ফিলিস্তিনের গাজায় টানা দুই বছর ধরে ইসরায়েলের নৃশংসতার পর অবশেষে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, উপত্যকাটির নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত সেনা সরিয়ে নিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। যুদ্ধবিরতির খবরে বিধ্বস্ত বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা।
মিসরের পর্যটন শহর শারম আল শেখে গত বুধবার হামাস ও ইসরায়েল এই যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। দীর্ঘ বৈঠকের শেষে গতকাল শুক্রবার ভোরে চুক্তিটির অনুমোদন দেয় ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা। পরে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, স্থানীয় সময় গতকাল দুপুর (বাংলাদেশ সময় বেলা তিনটা) থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজার নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর অবস্থান সরিয়ে নেবে ইসরায়েল। আর ৭২ ঘণ্টা-অর্থাৎ সোমবার দুপুর নাগাদ গাজায় এখনো বন্দী থাকা জীবিত সব জিম্মি ইসরায়েলকে ফিরিয়ে দেবে হামাস। এরপর ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
গাজায় সংঘাত বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি যে ২০ দফা ‘শান্তি পরিকল্পনা’ ঘোষণা করেছিলেন, তার প্রথম ধাপ বলা হচ্ছে এই যুদ্ধবিরতিকে। ওই পরিকল্পনা নিয়ে সোমবার থেকে মিসরে হামাস ও ইসরায়েলের পরোক্ষ আলোচনা চলছিল। আলোচনায় যোগ দিয়েছিল ফিলিস্তিনি সংগঠন ইসলামিক জিহাদ ও পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনও (পিএলএফপি)।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় টানা নৃশংসতা চালায় ইসরায়েল। এর মধ্যে মাত্র দুই মাসের কিছুটা বেশি সময় যুদ্ধবিরতি ছিল। বাকি সময়ে উপত্যকাটিতে নির্বিচার হামলা চালিয়ে ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। আহত প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ। একে জাতিগত নিধন বলে গত মাসে জাতিসংঘের একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
হোয়াইট হাউসের প্রকাশিত একটি মানচিত্রে দেখা যায়, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার অধীনে তিন ধাপে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে। গত দুই বছরে উপত্যকার ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা দখল করে নেয় ইসরায়েলি বাহিনী। যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে সেনাদের অবস্থান সরিয়ে নিলে ৫৩ শতাংশ এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আর দ্বিতীয় ধাপে নিয়ন্ত্রণে থাকবে ৪০ শতাংশ এলাকা।
শেষ ধাপে সেনাদের অবস্থান সরিয়ে নিলে গাজা-ইসরায়েল সীমান্ত বরাবর ১৫ শতাংশ এলাকা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ওই এলাকায় ‘নিরাপত্তা গণ্ডি’ তৈরি করা হবে। হুমকি পুরোপুরি কেটে না যাওয়া পর্যন্ত সেখানে ইসরায়েলি সেনারা অবস্থান করবেন। তবে এই হুমকির কথা বলে সেনারা কত দিন থাকবেন, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
যুদ্ধবিরতির পর গতকাল গাজার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রথম ধাপে ইসরায়েলি সেনাদের অবস্থান সরিয়ে নিতে দেখা যায়। উপত্যকার দক্ষিণে খান ইউনিস, মধ্যাঞ্চলে নুসেইরাত শরণার্থীশিবির এবং উত্তরে গাজা নগরীর ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল থেকে সেনা ও ট্যাংকগুলো পূর্ব দিকে সরে যাচ্ছিল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল হামাস। এরপর সেদিন থেকেই গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। তখন ইসরায়েল থেকে প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস। ধাপে ধাপে এই জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার পর এখনো উপত্যকাটিতে ৪৮ জন রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা ইসরায়েলের।
চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জীবিত ২০ জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে হামাসকে। তবে মৃত জিম্মিদের মরদেহ কবে নাগাদ হামাস ফেরত দিতে পারবে, তা পরিষ্কার নয়। ইসরায়েলি গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা গেছে, জীবিত বা মৃত জিম্মিদের ফেরত নেওয়ার সময় আগের মতো এবার আর কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে না। গণমাধ্যমকেও এ থেকে দূরে রাখা হবে।
জিম্মিদের ফেরত দেওয়ার পর যে ১ হাজার ৯৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হবে, তাঁদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ইসরায়েল। তাঁদের মধ্যে ২৫০ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত। সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, এই ২৫০ জনের মধ্যে ১৫৯ জন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাসীন দল ফাতাহর, ৬৩ জন হামাসের, ১৬ জন ইসলামিক জিহাদের এবং ১২ জন পিএফএলপির সদস্য।
গাজায় দুই বছর ধরে ইসরায়েলি নৃশংসতার মুখে একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার প্রায় সবাইকে। এর মধ্যে গত আগস্টে গাজা নগরীতে ইসরায়েলের স্থল অভিযান শুরুর পর পালিয়েছিলেন ৭ লাখ ফিলিস্তিনি। এখন যুদ্ধবিরতি ও ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের খবরে অনেকে আবার গাজা নগরীসহ উত্তরের এলাকাগুলোয় ফেরা শুরু করেছেন।
গতকাল মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থীশিবির থেকে ফিলিস্তিনিরা গাজা নগরীর দিকে ফিরছিলেন। ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাঁদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দেখা যায়। মেহেদি সাকলা নামের এক ফিলিস্তিনি বলেন, ‘জানি সব বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। তবু ফিরতে পেরে আমরা খুশি। পালিয়ে বেড়াতে গিয়ে দুই বছর ধরে আমাদের কম ভুগতে হয়নি।’
গাজা কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, দুই বছরে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজায় ৪ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি বা ৯২ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। স্কুল ধ্বংস হয়েছে ৫১৮টি। ফলে শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষার্থী। ৬৫৪টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর ইসরায়েলের হামলার কারণে গাজার মাত্র দেড় শতাংশ কৃষিজমি চাষাবাদের যোগ্য রয়েছে।
এদিকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ইসরায়েলের মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পরও গতকাল গাজার আকাশে দেখা গেছে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার। দক্ষিণ গাজায় ট্যাংক ও কামানের গোলার শব্দ পাওয়া গেছে। মধ্য গাজায় গোলাগুলির শব্দের কারণে অনেক ফিলিস্তিনিই উত্তরের দিকে নিজেদের ঘরবাড়িতে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন।
ইসরায়েলের আগ্রাসনের শুরুর দিকে অনেক ফিলিস্তিনি গাজা ছেড়ে মিসরে চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের দক্ষিণ গাজার রাফা ক্রসিং দিয়ে আবার প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলের সম্প্রচারমাধ্যম আর্মি রেডিও। তাদের তথ্য অনুযায়ী, চুক্তির আওতায় গাজায় প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক করে ত্রাণ প্রবেশের অনুমতিও দেবে ইসরায়েল।
গতকাল পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, গাজায় সরবরাহের জন্য ১ লাখ ৭০ হাজার টন ত্রাণ মিসর ও জর্ডানে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
গাজায় ইসরায়েলের হামলা শুরুর আগে দিনে প্রায় ৫০০ ট্রাক ত্রাণ প্রবেশ করত। তবে দুই বছর ধরে উপত্যকাটি অবরোধ করে রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। খুবই সামান্য পরিমাণ ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে তারা। এতে গাজায় তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দুই বছরে অনাহারে গাজায় ৪৬০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৫৪টি শিশু।
গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণে একটি টাস্কফোর্সের আওতায় ইসরায়েলে ২০০ সেনা পাঠানো হবে। এর দায়িত্বে থাকবে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ড। এই টাস্কফোর্সে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাতার, তুরস্কসহ বিভিন্ন আরব ও মুসলিম দেশের সেনারা থাকবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই টাস্কফোর্সের আওতায় কোনো মার্কিন সেনা গাজায় প্রবেশ করবেন না। যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি তাঁরা গাজায় ত্রাণ প্রবেশের বিষয়েও সহায়তা করবেন। আর বন্দিবিনিময় শেষ হলে গাজায় নিরাপত্তার জন্য একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠন নিয়ে কাজ করা হবে। তবে এ বিষয়ে এগোনো হবে হামাস ও ইসরায়েলের ঐকমত্যের পর, যুদ্ধবিরতির পরের ধাপে।
গাজায় সংঘাত ঘিরে গত দুই বছরে অশান্ত হয়ে পড়ে মধ্যপ্রাচ্য। এ সময়ে ইসরায়েল গাজা ছাড়াও হামলা চালিয়েছে ইরান, লেবানন, ইয়েমেন ও সর্বশেষ কাতারে। এই সংঘাত ঘিরে মিত্র অনেক দেশ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েল যখন বৈশ্বিক অঙ্গনে ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়ছে, তখন গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন ট্রাম্প।
সেই পরিকল্পনার প্রথম ধাপ অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও এতে আপত্তি আছে ইসরায়েল সরকারে নেতানিয়াহুর উগ্র ডানপন্থী জোটসঙ্গীদের। যেমন গতকাল জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির হুমকি দিয়ে বলেছেন, হামাসকে পুরোপুরি নির্মূল না করা হলে জোট থেকে বেরিয়ে সরকার পতন ঘটাবেন তিনি। ফলে রাজনৈতিকভাবে বেশ সংকটময় পরিস্থিতিতে রয়েছেন নেতানিয়াহু।
বিপত্তি আরও আছে। গতকাল হামাসনিয়ন্ত্রিত গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, গাজার যেসব এলাকা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে, সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হবে। এই বাহিনীতে হামাসের সদস্য থাকবেন কি না, তা বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়নি। বলা হচ্ছে, হামাস এমন পদক্ষেপ নিলে সেটি ইসরায়েল উসকানি হিসেবে দেখতে পারে।
যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের পরই ‘আসল চ্যালেঞ্জগুলো’ শুরু হবে বলে মনে করেন প্যালেস্টেনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশনের নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ও ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিদ হানান আশরাউই। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে গাজা পুনর্গঠন ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মতো বিষয়গুলো।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে হানান আশরাউই লেখেন, যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের পর ফিলিস্তিনিদের ঐক্য ও ইসরায়েলি দখলদারি বন্ধের দিকে নজর দিতে হবে। কারণ, এখনো পশ্চিম তীরকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। গাজায় হামলা বন্ধ রেখে যদি পশ্চিম তীরে দখলদারি চালানো হয়, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না। প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠার আগে সমস্যার মূল কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে।