
যুক্তরাজ্যের ডিউক অব সাসেক্স প্রিন্স হ্যারি বলেছেন, তিনি আবারও রাজপরিবারের সঙ্গে এক হতে চান। যুক্তরাজ্যে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা ফিরে পাওয়া সংক্রান্ত আইনি লড়াইয়ে হেরে যাওয়ায় তিনি বিধ্বস্ত। বিবিসিকে দেওয়া এক আবেগঘন সাক্ষাৎকারে রাজপরিবারের এই সদস্য এসব কথা বলেছেন।
প্রিন্স হ্যারি বলেন, ‘এই নিরাপত্তাসংক্রান্ত ব্যাপারগুলোর কারণে রাজা (হ্যারির বাবা চার্লস) আমার সঙ্গে কথা বলেন না।’ তবে তিনি আর লড়াই করতে চান না উল্লেখ করে হ্যারি বলেন, ‘আমি জানি না আমার বাবার হাতে আর কতটা সময় আছে।’
রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে যুক্তরাজ্যে নিজের ও পরিবারের পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা সুবিধা ফিরে পাওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যের আদালতে আপিল করেছিলেন হ্যারি। হেরে যাওয়ার পর ক্যালিফোর্নিয়ায় বিবিসি নিউজকে তিনি সাক্ষাৎকারটি দেন।
বাকিংহাম প্যালেস বলেছে, ‘আদালত এসব বিষয় একাধিকবার অত্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করেছেন এবং প্রতিবারই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।’
শুক্রবার আদালতের রায়ের পর প্রিন্স হ্যারি বলেন, ‘এই অবস্থায় স্ত্রী ও সন্তানদের যুক্তরাজ্যে ফেরানোর কথা আমি কল্পনাও করতে পারছি না।’
রাজপরিবারের কিছু সদস্যের সঙ্গে অনেক মতবিরোধ আছে উল্লেখ করে এ রাজপুত্র বলেছেন, এখন তিনি তাঁদের ক্ষমা করে দিয়েছেন।
প্রিন্স হ্যারি আরও বলেন, ‘আমি সত্যিই চাই আমার পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলন হোক। আর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই। জীবন খুবই মূল্যবান।’
নিরাপত্তা নিয়ে এই বিরোধ ‘সব সময়ই প্রধান বাধা’ হয়ে ছিল বলে উল্লেখ করেন হ্যারি।
২০২০ সালে রাজকার্য থেকে পদত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান হ্যারি। সে সময় যুক্তরাজ্যে রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে তাঁর জন্য নির্ধারিত নিরাপত্তা সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হয়। সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করেছিলেন হ্যারি, তবে তা খারিজ হয়ে যায়।
হ্যারি বলেন, তিনি নিরাশ বোধ করছেন। আদালতে পরাজিত হওয়াকে তিনি ‘কায়েমি মহলের পুরোনো ঢঙের সাজানো খেলা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। নিরাপত্তা কমানোর সিদ্ধান্তের জন্য রাজপরিবারকে দায়ী করেন হ্যারি।
বিবিসির পক্ষ থেকে হ্যারির কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি এই নিরাপত্তা-বিতর্কে রাজার হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন কি না। জবাবে হ্যারি বলেন, ‘আমি তাঁকে হস্তক্ষেপ করতে বলিনি—আমি তাঁকে এসব থেকে দূরে থাকতে এবং বিশেষজ্ঞদের তাঁদের মতো করে কাজ করতে দিতে বলেছিলাম।’
হ্যারি মনে করেন, নিরাপত্তা নির্ধারণের এ প্রক্রিয়ায় তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা তাঁর ভয়ংকর আশঙ্কাগুলোকেই সত্য করে তুলেছে।
এই ব্রিটিশ রাজপুত্র বলেন, ‘আমি বিধ্বস্ত—পরাজয়ের জন্য যতটা না, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি এই ভেবে যে যারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা ভাবছে এটা ঠিকই হয়েছে। এটা কি তাদের জন্য জয়? নিশ্চয়ই এমন কিছু লোক আছে, যারা সম্ভবত আমার ক্ষতি কামনা করে, তারা এটাকে বড় এক জয় হিসেবেই দেখছে।’
হ্যারি বলেন, রাজপুত্র হিসেবে নিরাপত্তাসংক্রান্ত অধিকার বাতিলের সিদ্ধান্ত তাঁকে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করে। এখন কেবল রাজপরিবার আমন্ত্রণ জানালেই নিরাপদে দেশে যেতে পারবেন। কেননা, তখন তাঁর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
২০২০ সালে রাজকার্য থেকে পদত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান হ্যারি। সে সময় যুক্তরাজ্যে রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে তাঁর জন্য নির্ধারিত নিরাপত্তা সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হয়। সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করেছিলেন হ্যারি, তবে তা খারিজ হয়ে যায়।
প্রিন্স হ্যারির মতে, ২০২০ সালে তাঁর নিরাপত্তা আনা হলে সেটার প্রভাব শুধু তাঁর নিজের ওপরই নয়, তাঁর স্ত্রী এবং পরে তাঁদের সন্তানদের ওপরও পড়েছে। সবাই জানত যে ২০২০ সালে তাঁদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে এবং সবাই আশা করেছিল, তিনি সেই ঝুঁকির কথা জেনে ভয় পেয়ে ফিরে আসবেন।
‘কিন্তু যখন বুঝলেন যে তাতে ফল হয়নি, তখন কি আমাদের নিরাপদ রাখার কথা আপনারা ভাববেন না?’ আপনি সরকার, রাজপরিবার, আমার বাবা হোন বা আমার পরিবার যা–ই হোন না কেন—আমাদের মধ্যকার সব ভিন্নমত সত্ত্বেও আপনি কি আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চান না?’ প্রশ্ন ছুড়ে দেন হ্যারি।
হ্যারির কাছে জানতে চাওয়া হয় তিনি যুক্তরাজ্যকে মিস করেন কি না। তখন তিনি বলেন, ‘সেখানকার কিছু মানুষ যা করেছে, তা সত্ত্বেও আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, সব সময়ই ভালোবেসেছি এবং আমার মনে হয় আমি যে আমার সন্তানদের আমার জন্মভূমি দেখাতে পারব না, তা সত্যিই খুব দুঃখজনক।’
প্রিন্স হ্যারি বলেছেন, তিনি আর কোনো আইনি চ্যালেঞ্জে যাবেন না। কারণ, গতকাল শুক্রবারের রায়ের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হয়েছে যে এই মামলা আদালতে নিষ্পত্তি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ রায়কে নিজের জন্য একটি ধাক্কা বলে উল্লেখ করেন তিনি।
হ্যারির মতে এ বিষয়টির মূলেই রয়েছে পারিবারিক বিরোধ।
পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা সুরক্ষা ফেরত চেয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে নিজের আইনি লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পরপরই বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেন হ্যারি। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে নিজের এবং পরিবারের যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালীন নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার নিয়ে যে আইনি লড়াই চলছিল, সেটির সর্বশেষ চ্যালেঞ্জেও তিনি পরাজিত হয়েছেন।
যুক্তরাজ্যের আপিল আদালত হ্যারির মামলা খারিজ করে দেয়। তাঁকে অন্য উচ্চপদস্থ রাজপরিবারের সদস্যদের মতো পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা না দেওয়ার সিদ্ধান্তটি একটি সরকারি কমিটি কীভাবে নেয়, সে প্রশ্নে আইনি লড়াই চালাচ্ছিলেন হ্যারি।
শুক্রবার আদালতের রায়ে বলা হয়, ‘প্রিন্স হ্যারি তাঁর এবং তাঁর পরিবারের হুমকির মাত্রা নিয়ে দৃঢ়ভাবে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছিলেন। তবে তাঁর ক্ষোভের অনুভূতিগুলো আইনি যুক্তিতর্কে রূপ নেয়নি।’
হ্যারির অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল প্রটেকশন অব রয়্যালটি অ্যান্ড পাবলিক ফিগারস (র্যাভেক) নামের একটি কমিটি। এটি যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হয়ে রাজপরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা সুবিধাসংক্রান্ত বিষয়গুলোর অনুমোদন দিয়ে থাকে। সেই সময় এই কমিটির সভাপতি ছিলেন রিচার্ড মোট্রাম।
হ্যারি যুক্তি দেন যে কমিটির নিজস্ব বিধান অনুযায়ী তাঁর মামলাটি রাভেকের রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের (আরএমবি) সামনে উপস্থাপন করা উচিত ছিল। সেখানেই তাঁর এবং তাঁর পরিবারের প্রতি হুমকিগুলো মূল্যায়ন করা হতো। কিন্তু তা করা হয়নি।
শুক্রবার যুক্তরাজ্যের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিরা বলেন, ২০২০ সালে রাভেক কমিটি তাদের নিজস্ব নীতিমালা থেকে সরে গিয়ে প্রিন্স হ্যারির নিরাপত্তাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল। তবে প্রিন্স হ্যারির ঘটনাটির জটিলতা বিবেচনায় নিয়ে বিচারপতিরা এটিকে ‘সুবুদ্ধিপূর্ণ সিদ্ধান্ত’ বলে উল্লেখ করেন।
আদালতে পরাজিত হওয়াকে হ্যারি ‘প্রভাবশালী মহলের পুরোনো ঢঙের সাজানো খেলা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। নিরাপত্তা কমানোর সিদ্ধান্তের জন্য রাজপরিবারকে দায়ী করেন হ্যারি।
প্রিন্স হ্যারি বলেন, রাজপরিবারের একজন প্রতিনিধি র্যাভেক কমিটিতে বসেছিলেন বলে জানতে পারার পর তিনি আশ্চর্য হয়েছেন। তাঁর মতে, শুক্রবারের রায় স্পষ্ট করে দিয়েছে যে সিদ্ধান্তটি আইন অনুযায়ী নয়, রাজপরিবারের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইভেট কুপারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন প্রিন্স হ্যারি। র্যাভেক কমিটির কার্যপ্রণালি পুনর্গঠনের জন্য তাঁদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
শুক্রবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে হ্যারি বলেন, তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কুপারকে চিঠি লিখবেন, যেন তিনি বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে পর্যালোচনা করেন এবং র্যাভেক প্রক্রিয়াটি নতুন করে মূল্যায়ন করেন।