কিন্তু সাদ্দামের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। বরং ইরান-ইরাক যুদ্ধ ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে আরও সুদৃঢ় করে। এটি আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির সরকারকে ক্ষমতা সুসংহত করতে এবং বিপ্লবের বিরুদ্ধে থাকা অন্য গোষ্ঠীগুলোকে দমন করতে সাহায্য করে।

অনেক ইরানি জাতীয়তাবাদকে আলিঙ্গন করেন এবং ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেদের দেশকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। এই যুদ্ধকে ইরানিরা ‘চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ’ কিংবা ‘পবিত্র প্রতিরক্ষা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এ সুযোগে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ধর্মতন্ত্রের প্রতি জনসাধারণের সমালোচনাও কমে যায়।

জো রেনোয়ার্ড তাঁর নিবন্ধে লেখেন, যদিও ১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ ছিল, তবু যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাকের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন হয়েছিল। কারণ, উভয়েই ইরানের বিজয়ের আশঙ্কা করেছিল। যেহেতু ইরানের বিপ্লবের প্রসারের বিরুদ্ধে ইরাক একটি রক্ষাকবচ ছিল, তাই সিআইএর ১৯৮৩ সালের একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল, ‘ইরাকের সম্পূর্ণ পরাজয় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর ফল বয়ে আনবে।’

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাটি পরবর্তী সময়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল, ‘বর্তমান (ইরাকি) সরকার যেকোনো নতুন সরকারের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আরও অনুকূল নীতি অনুসরণ করবে এবং সাদ্দামের অপসারণ দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার সূচনা করতে পারে।’

যুদ্ধে ইরাককে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ১৯৯২ সালের ২৬ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমসের এক নিবন্ধে বলা হয়, ইরান-ইরাক যুদ্ধের শুরুর দিকে বাগদাদকে গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য দেওয়ার মার্কিন সিদ্ধান্তটি এসেছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সতর্কবাণীর পর। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানিয়েছিল, ইরানের দাপটে প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়ছে ইরাকি বাহিনী। এর এক বছর আগে ইরানের সেনাবাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্রের গোপন চালান পাঠিয়ে শক্তিশালী করা হয়েছিল।

নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে রিগ্যান প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ইসরায়েলকে কয়েক শ কোটি ডলার মূল্যের মার্কিন অস্ত্র ও খুচরা যন্ত্রাংশ ইরানে পাঠানোর অনুমতি দিতে গোপনে সিদ্ধান্ত নেয়। লেবাননে আটক মার্কিন জিম্মিদের মুক্ত করতে এবং ইরান সরকারের কিছু অংশে নিজেদের প্রভাব তৈরি করতে রিগ্যান প্রশাসন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিআইএর অবমুক্ত করা গোপন নথিতে এর সত্যতা পাওয়া যায়।

কিন্তু যুদ্ধে শুরুর ধাক্কা সামলে ইরান ঘুরে দাঁড়ালে নড়েচড়ে বসে যুক্তরাষ্ট্র ও তার আরব মিত্ররা। ইরাকের পরাজয় ঠেকাতে এগিয়ে আসতে রিগ্যান প্রশাসনকে প্রভাবিত করে সৌদি আরব।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে ১৯৮৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিআইএ গোপনে ইরাককে বিস্তারিত গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্পর্শকাতর স্যাটেলাইট নজরদারি থেকে প্রাপ্ত তথ্যও ছিল। এসব তথ্য দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল ইরানের তেল স্থাপনা এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে বোমা হামলায় ইরাককে সহায়তা করা। ১৯৮৮ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা মেনে আল-ফাও উপদ্বীপ দখল করে নেয় ইরাকি সেনাবাহিনী। এটি এই যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনকারী ছিল।

১৯৮৮ সালের ২০ আগস্ট যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এ যুদ্ধের অবসান ঘটে। এর দুই মাস আগে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস ভিনসেনেস ইরান এয়ারের একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ভূপাতিত করে। এতে ওই উড়োজাহাজের ২৯০ জন আরোহী নিহত হন। এ ঘটনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। এমনকি এই যুদ্ধজাহাজের ক্যাপ্টেনকে একটি পদকও দিয়েছিল।

কুয়েতে হামলা

ইরাক ও কুয়েতের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে কয়েক দশক ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। তবে আশির দশকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় দুই দেশ কাছাকাছি আসে। আট বছর ধরে চলা এ যুদ্ধের সময় বাগদাদকে অস্ত্রশস্ত্র কিনতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার দিয়েছিল কুয়েত। স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধের পর ধারের ওই অর্থ শোধ করার কথা ছিল ইরাকের। কিন্তু সেই সহায়তাই যেন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল কুয়েতের জন্য।

১৯৯০ সালের ২০ জুলাই থেকে কুয়েত ঘিরে সেনা মোতায়েন শুরু করে ইরাক। পারস্য উপসাগর ঘিরে তখন তুমুল উত্তেজনা। পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে এসেছিল প্রতিবেশী মিসর ও সৌদি আরব। তবে কিছুতেই কাজ হয়নি।

কুয়েত থেকে ইরাক পিছু হটার পর মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের ব্যবসাও রমরমা হয়েছিল। যুদ্ধের পর উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থা বা জিসিসি দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কেনা শুরু করে।

২ আগস্ট বেলা দুইটার দিকে বিপুল পরিমাণ সেনা নিয়ে কুয়েতে হামলা শুরু করে সাদ্দাম হোসেনের বাহিনী। ১৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশটি তারা দখল করে নেয়। কিন্তু এই দখলদারত্ব সাদ্দাম ও ইরাকের করুণ পরিণতির সূচনা করেছিল।

কুয়েতে ইরাকের হামলার পর এর তীব্র নিন্দা জানায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ইরাক একপ্রকার একঘরে হয়ে পড়ে। হামলার চার দিন পর ৬ আগস্ট কুয়েত থেকে অবিলম্বে ও বিনা শর্তে ইরাকি সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে। একই সঙ্গে বাগদাদের ওপর অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

জাতিসংঘের এ আহ্বান আমলে নেয়নি ইরাক। তখন ১৯৯১ সালের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে সেনা না সরালে ‘যেকোনো উপায়ে’ বাগদাদকে বাধ্য করার জন্য একটি প্রস্তাব পাস হয় নিরাপত্তা পরিষদে।

ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সহায়তা পাওয়া সাদ্দাম মনে করেছিলেন, কুয়েতে ইরাকের আগ্রাসন এড়িয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, ওই যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাঁর প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে।

জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা না মানলে ইরাককে শায়েস্তা করার জন্য তৎপরতা শুরু করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। সৌদি আরবে বিপুল পরিমাণ মার্কিন সেনা পাঠান তিনি। সাদ্দাম বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি সামরিক জোটও গড়ে তোলেন।

তবে সাদ্দাম হোসেন একগুঁয়েমি করে ১৯৯১ সালের ১৫ জানুয়ারিতেও কুয়েতে সেনা মোতায়েন করে রাখেন। এর এক দিন পরই ১৭ জানুয়ারি ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ নামে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী। কুয়েত ও ইরাকের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে ব্যাপক বোমা হামলা চালানো হয়। ৪৩ দিন ধরে চলে এই অভিযান। শেষ ১০০ ঘণ্টা ধরে চালানো হয় স্থল হামলা। শেষ পর্যন্ত ২৭ ফেব্রুয়ারি কুয়েত থেকে পিছু হটে ইরাকি বাহিনী।

প্রায় ২৫ বছরের শাসনামলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে সরব ছিলেন সাদ্দাম। এ জন্য আরব বিশ্বের পাশাপাশি গোটা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে জনপ্রিয়তা পান তিনি। ১৯৯১ সালের ১৮ জানুয়ারি ইসরায়েলে কয়েকটি স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরাক। তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিবে গিয়ে পড়ে।

জেরুজালেমের বাসিন্দা ৭২ বছর বয়সী মানাল মুস্তাফা আল-জাজিরাকে বলেন, ‘কোনো আরব নেতা যা করতে পারেননি, সাদ্দাম হোসেন সেটা করে দেখিয়েছেন। এ জন্য আমি তাঁকে সব সময় মনে রাখব।’

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পোক্ত হয়

ইরাক কুয়েতে হামলার পর সৌদি আরবসহ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশের আহ্বানে যুদ্ধের ময়দানে নেমেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে এ অঞ্চল ঘিরে ওয়াশিংটনেরও নিজস্ব কিছু স্বার্থ ছিল। প্রেসিডেন্ট বুশ চাচ্ছিলেন, এই সুযোগে উপসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি গেড়ে পরাশক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান আরও পোক্ত করতে।

কুয়েত থেকে ইরাক পিছু হটার পর মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের ব্যবসাও রমরমা হয়েছিল। যুদ্ধের পর উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থা বা জিসিসি দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কেনা শুরু করে।

এ ছাড়া সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইনসহ আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন দেশে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলে মার্কিন বাহিনী। সর্বোপরি, ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের শক্তপোক্ত আস্তানা গড়ে তোলে যুক্তরাষ্ট্র।

ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে—এমন অজুহাত তুলে ২০০৩ সালে সাদ্দাম সরকারের বিরুদ্ধেই ইরাকে আবার হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এতে দেশটি তছনছ হয়ে যায়। ক্ষমতাচ্যুত হন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম। আত্মগোপনে চলে যান তিনি। ২০০৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর জন্মশহর তিকরিতের পাশে একটি সুড়ঙ্গ থেকে মার্কিন সেনারা সাদ্দামকে পাকড়াও করেন।

সাদ্দামকে আটক করা সেনারা জানান, সুড়ঙ্গের ভেতরে ছোট্ট একটি কক্ষে ছিলেন তিনি। ওই কক্ষে পাশাপাশি দুটি বিছানা পাতা ছিল। ছোট্ট একটি ফ্রিজ ছিল। তাতে ছিল কয়েক ক্যান লেমনেড, একটি হটডগের প্যাকেট আর চকলেটের একটি খোলা প্যাকেট। কক্ষের মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল নতুন কেনা কয়েক পাটি জুতা।

২০০৫ সালের অক্টোবরে সাদ্দামের বিচার শুরু হয়। চলে টানা ৯ মাস। তাঁকে ১৯৮২ সালে ইরাকের দুজাইল গ্রামে শিয়া সম্প্রদায়ের ১৪৮ জনকে হত্যার অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়।

২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর পবিত্র ঈদুল আজহার দিন রাজধানী বাগদাদে সাদ্দামের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর সাদ্দামের মরদেহ বাগদাদের সুরক্ষিত ‘গ্রিন জোন’ এলাকায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বাসার কাছে সড়কে ফেলে রাখা হয়েছিল বলে পরে এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন ইরাকের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-খাদিমি। একসময়কার প্রতাপশালী এই প্রেসিডেন্টের এমন নির্মম পরিণতির সাক্ষী হয় বিশ্ব।

তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, কাউন্টার পাঞ্চ, রয়টার্স, আল-জাজিরা