
বাগান মানেই এক টুকরো ভালো লাগা। বাগান দেখলেই মনটা শান্ত হয়ে যা, তা সে ফুলবাগান হোক, সবজি বা ফলের বাগান হোক অথবা শুধু সবুজ গাছ হোক। যেকোনো জায়গায়, বাড়ির বাইরে বা ভেতরে হোক, ছোট হোক বা বড় হোক না কেন, একটুখানি সবুজের ছোঁয়া থাকলেই তা মনটাকে প্রফুল্ল করে দেয়। বাগান যে শুধু মনকে প্রফুল্ল করে তাই নয়, ঘরের বাতাসকেও পরিশুদ্ধ করে।
কোনো বাগান দেখলেই আমার মনে হয়, বাগানের মালিক একজন অত্যন্ত সুরুচিসম্পন্ন ও শিল্পিত মনের মানুষ। কারও বাড়ির সামনে সুন্দর করে সাজানো বাগান দেখলেই আমি দাঁড়িয়ে যাই। ঘরের ভেতরে গাছের সমারোহ দেখলেও আমার ভালো লাগে। কারণ আমি নিজে বাগান করতে ভালোবাসি, তাই বুঝি কতখানি ভালোবাসলে মানুষ বাগান করে। আমি দেশে থাকতেও বাগান করেছি। আমেরিকায় আসার পরও সেই অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটেনি। নিজের বাড়ি হওয়ার পর ঘরে-বাইরে সব জায়গায় বাগান করি। আগে ভাড়া বাড়িতে থাকতে ঘরের ভেতর ও বারান্দায়, স্বল্প পরিসরে বাগান করেছি। ঘরের ভেতরে কয়েকটি সবুজ গাছ বা লতা থাকলেই ঘরের সৌন্দর্য যেন অনেক বেড়ে যায়।
অনেক মানুষ আছেন, তারা যেখানেই থাকেন না কেন, সেখানেই বাগানবাড়ি বানিয়ে ফেলেন। আবার এমন অনেক মানুষও আছেন, যাদের বাগান করার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। এর পেছনে অবশ্য অনেক কারণ আছে। ব্যস্ততা, স্থানাভাব বা অনভিজ্ঞতা। আমরা যারা বিদেশে থাকি, বিশেষ করে মেয়েরা, তারা সুপার বিজি। চাকরিতে হাড়ভাঙা খাটুনির পর আছে সংসার এবং স্বামী–সন্তানের দেখাশোনা করা। এখানে আমাদের গৃহপরিচারিকা নেই, ফলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সবই একা হাতে করতে হয়। এরপর নিজের দিকেই খেয়াল করার সময় হয় না, আর বাগান করা! প্রশ্নই আসে না।
আবার অনেকের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ছোট বাড়ি, বারান্দা নেই, আঙিনা তো নেই-ই, এসব কারণে তারা বাগান করার উৎসাহ পান না। এ ছাড়া, অনেক সময় দেখা যায়, পূর্ব অভিজ্ঞতার অভাবে অনেকেই গাছের অযত্ন বা অতি যত্ন করে থাকেন। ফলে গাছগুলো মরে যায় বা গ্রোথ হয় না। আবার অনেক সময় সঠিক আলোছায়ার কারণেও অনেক গাছের পরিণতি ভালো হয় না। তখন তারা হতোদ্যম হয়ে পড়েন।
যারা বাগান করতে আগ্রহী, কিন্তু ব্যস্ততা বা স্থানাভাব বা অনভিজ্ঞতার জন্য বাগান করা থেকে বিরত থাকেন, তাদের জন্য আমার আজকের লেখা। আশা করি, ব্যস্ত জীবনে ও স্বল্প পরিসরেও তারা বাগান করার ব্যাপারে উৎসাহ পাবেন।
যারা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, ছোট বারান্দা আছে বা নেই, তারা বাড়ির ভেতরে অল্প জায়গাতেও একটি দৃষ্টিনন্দন বাগান গড়ে তুলতে পারেন। অনেক গাছ আছে, যেগুলোতে প্রতিদিন পানি দিতে হয় না বা তেমন যত্ন নিতে হয় না। হাউস প্ল্যান্ট হিসেবে সাকুলেন্ট একটি আদর্শ প্ল্যান্ট। অনেক প্রজাতির সাকুলেন্ট পাওয়া যায়। এরা ক্যাকটাস গোত্রের। চমৎকার আকৃতি এবং বর্ণের পাতা দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। পাশাপাশি কয়েক রকমের সাকুলেন্ট রাখলে এর সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। সাকুলেন্ট ও যেসব গাছের পাতা একটু মোটা, সেসব গাছে দু–একদিন পরপর সামান্য পানি দিলেই হয়। এরা পাতার ভেতর পানি জমিয়ে রাখে। তবে এদের প্রচুর আলোর প্রয়োজন। ঘরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো না থাকলে কৃত্রিম আলোতে গাছগুলো রাখতে হবে।
মানি প্ল্যান্ট আমাদের কাছে অতিপরিচিত একটি গাছ। আলোছায়া সব পরিবেশেই এরা মানিয়ে নিতে পারে। মানি প্ল্যান্টের একটি ডাল বোতলে বা গ্লাসে পানির মধ্যে রেখে দিলেই কয়েক দিনের মধ্যে শেকড় গজিয়ে যাবে। এরপর সেটা টবে লাগানো যেতে পারে আবার পানিতেও রেখে দিতে পারেন। এ ছাড়া আরও আছে, জেড প্ল্যান্ট, কয়েন প্ল্যান্ট, স্পাইডার প্ল্যান্ট, আফ্রিকান ভায়োলেট, পিস লিলি ইত্যাদি। ঘরে যে গাছই রাখুন না কেন, টবগুলোকে রুচিসম্মত কোনো পাত্রের মধ্যে রাখলে ঘরের সৌন্দর্য আরও বেড়ে যাবে।
যাদের বাড়িতে বারান্দা বা এক চিলতে জায়গা আছে, তারা কিছু সহজ গাছ লাগাতে পারেন। পর্তুলিকা (আমাদের দেশে যেটাকে নাইন ও’ক্লক ফুল বলে সমধিক পরিচিত), গাঁদা, কোনফ্লাওয়ার (coneflower), সূর্যমুখী—এসব গাছ যেখানে রৌদ্র বেশি আসে সেখানে লাগাতে হবে। দিনে একবার পানি দিলে ভালো হয়। তবে একদিন/দুদিন অন্তর পানি দিলেও অসুবিধা নেই। এসব গাছের তেমন যত্নআত্যি করা লাগে না। কোনফ্লাওয়ার, লিলি পেরিনিয়াল শীতকালে মরে যায়, কিন্তু বসন্তের শুরুতে আবার হয় এবং গাছের পরিধি বছরে বছরে দ্বিগুণ বড় হয়। তাই টবে লাগালে বড় টবে লাগাতে হবে।
রৌদ্র-ছায়ার লাগানোর জন্য ভালো ফুল হচ্ছে পিটুনিয়া, ইমপেশেন্স। এগুলো মৌসুমি ফুল বা অ্যানুয়াল। পেরিনিয়াল ফুল হাইড্রেঞ্জা এবং গোলাপ গাছ লাগাতে পারেন। প্রতি বছর অজস্র ফুল হয়। ফুলগাছে বেশি ফুল পেতে হলে একটু যত্ন করতেই হবে। মাঝে মাঝে মিরাকল গ্রো দিতে হবে। ‘ডেড হেডিং’ করতে হবে অর্থাৎ ফুল মরে গেলে ডাঁটিসহ কেটে ফেললে বেশি ফুল হবে। যেখানে পুরোপুরি ছায়া সেখানে ফক্সগ্লোভ, প্রিমরোজ, হাইড্রেঞ্জা (কোন কোন প্রজাতির হাইড্রেঞ্জা ছায়াতে ভালো ফুল দেয়)—এসব দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। এগুলো সবই পেরিনিয়াল। একবার লাগালেই হবে।
এ ছাড়া, রান্নাঘরের জানালার ওপর স্বল্প পরিসরে সবুজের সমারোহ ঘটানো যেতে পারে। পানিতে পুদিনা পাতা, পুঁইশাকের নিচের ডাঁটা এবং পেঁয়াজ কলি, সেলেরির গোড়াটা ডুবিয়ে রাখলে নতুন করে পাতা এবং ডাল বেরোবে। দেখতেও রুচিসম্মত লাগবে, আবার রান্নার কাজেও লাগবে। তবে দু–একদিন পরপর পানিটা পাল্টে দিতে হবে।
ছোট বারান্দা বা আঙিনায় বেশি গাছ লাগাতে হলে রেলিংয়ের ওপর টব রাখতে পারেন। সিলিং বা দেয়ালে হুক লাগিয়ে গাছ ঝুলিয়ে দিতে পারেন। এ ছাড়া লোহার বা শক্ত প্লাস্টিকের শেলফে এক সঙ্গে অনেক গাছ রাখা যায়। ‘ভার্টিক্যাল ফ্লাওয়ার টাওয়ার’ বানানো যেত পারে।
অনেকেই মনে করেন, যাদের বাগানে গাছের বাহার বেশি, তাদের ‘গ্রিন থাম্ব’ আছে। আসলে ওসব কিছু না। সুন্দর বাগান করতে চাই ভালোবাসা। গাছের প্রতি ভালোবাসা। ভালোবাসলেই গাছ আপনাকে দেবে অনাবিল প্রশান্তি আর আপনার সামান্য ভালোবাসা পেলেই গাছ অহংকার ও গর্বে হয়ে উঠবে পত্রপুষ্পে শোভিত।