পৃথিবীর প্রথম নারী সরকারপ্রধান

শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে
শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে

মানছি, দেশের শীর্ষ পর্যায়ে নারীর অবস্থান সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে না। কিন্তু যখন নারী বা নারীরা একটি দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দীর্ঘদিন নির্বিঘ্নে পরিচালনা করেন তখন এ কথা অন্তত বলা যায়, সেই দেশের বা সেই ভূখণ্ডের জনসাধারণের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে।
উন্নত বিশ্বের লোকেরাই প্রথম উপলব্ধি করেন, সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা না গেলে সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এর ঢেউ এসে লাগে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। সেই ঢেউয়ে, কখনো কখনো বিষয়টি ভালো করে না বুঝেই আমরা ভেসে যাই। এ বিতর্কে যাওয়ার অবশ্য আমার ইচ্ছে নেই। আজ আমি রাষ্ট্র ক্ষমতায় নারীর অবস্থান বিষয়েই আলোকপাত করব। ভারত-পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় নারী বা গত ২৬ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশ শাসন করছেন নারীরা, এটি কোনো আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পৃথিবীর প্রথম নারী সরকার প্রধান যিনি ছিলেন তিনিও দক্ষিণ এশিয়ারই মানুষ। তিনি শ্রীলঙ্কার তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে। ১৯৬০ সালের ২১ জুলাই তিনি তৎকালীন স্বাধীন সিলনের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ১৯৬৫ সালের ২৭ মার্চ পর্যন্ত দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করেন। ১৯৬৬ সালের ২৪ এপ্রিল পৃথিবীর দ্বিতীয় নারী সরকার প্রধান ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তিনিও দক্ষিণ এশিয়ারই মানুষ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এরও অনেক পরে ১৯৭৯ সালের ৪ মে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে গ্রেট ব্রিটেনের ক্ষমতায় আসেন একজন নারী, মার্গারেট থ্যাচার। এরই মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ১৯৭০ সালের ২৯ মে ক্ষমতা গ্রহণ করেন শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে এবং ৭ বছর ৫৫ দিন ক্ষমতায় থেকে বিদায় নেন ১৯৭৭ সালের ২৩ জুলাই।

ইন্দিরা গান্ধী

আজকের এই রচনায় পৃথিবীর প্রথম নারী সরকার প্রধান শ্রীমাভো বন্দরনায়েকেকে নিয়েই আলোচনা করব। ১৯১৬ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ কলোনি সিলনে জন্মগ্রহণ করেন। মাঠ থেকে উঠে আসা নেত্রী তিনি নন, জন্মই তাঁর এক রাজনৈতিক পরিবারে। পিতা বারনেস রাতওয়াত্তে ছিলেন স্টেট কাউন্সিলের সদস্য এবং ব্রিটিশ সিলনের সিনেটর। ১৯৪০ সালে ২৪ বছর বয়সে শ্রীমাভো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ৪১ বছর বয়সী সলোমন ওয়েস্ট রিজওয়ে ডায়াস বন্দরনায়েকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এর ছয় বছর পরে ১৯৪৬ সালে শ্রীলঙ্কার ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়, সলোমন ছিলেন এই পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদেরই একজন, তিনি ১৯৪৭ সালে নিম্নকক্ষের সাংসদও নির্বাচিত হন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং দূরদর্শী সলোমন ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি থেকে বেরিয়ে গিয়ে শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে সলোমন শ্রীলঙ্কার চতুর্থ সরকার প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু অচিরেই, ১৯৫৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃত্যু রাষ্ট্রক্ষমতায় এবং দলের মধ্যে শূন্যতার সৃষ্টি করে, যার ফলে ১৯৬০ সালের মার্চ মাসের নির্বাচনে ফ্রিডম পার্টি হেরে যায়। অবধারিতভাবেই পার্টির হাল ধরেন সলোমনের বিধবা শ্রীমাভো। তাঁর বিচক্ষণ নেতৃত্ব দলকে পুনর্গঠিত করে মাত্র চার মাসের মাথায় ক্ষমতায় নিয়ে আসে। ২১ জুলাই ১৯৬০ তারিখে তিনি শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি আধুনিক বিশ্বের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে রেকর্ড গড়েন।
এরপর আর তাঁকে কখনোই পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৬৫ সালে তাঁর দল নির্বাচনে হেরে গেলে তিনি বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭০ পর্যন্ত। ৭০-এর নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত হন। এ পর্যায়ে তিনি দেশের সংবিধানসহ বিভিন্ন পর্যায়ে বেশ বড় ধরনের পরিবর্তন আনেন। সিলন থেকে দেশের নাম পরিবর্তন করে রাখেন শ্রীলঙ্কা। মেয়াদের শেষের দিকে তার জনপ্রিয়তায় বড় ধরনের ধস নামে। অভিযোগ ওঠে, ক্ষমতার অপব্যবহারের। গোটা আশির দশকটাই বেশ খারাপ সময় কাটিয়েছেন তিনি। পরে ১৯৯৪ সালে আবারও শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

বেনজির ভুট্টো

এই সময়ের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন বেনজির ভুট্টো এবং ১৯৯০ সাল থেকে আজ অবধি লাগাতারভাবেই বাংলাদেশের সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন দু’জন নারী, বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা। দক্ষিণ এশিয়ার নারী নেত্রীদের সঙ্গে মার্গারেট থেচার বা অ্যাঙ্গেলা মেরক্যালের মতো নারী নেত্রীদের একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। সন্দেহ নেই শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের নেতৃত্ব ছিল রাষ্ট্রনায়কোচিত কিন্তু তাঁর উত্থান ছিল স্বামীর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই। একইভাবে জওহরলাল নেহরুর কন্যা না হলে বা জুলফিকার আলী ভুট্টোর কন্যা না হলে ইন্দিরা বা বেনজিরের রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ সম্ভব হতো না। বাংলাদেশে যে দুজন নারী ২৬ বছর ধরে দেশ শাসন করছেন তারাও কারও কন্যা অথবা কারও স্ত্রী। দক্ষিণ এশিয়ার নারী নেত্রীদের নেতৃত্বের ঔজ্জ্বল্য রয়েছে তবে তা চাঁদের আলো। কিন্তু আমরা যদি মার্গারেট থেচার বা অ্যাঙ্গেলা ম্যারকেলের দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে অন্য কোনো পুরুষের কাঁধে ভর করে তাদের নেতৃত্বে আসতে হয়নি, তাঁরা স্বতন্ত্র, সূর্যের মতো প্রোজ্জ্বল। চাঁদের আলোয় ফুল ফোটে, আমরা আবেগাপ্লুত হই, প্রেমে পড়ি কিন্তু এ আলোতে ফসল ফলে না, ফসলের জন্য প্রয়োজন সূর্যের আলো। যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ায় নারী নেতৃত্বের চর্চা পরিণত হয়ে উঠেছে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা যদি হয় বা যেখানে যেখানে গণতন্ত্রের চর্চা আছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে সূর্যালোকের বিভা নিয়ে কোনো নারী আবির্ভূত হবেন।