পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের পাশের শহর রাওয়ালপিন্ডিতে বেড়ে উঠেছেন মাহনূর ওমার। এখনো তাঁর মনে পড়ে, মাসিকের সময় স্কুলে গিয়ে কতটা লজ্জা ও উদ্বেগে পড়তে হতো তাঁকে। স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে টয়লেটে যাওয়া ছিল এমন একটি গোপন কাজ, যেন কোনো অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করছেন।
মাহনূর ওমার বলেন, ‘আমি জামার হাতার নিচে স্যানিটারি ন্যাপকিন লুকিয়ে রাখতাম। মনে হতো যেন টয়লেটে কোনো মাদকদ্রব্য নিয়ে যাচ্ছি। মাহনূর মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তাঁর বাবা একজন ব্যবসায়ী আর মা গৃহিণী।’ মাহনূর বলেন, ‘কেউ এ বিষয়ে কথা বললে শিক্ষকেরা তাকে চুপ করিয়ে দিত।’ একবার এক সহপাঠী তাঁকে বলেছিল, তার মা স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনা ‘অর্থের অপচয়’ বলে মনে করেন।
মাহনূর ১৬ বছর বয়সে প্রথম নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা ইসলামাবাদের নিম্ন আয়ের এলাকায় নারীদের জন্য ছোট ‘ডিগনিটি কিট’ তৈরি করতে শুরু করেন।
এ কথা শোনার পর বিষয়টি মাহনূরকে নাড়া দেয়। তিনি বলেন, ‘যদি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এভাবে চিন্তা করে, ভাবুন তো অন্যদের কাছে এই পণ্যগুলো কতটা দুষ্প্রাপ্য।’
মাহনূরের বয়স এখন ২৫ বছর। একসময়ের এই সচেতন স্কুলছাত্রী পাকিস্তানের নারীদের মাসিককালীন স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে নতুন করে গড়ে তোলার লড়াই করতে গিয়ে জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন।
সমালোচকদের মতে, পাকিস্তান এমন একটি দেশ, যেখানে নারীকে কেবল নারী হওয়ার কারণে হেয় হতে হয়। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সামাজিক প্রথা আরও জটিল ও তীব্র হচ্ছে।
পেশায় আইনজীবী মাহনূর গত সেপ্টেম্বরে লাহোর উচ্চ আদালতে এমন একটি কর–ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে পিটিশন দায়ের করেন, যা তিনিসহ আরও অনেকের কাছে ‘মাসিক কর’ নামে পরিচিত। পাকিস্তান সরকার দেশটির ১০ কোটির বেশি নারীর ওপর এই কর আরোপ করেছে।
পাকিস্তানি সরকার ১৯৯০ সালের সেলস ট্যাক্স আইনের অধীনে দীর্ঘদিন ধরে দেশে উৎপাদিত স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর ১৮ শতাংশ বিক্রয় কর আরোপ করছে। এ ছাড়া আমদানি করা ন্যাপকিনের পাশাপাশি সেগুলো তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ওপর ২৫ শতাংশ কাস্টমস শুল্ক আরোপ করা হয়।
ইউনিসেফ পাকিস্তান বলছে, অন্যান্য স্থানীয় কর যোগ করলে কার্যত স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর মোট কর দাঁড়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ।
মাহনূর ওমারের ওই পিটিশনে বলা হয়েছে, নারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলা এসব কর বৈষম্যমূলক। এর মধ্য দিয়ে সংবিধানের এমন কিছু ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে, যেগুলো সাম্য, মর্যাদা, শোষণের অবসান ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।
পাকিস্তানে অধিকাংশ পরিবারেই মাসিক নিয়ে কথা বলা এখনো নিষিদ্ধ। এমন অবস্থায় সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর করের কারণে নারীদের জন্য এটির প্রাপ্যতা আরও কঠিন দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন ওমারসহ অন্য আইনজীবী ও পিটিশন–সমর্থক অধিকারকর্মীরা।
স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর আরোপিত করের বিরোধীরা আশা করছেন, ওমারের পিটিশন ভারত, নেপাল ও যুক্তরাজ্যের মতো পাকিস্তান সরকারকেও ‘মাসিক কর’ বাতিল করতে বাধ্য করবে।
পাকিস্তানে বর্তমানে যেকোনো ব্র্যান্ডের এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনতে প্রায় ৪৫০ রুপি (১ ডলার ৬০ সেন্ট) খরচ হয়। যে দেশে মাসিক মাথাপিছু আয় মাত্র ১২০ ডলার, সেখানে এক প্যাকেট ন্যাপকিনের দাম নিম্ন আয়ের চার সদস্যের একটি পরিবারের ডাল–রুটি দিয়ে এক বেলা খাবারের খরচের সমান।
২০২৪ সালে ইউনিসেফ ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ওয়াটারএইডের এক গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমানে পাকিস্তানের মাত্র ১২ শতাংশ নারী বাণিজ্যিকভাবে তৈরি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। অন্যরা কাপড় ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে কাজ চালিয়ে নেন। এমনকি নিজেদের পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য অনেক সময় তাঁরা বিশুদ্ধ পানি পর্যন্ত পান না।
পাকিস্তানের দস্তক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক হিরা আমজাদ বলেন, ‘এই পিটিশন সফল হলে স্যানিটারি ন্যাপকিন সাশ্রয়ী হবে।’ দস্তক ফাউন্ডেশন একটি বেসরকারি সংস্থা। এটি লিঙ্গ সমতার প্রচার ও নারীর ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে কাজ করে।
আইনজীবী ও অধিকারকর্মীরা বলছেন, বড়সড় একটি সামাজিক পরিবর্তনের নিয়ামক হতে পারে এই পিটিশন।
আদালতে মাহনূরের এই মামলাকে ‘মাহনূর ওমার বনাম পাকিস্তান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা’ নামে নথিভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু মাহনূরের কাছে এটিকে বরং ‘নারী বনাম পাকিস্তান’ বলেই মনে হয়।
মাহনূর ওমার বলেন, নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে তাঁর কাজ করার আগ্রহ শুরু হয়েছিল খুব ছোটবেলায়। তিনি বলেন, ‘নিত্যদিন নারীর সঙ্গে ভয়াবহ দুর্ব্যবহার দেখে দেখে এই কাজ করতে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। রাস্তায়, গণমাধ্যমে কিংবা বাড়ির ভেতর নারীরা যে অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মৌখিক শোষণের শিকার হন, সেটা আমার কাছে কখনো গ্রহণযোগ্য ছিল না।’
নিজেকে এমন সহানুভূতিশীল ও বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মাহনূর সব কৃতিত্ব তাঁর মাকেই দিতে চান।
স্কুলের পাট চুকিয়ে মাহনূর পাকিস্তানের ক্রসরোড কনসালট্যান্ট নামের প্রতিষ্ঠানে লিঙ্গ ও ফৌজদারি বিচারসংক্রান্ত পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন। এ প্রতিষ্ঠানটি এনজিও ও উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে লিঙ্গ ও ফৌজদারি বিচারবিষয়ক সংস্কার নিয়ে কাজ করে। ১৯ বছর বয়সে তিনি ‘অওরাত মার্চ’ নামের একটি সংগঠনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত হন। এটি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে।
মাহনূর ১৬ বছর বয়সে প্রথম নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি ও তাঁর বন্ধুরা ইসলামাবাদের নিম্ন আয়ের এলাকায় নারীদের জন্য ছোট ‘ডিগনিটি কিট’ তৈরি শুরু করেন।
এই আইনজীবী বলেন, ‘আমরা কেকসহ নিজেদের তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবার বিক্রি করে বা নিজেদের অর্থেই তহবিল সংগ্রহ করতাম।’
সেই তহবিল দিয়ে তাঁরা নিজেদের তৈরি প্রায় ৩০০টি ডিগনিটি কিট বিতরণ করতে সক্ষম হন। প্রতিটি কিটে থাকত স্যানিটারি ন্যাপকিন, অন্তর্বাস, ব্যথানাশক ওষুধ ও টিস্যু। তবে তিনি নারীদের জন্য এর চেয়ে বেশি কিছু করতে চেয়েছিলেন।
সেই সুযোগ আসে ২০২৫ সালের শুরুতে সুপ্রিম কোর্টে প্রথমে ল’ ক্লার্ক হিসেবে কাজ শুরু করার পর। বর্তমানে মাহনূর লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে লিঙ্গ, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করছেন এবং স্নাতকোত্তর শেষে পাকিস্তানে ফিরে আবার তাঁর কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা করছেন।
কর ও সংবিধান–সংক্রান্ত আইনে বিশেষজ্ঞ আইনজীবী আহসান জাহাঙ্গীর খানের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় মাহনূরের। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রথম ‘মাসিক করের’ বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করার পরিকল্পনাটি উঠে আসে।
মাহনূর বলেন, ‘তিনি (আহসান) আমাকে এই পিটিশন দাখিল করতে ও শুধু বসে না থেকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।’
আহসান জাহাঙ্গীর খান এই মামলার সহ–আবেদনকারী। তিনি বলেন, করের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল স্যানিটারি ন্যাপকিনকে সহজলভ্যতা ও সাশ্রয়ী করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ন্যায়বিচারের ব্যাপার। তিনি আরও বলেন, ‘এটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার ওপর আরোপিত কর।’
আহসান জাহাঙ্গীর বলেন, পাকিস্তানের কর নীতিমালা সমাজের অভিজাত ব্যক্তিদের হাতে লেখা, যাঁদের বেশির ভাগই পুরুষ। তাঁরা কখনো ভাবেননি, এই কর সাধারণ নারীদের জন্য কী অর্থ বহন করে। তিনি আরও বলেন, সংবিধানে খুব স্পষ্ট করে বলা আছে, কোনো লিঙ্গের মানুষের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করা চলবে না।
স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর আরোপিত করের বিরোধীরা আশা করছেন, ওমারের পিটিশন ভারত, নেপাল ও যুক্তরাজ্যের মতো পাকিস্তান সরকারকেও ‘মাসিক কর’ বাতিল করতে বাধ্য করবে।
মাহনূর ওমারের জন্য সরকারের নীতিমালার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সহজ ছিল না। তিনি বলেন, প্রথমে তাঁর মা–বাবা চিন্তিত ছিলেন। কারণ, তাঁদের মেয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে যাচ্ছেন। তবে এখন তাঁরা মাহনূরকে নিয়ে গর্ব করেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন, কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ।
মাহনূরের কাছে এটি কেবল একটি আইনি লড়াই নয়। তিনি বলেন, ‘যখন আমি এ মামলাটি নিয়ে ভাবি, তখন মনের মধ্যে যে ছবিটি আসে, তা আদালতের কক্ষের নয়; বরং এটি ন্যায়বিচারের অনুভূতি দেয়।’