যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু ভিয়েতনাম যুদ্ধকেও ছাড়াল

যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের। ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের। ছবি: রয়টার্স

কার্যত অদৃশ্য এক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে সারা বিশ্ব, করোনাভাইরাসের মহামারি। সেই লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে প্রাণ গেছে সোয়া দুই লাখের বেশি মানুষের। এরই মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিটা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটিতে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের। গত শতকে ভিয়েতনামে পরাজিত হওয়ার সেই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যত মানুষ নিহত হয়েছিল সেই সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেল করোনায় মার্কিনদের মৃত্যু।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সার্বক্ষণিক তথ্য প্রকাশ করছে ওয়ার্ল্ডোমিটারস ডট ইনফো। তাদের তথ্যমতে, গতকাল বুধবার পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩২ লাখ। এর মধ্যে মারা গেছেন প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজারের বেশি। সুস্থ হয়েছেন প্রায় ১০ লাখ।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত ২১ জানুয়ারি। আর প্রথম মৃত্যু হয় গত ২৯ ফেব্রুয়ারি। সেখান থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ৬০ দিনে দেশটিতে মৃত্যু ৬০ হাজার ছাড়ায়। দেশটিতে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যাও ছাড়িয়ে গেছে ১০ লাখ ৪৮ হাজার। বিশ্বের মোট রোগীর এক–তৃতীয়াংশ যুক্তরাষ্ট্রে।

১৯৫৫ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া ভিয়েতনাম যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল ১৯৭৫ সাল পর্য‌ন্ত। এর মধ্যে উত্তর ভিয়েতনামের পক্ষে ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য কমিউনিস্টবিরোধী রাষ্ট্র। যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট–এর তথ্যমতে, ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতার ১৬ বছরে প্রাণ গিয়েছিল ৫৮ হাজার ২২০ জন মার্কিন নাগরিকের। মার্কিনদের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর ১৯৬৮ সাল। ওই বছর প্রায় ১৭ হাজার মার্কিন সেনা নিহত হন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, দুদিন পরিস্থিতির উন্নতির ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু আবার বেড়ে যায়। এদিন দেশটিতে মারা গেছেন ২ হাজার ৪৭০ জন। এর আগের দিন, সোমবার দেশটিতে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৩৮৪ জনের। আর রোববার মারা যান ১ হাজার ১৫৬ জন। সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে চললেও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে লকডাউন তুলে নেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। লকডাউনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও চলছে দেশটিতে। রয়টার্সের খবরে আরও জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রে গত ১৮ দিনে রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। তবে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা আরও বেশি বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের স্বাস্থ্যকর্মীরা।

এরপরও লকডাউনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সমর্থন দিচ্ছেন লকডাউনের বিপক্ষে বিক্ষোভরতদের। অবশ্য করোনা মহামারির শুরু থেকেই তিনি উল্টো পথে চলছেন। শুরুতে তিনি এই মহামারিকে গুরুত্বই দিতে চাননি। বলেছিলেন সবকিছু তাঁর সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু মহামারি প্রকট হয়ে উঠলে করোনাভাইরাসের নাম দিয়ে বসেন ‘চাইনিজ ভাইরাস’। এ নিয়ে চলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাক্‌যুদ্ধ।

সাম্প্রতিক সময়ে করোনার চিকিৎসায় হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ওষুধের ব্যবহারের ওপর জোর দেন ট্রাম্প। ম্যালেরিয়ার এই ওষুধ রপ্তানি বন্ধ রেখেছিল ভারত। ট্রাম্পের হুমকি-ধমকির পর সে অবস্থান থেকে সরে আসে দেশটি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে গত মাসে করোনা সংক্রমিত এক রোগী ক্লোরোকুইন ওষুধ প্রয়োগের পর মারা যান। এই বিষয় নিয়ে বিতর্কের রেষ কাটতে না কাটতেই নতুন বিতর্কের জন্ম দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কয়েক দিন আগে তিনি শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে জীবাণুনাশক প্রয়োগের তত্ত্ব নিয়ে হাজির হন। এ নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়। পরিস্থিতি এই পর্যায়ে যায় যে শেষ পর্যন্ত জীবাণুনাশক উৎপাদনকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষজ্ঞরা জনসাধারণের প্রতি জীবাণুনাশক শরীরে প্রয়োগ কিংবা পান না করার আহ্বান জানান। তাঁরা সতর্ক করেন, এ ধরনের কাজ প্রাণঘাতী হতে পারে।

বিশ্বে মৃত্যু আবার বাড়ল

বেশ কিছু দিন ধরে বিশ্বে মৃত্যু ছয়–সাত হাজারের ঘরে ছিল। এরপর গত রোববার তা চার হাজারের নিচে এবং সোমবার পাঁচ হাজারের নিচে নামে কিন্তু মঙ্গলবার আবার তা বেড়ে গেছে। এদিন বিশ্বজুড়ে মৃত্যু হয়েছে ৬ হাজার ৩৬৫ জনের।

বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ফ্রান্সে মৃত্যু মঙ্গলবার সাড়ে ২৩ হাজার ছাড়ায়। দেশটিতে রোগী শনাক্ত হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার। দেশটির সরকার মঙ্গলবার জানিয়েছে, আগামী ১১ মে থেকে দেশটিতে দোকান, বাজার ও বাছাইকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে। তবে গণপরিবহনে পরতে হবে মাস্ক। আর বাড়িতে থেকে কাজের নির্দেশ বলবৎ থাকবে আরও কয়েক সপ্তাহ। পরিকল্পনা উপস্থাপনের সময় দেশটির প্রধানমন্ত্রী এদোয়ার্দো ফিলিপ স্বীকার করেন, করোনার সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসায় এভাবে ধীরে ও ক্রমান্বয়ে লকডাউন তুলে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’।

স্পেনে মঙ্গলবার মৃত্যু হয় ৩০১ জন, আর গতকাল ৪৫৩ জন। এ নিয়ে দেশটিতে মারা গেলেন ২৪ হাজারের বেশি। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২ লাখ ৩৬ হাজার ছাড়িয়েছে। ইউরোপের আরেক দেশ ইতালিতে গতকাল মারা গেছেন ৩৮২ জন। এ নিয়ে মোট মৃত্যু সাড়ে ২৭ হাজার ছাড়িয়েছে।

যুক্তরাজ্যে গতকাল মারা গেছেন ৭৬৫ জন। তবে হিসেবে বাইরে থাকা ৩ হাজার ৮১১ জনের মৃত্যু গতকাল নতুন করে যোগ করা হয়েছে। এতে করে দেশটিতে মোট মৃত্যু সাড়ে ২৬ হাজার ছাড়িয়ে গেল।

তবে সংক্রমণ বাড়ছে রাশিয়া, তুরস্ক, ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সতর্ক করে বলেছেন, তাঁর দেশে করোনার সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ে এখনো আসেনি। লাতিন আমেরিকায় ব্রাজিল এখন করোনার নতুন হটস্পট হয়ে উঠেছে। দেশটিতে মৃত্যু ৫ হাজার ছাড়িয়েছে মঙ্গলবার। ওই দিন মারা গেছেন ৫২০ জন। সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে কানাডাতেও।