খুলনার মেয়ে কাজী আসমার বিশ্বনাগরিক হওয়ার গল্প

রূপকথার গল্পে আমরা শিখেছি—রাজকন্যা ঘুমিয়ে থাকে, আর সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পার করে রাজপুত্র এসে সোনার কাঠি রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে তার ঘুম ভাঙায়। এসব গল্প খুলনার কাজী আসমা আজমেরীও নিশ্চয় পড়েছিলেন ছোটবেলায়। হয়তো এও শুনেছিলেন যে, একা একা দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো মেয়েদের কম্ম নয়। তাই খানিকটা নিজেকে পরখ করতেই ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্নের পর ২০০৯ সালে বেরিয়ে পড়েছিলেন আসমা। সেই শুরু। একাই এক শয়েরও বেশি দেশ ঘুরে খুলনার আসমা এখন বিশ্বনাগরিক।
প্রথম প্রথম ঘোরাটা আর পাঁচটা উপমহাদেশীয় টুরিস্টের মতোই চলছিল। কিন্তু সেটা খরচসাপেক্ষ। নেপালে বিদেশি ব্যাকপ্যাকারদের কাছ থেকে প্রথম হোস্টেলে থেকে কম খরচে ঘোরার হদিস পান আসমা। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা তৃতীয় বিশ্বের পর্যটকেরা প্রথম বিশ্বের দেশে গিয়ে অনেক টাকা খরচ করে ঘোরেন। কিন্তু ওদের দেশের টুরিস্ট আমাদের এখানে ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ঘুরতে এসে কত কম খরচে ব্যাকপ্যাকিং করে চলে যায়।’
সিঙ্গাপুরে প্রথম হোস্টেলে থাকার অভিজ্ঞতা হওয়ার পর থেকে এখন হোস্টেলেই থাকা অভ্যাস হয়ে গেছে আসমার। হোস্টেলে থাকা মানে একটা ঘর কয়েকজনের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া, আর নিজে বাজার করে রান্না করে খাওয়া। কোথাকার খাবার খেয়ে সবচেয়ে ভালো লেগেছে জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘যেখানে যাই সেখানকার খাবার খাওয়ার চেষ্টা করি। মঙ্গোলিয়ায় ঘোড়ার মাংস খেয়েছি। ওখানে আবার খাসির মাংস মাত্র পঞ্চাশ টাকা কিলো। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার স্টেক, নিউজিল্যান্ডের ল্যাম্ব খুব ভালো লেগেছে। তবে আমি তো কম খরচে ঘুরে বেড়াই; রেস্তোরাঁর খাবার খেতে পারি না।’ কম খরচে ঘোরার টিপস জানার জন্য লোনলি প্ল্যানেট বইয়ের অন্ধ ভক্ত তিনি। এতে নাকি বছরে পাঁচ শ ডলার বেঁচে যায় আসমার। লোনলি প্ল্যানেট বই থেকেই শিখেছেন, কোনো নতুন জায়গায় যাওয়ার আগে সেখানকার ভাষায় ‘ধন্যবাদ’ ও ‘কত দাম’ বলতে শিখে নেওয়ার নিয়ম।
গুয়াতেমালায় গিয়ে রাজপুত্রের দেখাও পেয়েছিলেন আসমা। কিন্তু বছর চারেক একসঙ্গে থাকার পর ঠিক করেন প্রেম নয়, আপাতত বন্ধুত্বেই আস্থা রাখবেন। আসমার এখনকার ঠিকানা নিউজিল্যান্ড। ঘোরার খরচ জোগাড় করতে দেড় বছর চাকরি করেন। সপ্তাহান্তে বারটেন্ডার হিসেবেও কাজ করতে হয়। কিছু টাকা জমিয়ে আবার বেরিয়ে পড়েন ছয় মাসের জন্য। ২০১৮ সালে মধ্য এশিয়ার আজারবাইজান, বৈকাল হ্রদ, রাশিয়া ঘুরতে ঘুরতে ট্রেনে পাড়ি দিয়েছেন ২৩ হাজার কিলোমিটার। রাশিয়ায় খুঁজে পেয়েছেন এমন অতিথিপরায়ণ কিছু মানুষকে, পথনির্দেশ জানতে চাইলে যারা একেবারে অকুস্থলে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন। এভাবে ঘুরতে ঘুরতেই বছরে একবার কিছুদিনের জন্য বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতের ভুনা গোশত ও প্রতিবেশীর বাড়ির পুজোর ভোগের লুচি, ছোলার ডাল খাওয়া চাইই চাই। দেশে ফিরে আর যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতেই হয়, তা হলো একটা ভালো গামছা কেনা। পরিব্রাজক আসমার সব সময়ের সঙ্গী গামছা, ছাতা, তিন জোড়া জুতো, মোবাইলের চার্জার, ক্যামেরা, জলের বোতল ও ইয়ার প্লাগ।
কলকাতায় কবে আসবেন জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘আরে কলকাতা যাওয়া কোনো একটা ব্যাপার হলো? কলকাতা যেতে তো আমার মাত্র দু শ টাকা খরচ হয়। দেশে ফিরে আমি তোমার জন্য ইলিশ নিয়ে যাব। তুমি আমার জন্য লুচি, ছোলার ডাল রান্না করে রেখো।’ বলেই হেসে গড়িয়ে পড়লেন। ভালো কথা, ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন কাজী আসমার জন্মদিন।