ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) বর্তমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাহমুদ আব্বাস। নিজের উত্তরসূরি হিসেবে তিনি রাওহি ফাত্তৌহকে বেছে নিয়েছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে আব্বাস যদি কখনো দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন, তখন পিএর হাল ধরবেন রাওহি ফাত্তৌহ।
মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন ঘিরে চলছে চরম সংকট। এক বছরের বেশি সময় ধরে গাজা উপত্যকায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে এখন পর্যন্ত ৪৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত ও অভুক্ত অসংখ্য মানুষ। এমন পরিস্থিতে পিএর প্রধান হিসেবে আব্বাসের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে।
মাহমুদ আব্বাসের বয়স এখন ৮৯ বছর। ২০০৫ সালে তিনি পিএর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর এক বছর আগেই মৃত্যু হয় সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের। পিএর পাশপাশি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) নেতৃত্বও দিচ্ছেন আব্বাস।
এমন পরিস্থিতিতে যে প্রশ্ন সামনে আসছে, সেটি হলো এখন কেন নিজের উত্তরসূরি বেছে নিলেন মাহমুদ আব্বাস? কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর উত্তরসূরি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রধানের দায়িত্ব নেবেন, তা নিয়েও আগ্রহ দেখা দিয়েছে। জেনে নেওয়া যাক এসব প্রশ্নের উত্তর।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ যাত্রা শুরু করে ৩১ বছর আগে—১৯৯৩ সালে। সে বছর অসলো চুক্তি স্বাক্ষর করেন ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইতজাক রবিন। ওই চুক্তির আওতায় ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে গঠন করা হয় পিএ।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ যাত্রা শুরু করে ৩১ বছর আগে—১৯৯৩ সালে। সে বছর অসলো চুক্তি স্বাক্ষর করেন ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইতজাক রবিন।
পিএ গঠন করা হয়েছিল মূলত ইসরায়েলের দখল করা পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর ও গাজায় যেসব ফিলিস্তিনি বসবাস করছেন, তাঁদের জন্য শিক্ষা, নিরাপত্তা, পানি ও বিদ্যুতের মতো মৌলিক বিষয়গুলো দেখভাল করতে। তবে তারা কতটুকু সফল হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
অসলো চুক্তিতে পশ্চিম তীরকে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’—তিনটি এলাকায় ভাগ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ‘এ’ এলাকার নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়েছিল পিএকে। আর ‘বি’ এলাকায় শুধু প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ পেয়েছিল তারা। তবে পুরো পশ্চিম তীরে নিয়মিত সহিংস অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।
যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত অসলো চুক্তির একটি লক্ষ্য ছিল ১৯৯৯ সাল নাগাদ একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। পশ্চিম তীর ও গাজা নিয়ে গঠন করা ওই রাষ্ট্রের রাজধানী হওয়ার কথা ছিল পূর্ব জেরুজালেম। তবে তা আলোর মুখ দেখেনি।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে অর্থাভাবে জর্জরিত পিএকে টিকে থাকার জন্য ছয় কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সৌদি আরব।
চুক্তি স্বাক্ষরের এক বছরের মধ্যে পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপন শুরু করে ইসরায়েল। পরে ১৯৯৫ সালে প্রধানমন্ত্রী ইতজাক রবিনকে হত্যা করেন ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী একজন নাগরিক। এর মধ্য দিয়ে পিএর কাছে ইসরায়েলের দখল করা অঞ্চলগুলো হস্তান্তরের সম্ভাবনাও মিইয়ে আসে।
ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বে ছিল পিএ। তবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার পরও মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে বহাল থাকে পিএ। আর এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে আব্বাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৯ সালে। তবে এখনো তিনি ক্ষমতায় রয়েছেন।
২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে পিএর নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পায় হামাস। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের ভাষ্য, ইসরায়েল স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি না দিলে তারাও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে না।
তখন ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড শাসনের জন্য হামাস ও বিরোধী দল ফাতাহর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। তবে তা সফল হয়নি। বরং দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। একপর্যায়ে গাজা থেকে ফাতাহকে বিতাড়িত করে হামাস। ফাতাহরও নেতৃত্বে রয়েছেন মাহমুদ আব্বাস।
গাজা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর শুধু ইসরায়েলের দখল করা পশ্চিম তীরে পিএ পরিচালনা করছে ফাতাহ। তবে সেখানে ইসরায়েলের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারেনি। এতে করে সংগঠনটির জনপ্রিয়তা কমেছে। ফিলিস্তিনে আর কোনো পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও করতে দেননি আব্বাস। বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন হলে হামাসের কাছে পরাজিত হওয়ার ভয় পান তিনি।
যেমন ২০২১ সালের মে মাসে ফিলিস্তিনিরা ভোট দিতে পারবেন বলে আশার আলো দেখা দিয়েছিল। তবে ওই নির্বাচন স্থগিত করেন আব্বাস। এর দায় তিনি চাপান ইসরায়েলের ওপর। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন হলে দখল হওয়া পূর্ব জেরুজালেমে ভোট গ্রহণ করতে দেবে না ইসরায়েল সরকার।
কয়েক দিন আগে রাওহি ফাত্তৌহকে নিজের উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিয়েছেন আব্বাস। ফাত্তৌহি ফিলিস্তিনি আইন পরিষদের সাবেক স্পিকার। বর্তমানে তিনি ফিলিস্তিনি জাতীয় পরিষদের স্পিকার। পিএলওর আইন প্রণয়নকারী সংস্থা এই জাতীয় পরিষদ। ফাতাহর কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
আব্বাস যদি কোনো কারণে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, তখন ফাত্তৌহ পিএর প্রেসিডেন্টের পদে বসবেন। পরবর্তী নির্বাচনের আগপর্যন্ত ৯০ দিনের জন্য এ দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। ২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পরও একই দায়িত্ব পালন করেছিলেন ফাত্তৌহি।
বেলজিয়ামের ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ফিলিস্তিনি রাজনীতিবিশেষজ্ঞ তাহানি মুস্তাফা বলেন, ফাত্তৌহ ক্ষমতালোভী নন। তাঁর কোনো রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও নেই। পিএর প্রধানের পদে নতুন কেউ নির্বাচিত হলে তিনি এ পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন।
যতটা জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলোর চাপে নিজের উত্তরসূরি বেছে নিয়েছেন মাহমুদ আব্বাস। একটি দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের জন্য চাপ দিতে গত সেপ্টেম্বরে বেশ কিছু আরব ও ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সৌদি আরব। রিয়াদের লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত বন্ধ করা।
পরে সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে অর্থাভাবে জর্জরিত পিএকে টিকে থাকার জন্য ছয় কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সৌদি আরব। বিশেষজ্ঞ তাহানি মুস্তাফা বলেন, ওই অর্থের চূড়ান্ত কিস্তি এক কোটি ডলার দেওয়ার বিনিময়ে আব্বাসকে একজন উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার শর্ত দিয়েছিল রিয়াদ।
অসলো চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে পিএর হয়ে কর ও রাজস্ব আদায় করে ইসরায়েল। তবে এখন পর্যন্ত আদায় করা ১৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের কর ও রাজস্ব আটকে রেখেছে দেশটি। এতে তীব্র অর্থ–সংকটে রয়েছে পিএ।
উত্তরটা হলো, হ্যাঁ আছে। আর তা শুধু আব্বাসের নিজ বলয়ের মধ্যে।
আব্বাস এখনো ফাতাহর প্রধান। এটি ফিলিস্তিনের সবচেয়ে পুরোনো ও বড় রাজনৈতিক দল। এরই মধ্যে ফাতাহর কেন্দ্রীয় কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে মাহমুদ আল-আলোউলকে বেছে নিয়েছেন তিনি। আব্বাসের পর দলের নেতৃত্ব দেবেন আলোউল।
আরও বড় বিষয় হলো আব্বাস পিএলওর প্রধান। স্বাধীনতাকামী এই সংগঠন পিএর চেয়ে শক্তিশালী। তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে দেনদরবার করে এবং তাঁদের পক্ষে নানা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তাহানি মুস্তাফার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পিএলওর সেক্রেটারি জেনারেল হুসেইন আল-শেখকে সংগঠনের পরবর্তী প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন আব্বাস।