গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত এক ব্যক্তির মৃতদেহ ঘিরে স্বজনদের আহাজারি। নাসের হাসপাতাল, খান ইউনিস। ২৮ অক্টোবর, ২০২৫
গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত এক ব্যক্তির মৃতদেহ ঘিরে স্বজনদের আহাজারি। নাসের হাসপাতাল, খান ইউনিস। ২৮ অক্টোবর, ২০২৫

গাজায় ইসরায়েলের ব্যাপক হামলা, আতঙ্ক-বিশৃঙ্খলা, নিহত বেড়ে ৬৩

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গতকাল মঙ্গলবার গাজা উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে অন্তত ৬৩ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, নিহতদের মধ্যে ২৪ টি শিশু। প্রাথমিকভাবে পাওয়া খবরে দুজন নিহত হওয়ার কথা জানা গিয়েছিল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দক্ষিণ রাফাহ এলাকায় গোলাগুলির ঘটনায় এক ইসরায়েলি সেনা আহত হওয়ার পর জোরালো হামলা চালানোর নির্দেশ দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ১০ অক্টোবর গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর এসব হামলাকে এই উপত্যকায় সবচেয়ে বড় সহিংসতার ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

হামাসের সামরিক শাখা কাসাম ব্রিগেড ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি ভাঙার অভিযোগ এনে বলেছে, নিখোঁজ এক ইসরায়েলি জিম্মির মরদেহ হস্তান্তর করার পরিকল্পনা তারা আপাতত স্থগিত রাখবে।

এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি সতর্ক করে আরও বলেছে, ইসরায়েলের নতুন হামলা জিম্মিদের মরদেহ উদ্ধারে শুরু করা তল্লাশি ও খনন কার্যক্রম ব্যাহত করবে। এ কারণে গাজায় থাকা আরও ১৩ জিম্মির মরদেহ উদ্ধারে বিলম্ব হবে।

হামাস এক বিবৃতিতে সতর্ক করে বলেছে, ইসরায়েলের নতুন হামলা জিম্মিদের মরদেহ উদ্ধারে শুরু করা তল্লাশি ও খনন কার্যক্রম ব্যাহত করবে। এ কারণে গাজায় থাকা আরও ১৩ জিম্মির মরদেহ উদ্ধারে বিলম্ব হবে।

ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল হিলে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, উভয় পক্ষের লঙ্ঘনের অভিযোগ সত্ত্বেও যুদ্ধবিরতি এখনো কার্যকর আছে।

‘ছোটখাটো সংঘর্ষ হতেই পারে,’ সাংবাদিকদের বলেন জেডি ভ্যান্স। ‘আমরা জানি, হামাস বা গাজার ভেতরে অন্য কেউ একজন ইসরায়েলি সেনাকে আক্রমণ করেছে। ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া আশা করাই যায়। তবু প্রেসিডেন্টের (ডোনাল্ড ট্রাম্প) শান্তিচুক্তি টিকে থাকবে বলে আমি মনে করি।’

হামাস অবশ্য রাফাহর ওই হামলায় নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

‘আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খলা’

গাজার চিকিৎসা সূত্রগুলো আল–জাজিরাকে জানায়, গতকালের হামলায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে উত্তর গাজা সিটির সাবরা এলাকার একটি আবাসিক ভবনের চারজন ও দক্ষিণের খান ইউনিসের পাঁচজন ছিলেন।

সূত্রগুলো আরও জানায়, হামলায় অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন।

ছোটখাটো সংঘর্ষ হতেই পারে। আমরা জানি, হামাস বা গাজার ভেতরে অন্য কেউ একজন ইসরায়েলি সেনাকে আক্রমণ করেছে। ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া আশা করাই যায়। তবু প্রেসিডেন্টের (ডোনাল্ড ট্রাম্প) শান্তিচুক্তি টিকে থাকবে বলে আমি মনে করি।
জেডি ভ্যান্স, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট

আল–জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ গাজা সিটি থেকে জানান, আল–শিফা হাসপাতালের পেছনে একটি ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে। গাজার আকাশজুড়ে ইসরায়েলি ড্রোনের তৎপরতা ছিল ব্যাপক।

হানি মাহমুদ আরও বলেন, ‘ওই ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বড় বিস্ফোরণ হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। আমরা এখান থেকে ২০ মিনিটের দূরত্বে ছিলাম। তবু শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হামলায় হাসপাতালের রোগী ও কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।’

আর হামলার পর পার্শ্ববর্তী সাবরা এলাকায় ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়া ফিলিস্তিনিদের উদ্ধারে সারা রাত চলেছে তল্লাশি ও খোঁড়াখুঁড়ি। উদ্ধারকর্মীরা খালি হাতে ধ্বংসাবশেষ সরানোর চেষ্টা করেন।

হামলায় ৫০ জনের মতো আহতও হয়েছেন। আল-জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ গাজা সিটি থেকে জানান, আল-শিফা হাসপাতালের পেছনে একটি ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে। গাজার আকাশজুড়ে ইসরায়েলি ড্রোনের তৎপরতা ছিল ব্যাপক।

চিকিৎসকেরা জানান, আহত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। ঘটনাস্থলে থাকা সিভিল ডিফেন্সের কর্মী ইব্রাহিম আবু রিশ বলেন, ‘এটি যুদ্ধবিরতির স্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা হতাহত কয়েকজনকে পেয়েছি। যতজনকে সম্ভব উদ্ধার করার জন্য আমরা হাসপাতাল ভবন তল্লাশি করছি।’

হামলার আগে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর থেকে জানানো হয়, সেনাবাহিনীকে গাজায় ‘শক্তিশালী হামলা চালানোর’ নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। হামলার সুনির্দিষ্ট কারণ জানায়নি এ দপ্তর।

তবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ পরে এক বিবৃতিতে বলেন, হামাস রাফাহয় সেনাদের ওপর হামলার ঘটনায় দায়ী এবং এর ‘চড়া মাশুল’ দিতে হবে।

দুই মার্কিন কর্মকর্তার বরাতে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস জানায়, ইসরায়েল হামলার আগে ওয়াশিংটনকে এ বিষয়ে জানিয়েছিল।

গাজার সরকারি গণমাধ্যম দপ্তর জানায়, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় এ উপত্যকায় অন্তত ৯৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ত্রাণ সহায়তাও কঠোরভাবে সীমিত রাখা হয়েছে।

‘চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন’

হামাস অবিলম্বে ইসরায়েলের হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে বার্তা আদান–প্রদানের মাধ্যম টেলিগ্রামে তারা বলেছে, গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলা ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তত্ত্বাবধানে শারম আল–শেখে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রকাশ্য লঙ্ঘন।’

(আল শিফা হাসপাতালের পেছনে) ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বড় বিস্ফোরণ হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। আমরা এখান থেকে ২০ মিনিটের দূরত্বে ছিলাম। তবু শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হামলায় হাসপাতালের রোগী ও কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।
হানি মাহমুদ, গাজায় আল–জাজিরার সংবাদদাতা

হামাস আরও জানায়, তারা চুক্তির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ রয়েছে এবং ইসরায়েলের মিথ্যা অভিযোগ বন্ধ করা উচিত।

হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য সুহাইল আল–হিন্দি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা চুক্তির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। ইসরায়েলকে বুঝতে হবে। তারা আমাদের অসত্যভাবে অভিযুক্ত করা বন্ধ করুক।’ জিম্মিদের মরদেহ উদ্ধারে তাঁদের সংগঠন বড় ধরনের সমস্যার মুখে পড়েছে বলেও জানান তিনি।

সুহাইল বলেন, ‘আমরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করছি, জিম্মিদের মরদেহ উদ্ধারের জন্য। অবশিষ্ট জিম্মিদের মরদেহ উদ্ধারে যে দেরি হচ্ছে, তার পুরো দায় ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর।’

গতকাল কাসাম ব্রিগেড জানায়, তারা দুই ইসরায়েলি জিম্মি—আমিরাম কুপার ও সাহার বারুচের মরদেহ উদ্ধার করেছে। একই সঙ্গে তারা এদিন মরদেহ হস্তান্তরের পূর্বনির্ধারিত প্রক্রিয়া স্থগিত করার ঘোষণা দেয়।