
যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় লাল ইটের দোতলা মিউটার জাদুঘরে ঢুকলেই চোখে পড়ে অদ্ভুত সব সংগ্রহ—মানুষের খুলি, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, অস্বাভাবিক রোগে আক্রান্ত মানুষের মুখমণ্ডলের মোমের ছাঁচ, চিকিৎসার পুরোনো সরঞ্জাম। এ যেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অদ্ভুত সংগ্রহশালা।
এ জাদুঘরে অনেক বছর ধরেই এক ব্যক্তির অস্বাভাবিক বিশাল অন্ত্র প্রদর্শিত হচ্ছিল। তাঁর পরিচয় ছিল শুধু আদ্যক্ষর জেডব্লিউ দিয়ে। কাচের পাত্রে রাখা নামহীন, মুখমণ্ডলহীন মানুষের এ অঙ্গের পাশে লেখা থাকত—জেডব্লিউ। সম্প্রতি তাঁর পরিচয় জানা গেছে। নাম—জোসেফ উইলিয়ামস। শুধু তাঁর অঙ্গ নয়, তাঁর জীবনের গল্পও এখন জাদুঘরে বলা হচ্ছে।
মানবদেহের অংশ প্রদর্শন করা নৈতিকভাবে ঠিক কি না, এ নিয়ে দুই বছর ধরে চলা বিতর্কের পর গত সপ্তাহে মিউটার জাদুঘর ঘোষণা করেছে, তারা নতুন নীতি গ্রহণ করেছে। এখন থেকে সংগ্রহশালার জিনিসপত্র ‘প্রসঙ্গভিত্তিকভাবে’ প্রদর্শন করা হবে এবং দাতার পরিচয় জানানো হবে।
জাদুঘরের জ্যেষ্ঠ পরিচালক সারা রে বলেন, ‘বিষয়টি এটা নয় যে মানবদেহের অংশ প্রদর্শন করা আমাদের উচিত, কি উচিত নয়। বরং বিষয়টিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যা ওই মানুষগুলোর প্রতি ন্যায়বিচার করবে ও তাঁদের গল্প তুলে ধরবে। এতে একই সঙ্গে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস, মানবদেহের বৈচিত্র্য এবং চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত সরঞ্জাম ও পদ্ধতির বিকাশও উপস্থাপন করা যাবে।’
১৮৬৩ সালে স্থানীয় শল্য চিকিৎসক টমাস মিউটারের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে প্রতিষ্ঠিত এ জাদুঘরে এখন প্রায় ৩৫ হাজার জিনিসপত্র আছে। এর মধ্যে ছয় হাজার জৈব নমুনা। এখানে দর্শনার্থীরা একসময় মানুষের খুলি, ত্বকের অবস্থার মোমের ছাঁচ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও বিশাল চিকিৎসা গ্রন্থাগার ঘুরে দেখতে পারতেন।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, জাদুঘরটি এখন থেকে শুধু জীবিত দাতা কিংবা তাঁদের বংশধরদের কাছ থেকে সংগ্রহশালার সামগ্রী অনুদান হিসেবে গ্রহণ করবে। এতে তাঁদের শনাক্ত করা যাবে।
২০২০ সালে হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা একজন রোগী তাঁর পুরোনো বড় হয়ে যাওয়া হৃৎপিণ্ডটি জাদুঘরে দান করেন। ফুটবল আকারের সেই অঙ্গ এখন একটি কাচের পাত্রে রাখা হয়েছে। ১৯ শতকের এক অস্ট্রীয় শারীরবিদের সংগ্রহ করা ১৩৯টি মানুষের খুলির পাশে রাখা হয়েছে হৃৎপিণ্ডটি।
২০২৩ সালে নেতৃত্বে পরিবর্তন আসার পর জাদুঘর পোস্টমর্টেম (ময়নাতদন্ত) প্রকল্প শুরু করে। এটা ছিল দুই বছরের জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচি। লক্ষ্য ছিল সংগ্রহশালার উপাদানগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা ও মানবদেহের অংশবিশেষ প্রদর্শনের নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা।
তবে প্রকল্পের অংশ হিসেবে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ইউটিউব চ্যানেল থেকে শত শত ভিডিও মুছে ফেললে দর্শক-সমর্থকদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। কারণ, এ চ্যানেলে ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি ফলোয়ার ছিল। পাশাপাশি জাদুঘরের ওয়েবসাইট থেকে একটি ডিজিটাল প্রদর্শনী মুছে ফেলা হয় এবং জাদুঘরের বার্ষিক হ্যালোইন পার্টি ‘মিসচিফ অ্যাট দ্য মিউটার’ও বাতিল করা হয়।
এ প্রকল্পের উদ্যোক্তা ও জাদুঘরের সাবেক পরিচালক কেট কুইন বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, জাদুঘরকে নাটকীয়ভাবে বদলানো নয়; বরং মানুষকে আলোচনায় নিয়ে আসা।’
জাদুঘরের একজন সাবেক পরিচালক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে তীব্র সমালোচনামূলক একটি প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধে তিনি ‘সংস্কৃতি মুছে ফেলার’ অভিযোগ তুলে বলেন, ‘মুষ্টিমেয় অভিজাতরা জাদুঘরের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করছেন।’
পরে দ্রুত ‘প্রটেক্ট দ্য মিউটার’ নামে একটি গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। কেট কুইনের পদত্যাগের দাবিতে এই গোষ্ঠীর করা অনলাইন আবেদনে ৩৫ হাজারের বেশি স্বাক্ষর জমা পড়ে।
প্রটেক্ট দ্য মিউটারের একজন সংগঠক এএফপিকে বলেন, ‘অনলাইন কনটেন্ট (আধেয়) প্রায় ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছিল, আর কর্মীদের পরিবর্তন ও অনুষ্ঠান বাতিল করা হচ্ছিল।’
এসব বিতর্কের কারণে বিরক্ত হয়ে হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা ওই রোগী একসময় তাঁর দান করা হৃৎপিণ্ড ফেরত চান। তবে জাদুঘরের নিয়মে পরিবর্তন আসার পর তিনি আর এ দাবি করেননি।
জাদুঘরের দোতলা ভবনের বারান্দায় হাঁটলে দর্শকেরা দুটি প্রাপ্তবয়স্ক সিয়ামিজ যমজ (যাদের শরীরের কিছু অংশ জন্ম থেকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত) সন্তানের ঢালাই করা মূর্তি অথবা আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ছোট ছোট টুকরা নিয়ে জানতে পারেন।
এ ছাড়া এখানে খর্বাকৃতির নারী অ্যাশবেরি ও আট ফুট লম্বা অস্বাভাবিক বড় অন্ত্রের মানুষ (সাধারণ মানুষের এ অন্ত্র প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা হয়) উইলিয়ামসের জীবন সম্পর্কেও জানতে পারবেন।
জাদুঘরটির সংগ্রহশালায় থাকা ব্যতিক্রমী সামগ্রীর প্রদর্শন নিয়ে বিতর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্যান্য পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান, যেমন ব্রিটিশ মিউজিয়ামকেও নাড়া দিয়েছে। নৃতত্ত্ববিদ ভ্যালেরি ডেলিওন বলেন, এটা নৈতিকতার বৃহত্তর আলোচনার অংশ।
ভ্যালেরি ডেলিওন বলেন, ‘জাদুঘরে আসা মানুষ ভাবছেন—এ সংগ্রহশালায় প্রদর্শন করা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মানুষেরা কি এখানে থাকতে রাজি হয়েছিলেন? নাকি তাঁদের কঙ্কাল শুধু বিনোদনের জন্য প্রদর্শিত হচ্ছে?’
চলতি বছরের বসন্তে কুইন পদত্যাগ করেন। এরপর নতুন প্রশাসন ইউটিউব চ্যানেলে মুছে ফেলা ভিডিওর ৮০ শতাংশ পুনরুদ্ধার করে। প্রটেক্ট দ্য মিউটারের সদস্যরা এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তবে এরপরও কিছু জটিল প্রশ্ন রয়ে গেছে, যেমন পরিচয়হীন ২ দশমিক ২৯ মিটার লম্বা এক দৈত্যাকৃতির মানবকঙ্কাল নিয়ে কী করা হবে? এটি এখনো শনাক্ত করা যায়নি।
প্রটেক্ট দ্য মিউটারের একজন কর্মী মনে করেন, ওই কঙ্কাল প্রদর্শন করা উচিত। তিনি বলেন, ‘অ্যাক্রোমেগালি (অ্যাক্রোমেগালি হরমোনের আধিক্যের কারণে হওয়া একটি রোগ। এতে গ্রোথ প্লেট বন্ধ হওয়ার পর হাত, পা, কপাল, চোয়াল ও নাক বড় হয়ে যায় এবং অন্যান্য উপসর্গ হিসেবে জয়েন্টে ব্যথা, ত্বক পুরু হওয়া ও কণ্ঠস্বর গভীর হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়) রোগীর এ নমুনা শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রদর্শন করা হোক। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বুঝতে পারে, এটি (অ্যাক্রোমেগালি) এখনো মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে।’