নিউইয়র্কের শ্বেতকায় অধ্যুষিত ফরেস্ট হিলসে পুরোনো একটি স্টেডিয়াম রয়েছে। ৬০ বছর আগে এখানে ব্যান্ড বিটলস সংগীত পরিবেশন করেছিল। সেটাই এই স্টেডিয়ামের সবচেয়ে বড় ঘটনা। একসময় এখানে ইউএস ওপেন টেনিস প্রতিযোগিতা হতো। এখনো ছোটখাটো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বা কনসার্টের আয়োজন হয়। হাজার তেরো মানুষ বসতে পারে। গত রোববার বিকেলে এই স্টেডিয়ামে সম্ভবত তার ইতিহাসের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানটি হয়ে গেল। এটি কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নয়, কোনো কনসার্টও নয়। এটি ছিল নিউইয়র্কের মেয়র পদপ্রার্থী জোহরান মামদানির রাজনৈতিক সমাবেশ।
দৃশ্যটি কল্পনা করুন। মধ্যমঞ্চে ৩৪ বছর বয়সী মামদানি, তাঁর দুই পাশে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচিত দুই বামপন্থী রাজনীতিক বার্নি স্যান্ডার্স (৮৪) ও আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেস (৩৬)। সমাবেশে তিনি শেষ বক্তা। উষ্ণ আলিঙ্গন শেষে সিনেটর স্যান্ডার্স তাঁকে মঞ্চ ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন। স্টেডিয়ামজুড়ে তেরো হাজার মানুষের উল্লাস—মামদানি, মামদানি। অনেকের হাতে আলোকোজ্জ্বল মোমবাতি। আকাশ থেকে যেন হাজারটা তারা মাটিতে নেমে এসেছে, এক দিনের জন্য হলেও সব অন্ধকার, সব নিরাশা দূর করে দিতে।
স্বভাবসুলভ মুখভরা হাসি নিয়ে মামদানি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, কী খবর নিউইয়র্ক সিটি, আপনারা কেমন আছেন? সম্মুখসারি থেকে কেউ একজন উচ্চস্বরে ডেকে উঠলেন, হাবিবি, প্রিয় বন্ধু। নিজের ডান হাতখানা বুকের কাছে নিয়ে উত্তরে মামদানি বললেন, হাবিবি, আপনি কেমন আছেন?
শুধু রাজনৈতিক সমাবেশ দিয়ে যদি নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হতো, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যেত রোববারের এই জনসভার পর জোহরান মামদানি নিউইয়র্ক শহরের মেয়র হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন। ইতিমধ্যে আগাম ভোট শুরু হয়েছে, চূড়ান্ত ভোট ৪ নভেম্বর। কিন্তু এই সমাবেশের উত্তাপ ও উৎসাহ থেকেই বলা সম্ভব, সে নির্বাচনের ফলাফল আমরা পেয়ে গেছি।
যদি সত্যি মামদানি ৮৫ লাখ মানুষের এই শহরের প্রথম দক্ষিণ এশীয় ও প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তা হবে একটি বড়সড় ভূকম্পন। সিএনএন মন্তব্য করেছে, এই বিজয়ের ফলে যে ভূকম্পন ঘটবে, তার ঢেউ নিউইয়র্ক সিটি ছাড়িয়ে ওয়াশিংটন পর্যন্ত আঘাত হানবে।
স্টেডিয়ামজুড়ে তেরো হাজার মানুষের উল্লাস—মামদানি, মামদানি। অনেকের হাতে আলোকোজ্জ্বল মোমবাতি। আকাশ থেকে যেন হাজারটা তারা মাটিতে নেমে এসেছে, এক দিনের জন্য হলেও সব অন্ধকার, সব নিরাশা দূর করে দিতে।
২০২০ সালে প্রথমবার নিউইয়র্কের স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মামদানি। নির্বাচনী রাজনীতিতে সেটাই তাঁর হাতেখড়ি। তিনি একই সঙ্গে ডেমোক্রেটিক ও ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট অব আমেরিকা বা ডিএসএর প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ডেমোক্রেটিক পার্টি মূলত একটি মধ্যপন্থী ও মধ্য-বাম দল, সেখানে একজন খোলামেলা বামপন্থী রাজনীতিকের পক্ষে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।
সিনেটর স্যান্ডার্স নিজেকে ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট বলেন। কিন্তু ডেমোক্রেটিক পার্টিতে তাঁর কোনো স্থান হয়নি। তিনি নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। ডিএসএর সদস্য হিসেবে অন্য যে একমাত্র রাজনীতিক জাতীয় পর্যায়ে নাম লিখিয়েছেন, তিনি হলেন ওকাসিও-কর্তেজ। স্থানীয় পর্যায়ে আরও দু-একজন আছেন, অধিকাংশই ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিষ্ঠানবাদীদের বিরোধিতায় টিকে থাকতে পারেননি। বাফেলো শহরের মেয়র প্রার্থী হিসেবে ডেমোক্রেটিক পার্টি ও ডিএসএর সদস্য ইন্ডিয়া ওয়ালটন বাছাইপর্বে জয়লাভ করেও নিজ দলের অর্থবানদের বিরোধিতার মুখে শেষরক্ষা করতে পারেননি। সেটি ২০২১ সালের কথা। সেই বিপর্যয়ের পর অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন মার্কিন রাজনীতির বড় রকমের পটপরিবর্তন না হলে সোশ্যালিস্ট তকমা মাথায় নিয়ে কারও পক্ষে জাতীয় রাজনীতিতে সফল হওয়া সম্ভব নয়।
ফক্স নিউজকে কুমো বলেছেন, মামদানির জয় হলে নিউইয়র্ক শহর এক সোশ্যালিস্ট শহরে পরিণত হবে। আর সেটা হবে এই শহরের মৃত্যু। তুমি ডেমোক্র্যাট হও বা রিপাবলিকান, এই বিপর্যয় তোমাদের ঠেকাতেই হবে।
সে হিসাব উল্টে দিতে যাচ্ছেন জোহরান মামদানি। অনেকেই বলছেন, মামদানির ভেতর দিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রচলিত রাজনীতি বড় ধরনের বাঁক নিতে যাচ্ছে। এই দল মূলত অতি-প্রবীণ ও অতিসতর্ক মধ্যপন্থী শ্বেতকায় রাজনীতিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই ধারার বিরুদ্ধে প্রথম ধাক্কা দেন ওকাসিও-কর্তেজ ২০১৮ সালে। এখন তাঁর সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছেন মামদানি। তিনি কেবল বয়সে নবীন ও বাদামিরঙা মুসলিম অভিবাসীই নন। তিনি চাঁদার জন্য করপোরেট অফিসে হাত পাতেন না, এখনো ভাড়াবাডিতে থাকেন, সস্তা স্যুট গায়ে দেন ও সাবওয়ে ও বাসে করে অফিসে আসেন। ভাবা হচ্ছে, এমন একজন মানুষের বিজয়ের ভেতর দিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতৃত্বে প্রজন্মগত পরিবর্তন আসতে পারে। সঙ্গে করপোরেট-তোষণ রাজনীতির বড় রকমের পরিবর্তন। একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকার নিউইয়র্ককে ‘ন্যাশনাল ব্যারোমিটার’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সেই ব্যারোমিটার যদি বাঁয়ে হেলে পড়ে, তার প্রভাব যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মামদানি এখনো জয়লাভ করেননি, করবেন তার কোনো নিশ্চয়তাও নেই। এ কথা বলার প্রধান কারণ, তাঁকে লড়তে হচ্ছে নিউইয়র্ক স্টেটের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোর মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিকের বিরুদ্ধে, যাঁর পেছনে শুধু এই রাজ্যের ধনকুবেরেরা ও পুরো ইসরায়েল লবি নয়, খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্ত রয়েছেন। তাঁদের সবার হাতে এই মুহূর্তে রয়েছে একটি মারাত্মক অস্ত্র: ভয়। এঁরা অহোরাত্র এই মন্ত্র জপে যাচ্ছেন যে মামদানি নির্বাচিত হলে এই শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। দুই দিন আগে ফক্স নিউজকে কুমো বলেছেন, মামদানির জয় হলে নিউইয়র্ক শহর এক সোশ্যালিস্ট শহরে পরিণত হবে। আর সেটা হবে এই শহরের মৃত্যু। তুমি ডেমোক্র্যাট হও বা রিপাবলিকান, এই বিপর্যয় তোমাদের ঠেকাতেই হবে।
সবার চেয়ে এককাঠি সরেস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি এই শহরের আদি বাসিন্দা, যেকোনো মূল্যে মামদানিকে ঠেকাতে তিনি বদ্ধপরিকর। মামদানি তাঁর চোখে শুধু কমিউনিস্ট নন, তিনি পাক্কা উন্মাদও বটে। তিনি হুমকি দিয়ে রেখেছেন, এই লোক ক্ষমতায় এলে নিউইয়র্কের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ বাতিল করবেন। তিনি কুমোর সমর্থনে মামদানিবিরোধী একটি কোয়ালিশন গঠনেও সমর্থন দিয়েছেন। তাঁরই চাপাচাপিতে নিউইয়র্কের বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে কুমোর পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেছেন।
শুধু সমাজতন্ত্রী বলেই নয়, গাজার গণহত্যা প্রশ্নে কঠোর অবস্থানের কারণেও মামদানি পেশাদার রাজনীতিকদের বিরাগভাজন হয়েছেন। সে কারণেই ডেমোক্রেটিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখনো তাঁকে মেয়র পদে অনুমোদন দেয়নি। কুমো তাঁকে ইহুদিবিদ্বেষী বলে আক্রমণ করেছেন। মেয়র এরিক অ্যাডামস তাঁকে ‘সোশ্যালিস্ট’ ও ‘কমিউনিস্ট’ হিসেবে আক্রমণ করার পাশাপাশি প্রকারান্তরে ‘ইসলামিস্ট’ বলেও ভর্ৎসনা করেছেন।
মামদানির বিরুদ্ধে দেশের ইহুদি লবিও তৎপর। সারা যুক্তরাষ্ট্রের ৬৫০ জন ইহুদি যাজক এক যৌথ চিঠিতে ‘ইসরায়েল ও ইহুদিবিদ্বেষী’ মামদানিকে নির্বাচিত করার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন।
এই সংঘবদ্ধ আক্রমণের পাশে মামদানির প্রধান শক্তি নিউইয়র্ক শহরের বিপুলসংখ্যক মানুষের, বিশেষত তরুণদের, অভূতপূর্ব সমর্থন। অভিবাসী বাংলাদেশিরাও তাঁর পাশে জোরালোভাবে দাঁড়িয়েছেন। মামদানি নিজেও ‘বাংলাদেশি আন্টি ও আঙ্কেল’–দের জোর সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। সম্ভবত ২০০৮ সালে বারাক ওবামার নির্বাচনী প্রচারের পর এই প্রথম এই শহরের তরুণ প্রজন্ম আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন। তাঁরা বিশ্বাস করা শুরু করেছেন নির্বাচনী রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব। অধিকাংশ সময় ৩০-অনূর্ধ্ব ভোটাররা খুব বড় সংখ্যায় ভোট দিতে যায় না। এবার যদি সে নিয়মের ব্যতিক্রম হয়, তাহলে মামদানির বিজয় ঠেকানো অসম্ভব হবে।
মামদানি নিজেও সে কথা জানেন। রোববার সন্ধ্যায় ফরেস্ট হিলসের উৎফুল্ল তরুণদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘পেশাদার রাজনীতিকদের চোখে তোমরা দেশের ভবিষ্যৎ, কিন্তু আমি বলি তোমরা দেশের বর্তমান।’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাঁর বিলিয়নিয়ার সমর্থকেরা ভাবছেন শুধু টাকা দিয়ে তাঁরা নির্বাচন কিনে নেবেন। কিন্তু আমি বলছি, আমরা জনতার যে আন্দোলন শুরু করেছি, টাকার জোরে তাকে পরাস্ত করা যাবে না। আসুন, আমরা এমন একটি মেয়র অফিস জয় করি, যা কাজ করবে তাদের জন্য, যারা সবজি কেনার জন্য হিমশিম খাচ্ছে—তাদের জন্য নয়, যারা আমাদের গণতন্ত্র কেনার জন্য ছটফট করছে।’