Thank you for trying Sticky AMP!!

আমাদের আছে শুধু আকাশ

লকডাউন নিউইয়র্ক। টাইম স্কয়ারের ৪২ স্ট্রিটে নেমেছে আঁধার। সন্ধ্যার পর দোকানপাট বন্ধ, শূন্য রাস্তা। ২১ মার্চ, রাত ১০টা।

ঘরের জানালা থেকে দেখি হলুদ পাতা আর কালচে ডালে সাদা ও বেগুনি রঙের ফুল ফুটে আছে গাছে গাছে। তার পেছনে নীল আকাশ ঝুলে আছে উজ্জ্বল সূর্যালোক ও সাদা মেঘ নিয়ে। পাপড়ি উড়ছে বাতাসে বাতাসে। বর্ণিল সব পাপড়ি ঝরে পড়ছে নগরীর কালো-পিচ-ঢালা পথে। যে পথে কোলাহল নেই, মানুষ আর যানের চলাচল নেই। এমন মনোরম দৃশ্যে আমিও বেরিয়ে এলাম ঘরের দরজা খুলে। প্রতি বসন্তেই এমনভাবে প্রকৃতি সাজে নিউইয়র্কে। সাত বছরে প্রকৃতিকে কোনো দিন এমনভাবে অনুভব করিনি। দেখিনি তার এমন অপরূপ সাজ।

রুটিনবদ্ধ জীবন ছিল সাত বছরের প্রতিটা দিন। শুধু আমি নই। নিউইয়র্কের সব কর্মজীবী মানুষকেই ঘড়ি ধরে চলতে হয়। এখন সবাই পেয়েছে শ্রান্তির বিশ্রাম, ঘড়ির অ্যালার্ম আর নাগরিক জীবন থকে মুক্তি, স্বস্তিতে ঘুমানোর সুযোগ। এমন একটি সময় যেন চেয়ে আসছিল সবাই যুগ যুগ ধরে, মনে মনে। করোনাভাইরাসের কারণে যখন সবকিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখন দেখেছি মানুষ কী স্বার্থপরভাবে একা বাঁচতে চায়! সব খাদ্য আর প্রয়োজনীয় সামগ্রী একাই মজুত করতে চায়। করেছেও অনেকে। কেউ ভাবছে না তার পাশের জন ভালো না থাকলে সেও সুস্থ থাকতে পারবে না। এই যুদ্ধ মোকাবিলা করতে হবে সবার একসঙ্গে, তবে পৃথক থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতন।

ঘর থেকে বের হয়ে দেখি শহরজুড়ে নিস্তব্ধতা। যে পথ ছিল লোকে লোকারণ্য, সেই পথ এখন জনমানবহীন। বার-রেস্তোরাঁ-শপিংমলের কপাট বন্ধ। এ কোন শহর! যে শহরের রেলে ও গাড়িতে চড়ার জন্য লোকে দীর্ঘ লাইন দেয় সময়ের আগে, এখন কোনো তাড়াহুড়ো নেই, দীর্ঘ সারি নেই, কেবলই বিজন নির্জনতা। এই নীরব শহরে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকেন দেশের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত সুসজ্জিত বাহিনী। শহরে অপরাধ থেমে নেই। আরও বেড়েছে এই সংকটে। তাই তাদের দায়িত্বও বেশি এখন।

বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনকে ঘিরে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁরা সবাই বেকার। তাঁদের অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেবেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু তাঁদের সময় অতিবাহিত হয় কী করে? মোবাইল ফোনে শত শত নম্বর সেভ করা থাকলেও বেশির ভাগ মানুষকে কল করা হয় না। খোঁজ নেওয়া হয় না কোন প্রিয়জন কেমন আছে? শুধু সময়ের মিল না থাকায় আমরা যোগাযোগের ভিন্ন ও সাশ্রয়ী মাধ্যম থাকার পরেও ছিলাম যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। এখন সবাই জানে প্রত্যেকে তাদের নিজেদের বাসায় অবস্থান করছে। ফোনের আলাপনে জানা যায়, কেউ কেউ অফিস-আদালতের কাজ বাসায় বসেই করছেন।

যাঁরা একেবারেই বেকার, তাঁরা নিজের বাসায় থেকে নিজের পরিবারকে সময় দিচ্ছেন। যে সন্তান তার মা-বাবাকে কোনো দিন একসঙ্গে পেত না, তারা আজ সবাই একসঙ্গে জীবন যাপন করছে। সন্তানদের এমন সুখের সময় যেন কোনো দিন আসেনি এর আগে। স্বামী-স্ত্রী পৃথক সময়ে কাজ থাকায় তাঁদের মধ্যেও যোগাযোগ ছিল প্রতিবেশীসুলভ। এখন তাঁরা দুজনে মিলে রান্নাসহ ঘরের নানা কাজ করছেন। অনেকটা নতুন সংসার গোছানোর মতো। বৃদ্ধ মানুষেরা এই সময়ে পাচ্ছেন পরিবারের আর সবার অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সেবা। পরিবারের প্রতিটি মানুষ যেন আগের চেয়ে অনেক সুখী।

জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, ওয়াল স্ট্রিটসহ আরও কতশত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান কার্যত অচল আজ। সবকিছুতেই এক অমোঘ নৈঃশব্দ্য। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে শোনা যাচ্ছে। নাগরিকেরা স্থায়ীভাবে কাজ হারাবেন। এসবের পরেও সমৃদ্ধ দেশ তাদের সাধ্যমতো নাগরিকদের জীবনযাপনের জন্য অর্থসহায়তা দিচ্ছে। সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলেও বন্ধ হয়নি গবেষণাগার, চিকিৎসা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দুনিয়া। বিশ্বের সব মানুষ এমন সব মহৎ প্রতিষ্ঠানের দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে।

করোনাভাইরাস আক্রান্ত সময়। ম্যানহাটনের এক স্টেশনে অল্পসংখ্যক যাত্রী দেখা যাচ্ছে ট্রেনে। ১৯ মার্চ, সন্ধ্যা সাড়ে ছটা।

এ জন্যই বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিত্য খোঁজ রাখছেন কখন, নতুন কী উদ্ভাবন হলো। পুরোনো কোনো ওষুধ নতুন করে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করছে? গণমাধ্যমের কর্মীরাও সব জোগান দিচ্ছেন। কেউ পত্রিকা, কেউ টিভি, কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রয়োজনীয় লিংক শেয়ার করে। বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্নভাবে মানুষ খুঁজছে ভাইরাস থেকে মুক্তির উপায়।

বিশ্বের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত নিউইয়র্ক শহর নাকি ঘুমায় না কোনো দিন। না ঘুমাক, তারও অন্তত কিছুটা বিশ্রাম প্রয়োজন। এই শহর যেন তার নিজের জন্য বিশ্রাম নিয়েছে। কত দিন তার বিশ্রাম প্রয়োজন, কেউ জানে না। এই রাজ্য এখন অবরুদ্ধ। নিউইয়র্কের মতো বিশ্বের সব শহর আর রাজ্য বিশ্রাম চায়; যেন পৃথিবী ভীষণ রকম ক্লান্ত। কোনো কোনো শহর পেয়েছে, অনেকেই পায়নি। বুদ্ধিমান জাতি ও দেশ তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বন্ধ রেখেছে।
যান্ত্রিকতা থেকে প্রকৃতির দিকে তাকালে দেখা যায় নদীর পানি আগের চেয়ে স্বচ্ছ। বাতাস আরও বিশুদ্ধ। পুরো প্রকৃতি আরও স্নিগ্ধ এবং নির্মল। করোনাভাইরাস আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করলে সে ফুঁসে উঠবেই।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শহর দেখে ঘরে ফিরে দেখি বইয়ের তাকে ধুলোর আস্তরণ। অনেকগুলো বই জমিয়ে রেখেছিলাম অবসর পেলে পড়ব বলে। মাঝেমধ্যে দু–এক পাতা পড়লেও পুরো বই পড়ে শেষ করতে পারিনি। অনেক লেখা লিখব বলে চিন্তা-খাতায় লিখে রেখেছি। লেখা শুরু করতে পারিনি। সময় নেই। আমার মতো অনেকেই শখের অনেক কাজ করবেন বলে তালিকা তৈরি করে রেখেছেন। অবসরে নিজে পছন্দের কিছু গান শোনা, প্রিয় সিনেমা দেখা, নিজের ভালো লাগা খাবার রান্না করা...কত কী! ঘরে থেকে ঘরে থাকার আনন্দ উপভোগ করা। আরও কত কিছু যে আমরা করতে পারি না শুধু সময়ের অভাবে, তা আমরা নিজেরাও জানি না। করোনাভাইরাস আমাদের দিয়েছে অফুরন্ত সময়।

এ যেন অনাহূত অবকাশ। এই অনাহূত অবকাশে কত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন জন লেনন। প্রকৃতি যেন লেননের স্বপ্নের পৃথিবী বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কী নির্মমভাবে আমাদের সামনে হয়েছে হঠাৎ আবির্ভূত।

জন লেনন ও তাঁর স্ত্রী ইয়োকো অনো মানবতার জন্য ‘ইমাজিন’ শিরোনামের একটি গান লিখেছিলেন ১৯৭১ সালে। জন লেননের গাওয়া সেই গানটি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছিল। সে গান যা এখনো মানুষকে উদ্দীপ্ত করে বিশ্ব মানবতার জন্য। এই ভয়ংকর ছুটির দিনে অক্ষম অনুবাদ করতে বসি।

ইস্ট রিভারের পাড়ে গড়ে উঠেছে ম্যানহাটনের মিড টাউন। বর্ণিল আলোয় সজ্জিত বিল্ডিংগুলোর ওপর কালো মেঘের ছায়া। ২১ মার্চ, রাত সাড়ে দশটা।

‘মনে করো স্বর্গ নেই
সহজ হবে যদি আরও চেষ্টা করে ভাবো
আমাদের অতলে কোনো নরকও নেই
আমাদের আছে শুধু আকাশ
মনে করো, সব মানুষ বেঁচে আছে আজকের জন্য
ভাবো, পৃথিবীতে কোনো দেশ নেই
এই স্বপ্ন দেখা কঠিন নয়
কোনো ধর্মও নয়
শান্তিতে জীবনযাপনকারী সমস্ত মানুষকে কল্পনা করো
তুমি বলতে পারো যে আমি স্বপ্নবিলাসী
কিন্তু আমি শুধু একা না
আশা করছি কোনো একদিন তুমিও
আমাদের সহজন হয়ে একই স্বপ্ন দেখবে
এবং পৃথিবী হবে সবার জন্য এক হিসাবের
কোনো সম্পদ কল্পনা করো না
যদি তুমি এমন ভাবতে পারো তবে কোনো লোভের দরকার নেই।’

একটি দিনের সমাপ্তি হলে ভাবি গাছ থেকে মাটিতে ঝরে পড়া পর্যন্তই যে পাপড়ির জীবন, সেই পাপড়ির কি জিজ্ঞাসা নেই, ‘জীবন এত ছোট ক্যানে?’ তারপরও সে বাতাসে ভাসতে ভাসতে জীবনকে উপভোগ করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় শুধু। আমরাও যদি সব দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে লেননের স্বপ্নের সারথি হয়ে শুধু স্বপ্নের মতো করে অবকাশ যাপন করতে থাকি!

বন্ধু এসো আকাশ দেখি পুরোটা চোখ খুলে।

লেখক: নিউইয়র্কপ্রবাসী