চুরি যাওয়ার ৪৫ বছর পর যমজ মেয়েদের ফিরে পেলেন মা

১৯৭৯ সালে নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষা করাতে আট মাস বয়সী যমজ মেয়েদের নিয়ে একটি সরকারি ক্লিনিকে গিয়েছিলেন চিলির মারিয়া ভেরোনিকা সোতো। ক্লিনিক থেকে সোতোকে বলা হলো, বিস্তারিত পরীক্ষার জন্য তাঁর দুই মেয়েকে আরও কিছু সময় ক্লিনিকে রাখতে হবে।

সোতোর বয়স তখন সবে ১৯। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের কথায় খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এই তরুণী মা। তবে কি মেয়েদের কোনো অসুখ ধরা পড়ল?

প্রথমে ক্লিনিক থেকে সোতোকে চিকিৎসা ও অন্যান্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে কিছুক্ষণ পরই ক্লিনিকের লোকজন দুই মেয়েকে তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, সোতো মেয়েদের ঠিকমতো খাওয়াতে পারছেন না। বারবার বলার পরও মেয়েদের আর তাঁর কাছে ফিরেয়ে দেওয়া হয়নি।

হতবাক সোতো মেয়েদের ফিরে পেতে পুলিশের কাছে যান। পুলিশ তাঁকে আদালতে যেতে বলে। মেয়েদের ফিরে পেতে শুরু হয় সোতোর এক নতুন সংগ্রাম।

সোতো তখন চিলির বিওবিও প্রদেশের উপকূলীয় শহর হুয়ালপেনে বসবাস করেন। সেখানেই তাঁর দুই মেয়ের জন্ম। চিলিতে তখন স্বৈরশাসক জেনারেল অগাস্তো পিনোশের শাসন চলছে।

আদালতে ঘুরতে ঘুরতে সোতো জানতে পারেন তাঁর দুই মেয়েকে দত্তক নিয়েছেন ইতালির এক দম্পতি। আরও পরে এই নারী জানতে পারেন, তাঁর দুই মেয়ের জন্মসনদ পর্যন্ত পাল্টে ফেলা হয়েছে। নতুন নিবন্ধন তালিকায় শিশু দুটিকে পিতৃমাতৃহীন দেখানো হয়েছে।

নীরব হয়ে যাওয়া শিশুরা

চিলির কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩ থাকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত স্বৈরশাসক পিনোশের আমলে কয়েক হাজার শিশুকে তাদের জন্মদাত্রী মায়ের কাছ থেকে চুরি করে নিয়ে দত্তক দেওয়ার নামে আদতে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ওই সব শিশুদের বেশির ভাগের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নানা দেশ। চিলিতে এসব শিশু ‘দ্য চিলড্রেন অব সাইলেন্স’ নামে পরিচিত।

ওই সব শিশুর কাউকে কাউকে তাদের হতদরিদ্র এবং আর্থিকভাবে দুর্বল মায়েদের কাছ থেকে চুরি করা হয় এবং বেআইনিভাবে দত্তক সংস্থার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। সোতোর মেয়েদের বেলায় সম্ভবত এটাই ঘটেছিল।

অনেক নবজাতককে তাদের নানা-নানি বা পরিবারের লোকজনও দিয়ে যেত। চিকিৎসক, ধর্মীয় নেতাদের যোগসাজশে মেয়ের সামাজিকভাবে অবৈধ গর্ভধারণ লুকিয়ে রাখতে তাঁরা এটা করত।

কখনো কখনো পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে অনেক শিশু শেষ পর্যন্ত দত্তক সংস্থার হাতে এসে পড়ত।

সোতো বলেন, ‘এখন তাঁরা নারীদের কথা শুনছেন। কিন্তু সে সময়ে, নারীদের কথা কেউ শুনত না। তাঁরা মায়েদের কথা শুনত না। আমরা নারীরা এখন যেভাবে নিজেদের কথা বলতে পারি, সে সময়ে এমনটা বলা যেত না।’

চলতি বছরের জুনে চিলির ইতিহাসে প্রথমবার দেশটির একজন বিচারক ঘোষণা করেন, দত্তক দেওয়ার জন্য শিশুদের চুরি করেছেন এমন অভিযোগ ওঠা পাঁচজনের বিচার তিনি করছেন।

বিচারক ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার পাশাপাশি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।

নিজের মাকে খুঁজে পাওয়া

সোতোর সঙ্গে তাঁর দুই মেয়ের দীর্ঘ পুনর্মিলন যাত্রা শুরু হয় ২০২০ সালে। হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের খুঁজে পেতে চিলির একটি এনজিওর সঙ্গে যোগাযোগ করেন সোতো। সংস্থাটি বিশ্বজুড়ে অবৈধভাবে দত্তক নেওয়া শিশুদের তাদের প্রকৃত মা–বাবার সঙ্গে পুনর্মিলন নিয়ে কাজ করে।

সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক কনস্টানজা দেল রিও বলেন, সোতো তাঁর কাছে আসার পর তিনি তাঁকে দ্রুত ডিএনএ পরীক্ষার পরামর্শ দেন। সোতো তৎক্ষণাৎ সেটা করান।

দেল রিও নিজেও অবৈধভাবে দত্তক নেওয়া শিশু ছিলেন। তিনি সোতোর ডিএনএ নমুনা যুক্তরাষ্ট্রের একটি ডিএনএ ব্যাংকে পাঠান। অনলাইনভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ‘মাই হেরিটেজ’ ডিএনএ ব্যাংকটি পরিচালনা করে।

দেল রিও বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে তিনি (সোতো) আমাদের ক্রমাগত জিজ্ঞাসা করে গেছেন, এখন কী হচ্ছে? আর আমরা তাঁকে বলে গেছি, সেতুর অন্য প্রান্তে যাঁরা আছেন, তাঁদের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে।’

অবশেষে এ বছরের শুরুতে সোতোর অপেক্ষার দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক যাত্রার অবসান হয়। এ বছরের মার্চে সোতোর দুই যমজ মেয়ের একজনের ছেলে তাঁর ডিএনএ পরীক্ষা করান এবং খুঁজে বের করেন নিজের নানিকে।

এরপর ওই ছেলে ফেসবুকের মাধ্যমে সোতোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এবং মাত্র ২০ মিনিটের চেষ্টায় নাতি-নানি পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন বলে জানান দেল রিও।

সোতো বলেন, তিনি কখনো মেয়েদের আবার ফিরে পাওয়ার আশা ছাড়েননি। তবে তিনি এটা জানতেন না, এ জন্য তাঁকে ৪৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে। ১০ সেপ্টেম্বর ইতালি থেকে দুই মেয়ে চিলি উড়ে আসেন।

মা ও দুই মেয়ের অশ্রুসিক্ত পুনর্মিলনের ক্ষণে সোতো মেয়েদের জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘মা সব সময় তোমাদের খুঁজে বেড়িয়েছে।’