যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার মেরিন ওয়ানে যাওয়ার পথে, ২৪ অক্টোবর ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার মেরিন ওয়ানে যাওয়ার পথে, ২৪ অক্টোবর ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রকে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার নির্দেশে আতঙ্ক-উত্তেজনা, ট্রাম্প আসলে কী চান

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ভাইস অ্যাডমিরাল রিচার্ড কোরেল ভেবেছিলেন, দেশটির পারমাণবিক বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে তাঁর নিয়োগ নিশ্চিত হওয়া নিয়ে গত বৃহস্পতিবার শুনানি সহজভাবেই শেষ হবে। তবে তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণের আগের দিন বুধবার রাত ৯টা ৪ মিনিটে সে আশা ভেঙে গেছে।

ওই সময় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে বিশ্বকে চমকে দেন। বলেন, তিনি মার্কিন বাহিনীকে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা অবিলম্বে শুরু করতে বলেছেন। তাঁর যুক্তি, যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে রাশিয়া ও চীনের পেছনে থাকতে পারে না।

ট্রাম্প বলেন, ‘পারমাণবিক অস্ত্রে রাশিয়া দ্বিতীয় এবং চীন বেশ দূরে তৃতীয় অবস্থানে। কিন্তু দেশটি পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের সমপর্যায়ে উঠে আসতে পারে।’

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সিনেটে সশস্ত্র বাহিনী কমিটির প্রায় ৯০ মিনিটের শুনানিতে ট্রাম্পের মন্তব্য নিয়ে বারবার কোরেলকে প্রশ্ন করা হয়। ট্রাম্পের মন্তব্যে অনেক আইনপ্রণেতাই এ সময় ছিলেন বিভ্রান্ত। এ থেকে বোঝা যায়, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন ও এর বাইরে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন।

মার্কিন কর্মকর্তারা পরিষ্কার করেননি যে ট্রাম্প পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থার পরীক্ষা করতে বলছেন, নাকি বিস্ফোরক পরীক্ষায় ৩৩ বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষ করতে চাইছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ট্রাম্পের নির্দেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে পারে, যা শীতল যুদ্ধের ভয়ংকর স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।

কমিটির শীর্ষ ডেমোক্র্যাট সদস্য সিনেটর জ্যাক রিড কোরেলকে প্রশ্ন করেন, যুক্তরাষ্ট্র আবারও পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা শুরু করলে তা কি বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বাড়াবে এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে।

কোরেল বলেন, ‘যদি আমাকে স্ট্র্যাটেজিক কমান্ডের (স্ট্র্যাটকম) কমান্ডার হিসেবে নিশ্চিত করা হয়, আমার কাজ হবে, পারমাণবিক পরীক্ষাবিষয়ক যেকোনো আলোচনা সম্পর্কে সামরিক পরামর্শ দেওয়া।’

ভাইস অ্যাডমিরাল কোরেলকে গত সেপ্টেম্বরে ট্রাম্প স্ট্র্যাটকমের প্রধান করার জন্য মনোনীত করেন। স্ট্র্যাটকম পারমাণবিক হামলা প্রতিরোধ ও আক্রমণের সক্ষমতা নিয়ে কাজ করে। কোরেল পুরো শুনানিতে সতর্কভাবে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

পারমাণবিক অস্ত্রে রাশিয়া দ্বিতীয় ও চীন বেশ দূরে তৃতীয় অবস্থানে। কিন্তু দেশটি পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের সমপর্যায়ে উঠে আসতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্ট

শুনানির এক পর্যায়ে স্বতন্ত্র সিনেটর অ্যাঙ্গাস কিং প্রশ্ন করেন, ট্রাম্প কি পারমাণবিক ডিভাইসের বিস্ফোরক পরীক্ষা নয়, বরং ক্ষেপণাস্ত্র বা অন্য সরবরাহ ব্যবস্থা পরীক্ষার কথা বলছেন কি না।

জবাবে কোরেল বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্য জানি না, তবে এটি এমন একটি ব্যাখ্যা হতে পারে, আমি তা মেনে নিই।’

দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে গত বৃহস্পতিবার মুখোমুখি বৈঠকে যোগ দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সি চিন পিং

মার্কিন স্থগিতাদেশ

গতকাল মার্কিন কর্মকর্তারা পরিষ্কার করেননি যে ট্রাম্প পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থার পরীক্ষা করতে বলছেন, নাকি বিস্ফোরক পরীক্ষায় ৩৩ বছরের স্থগিতাদেশ শেষ করতে চাইছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ট্রাম্পের নির্দেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে পারে, যা শীতল যুদ্ধের ভয়ংকর স্মৃতি ফিরিয়ে আনে।

অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ট্রাম্প প্রায়ই সমঝোতায় আসতে বাধ্য করার কৌশল হিসেবে শক্তি দেখিয়ে থাকেন। সম্ভবত ওই নির্দেশের মধ্য দিয়ে মস্কো ও বেইজিংকে এমনই একটি বার্তা পাঠাতে চাইছেন তিনি।

ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স বলেন, এ পরীক্ষা করা মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা নিশ্চিত করার অংশ।

যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পারমাণবিক শক্তি দীর্ঘদিন ধরে প্রকৃত পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণ বা পরীক্ষা বন্ধ রেখেছে। পরিবর্তে তারা উন্নত কম্পিউটার সিমুলেশন ব্যবহার করে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রস্তুতি বজায় রেখে চলেছে।

ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েন্টিস্টসের বৈশ্বিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক তারা ড্রোজডেনকো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পারমাণবিক বিস্ফোরকের পরীক্ষা আবার শুরু করার তেমন ভালো কারণ নেই। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সবাইকে কম নিরাপদ করে তুলবে। বোমা পরীক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি অনেক বেশি ও লাভ খুব কম হবে।’

মস্কো ও বেইজিংয়ের প্রতি একটি বার্তা

অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ট্রাম্প প্রায়ই সমঝোতায় আসতে বাধ্য করার কৌশল হিসেবে শক্তি দেখিয়ে থাকেন। সম্ভবত ওই নির্দেশের মধ্য দিয়ে মস্কো ও বেইজিংকে এমনই একটি বার্তা পাঠাতে চাইছেন তিনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত পোস্টে দক্ষিণ কোরিয়ায় চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলেন, তিনি মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনকে ‘সমান ভিত্তিতে (অন্যদের কার্যক্রমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে) পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা অবিলম্বে শুরু করার’ নির্দেশ দিয়েছেন।

১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালায় যুক্তরাষ্ট্র

চলতি শতাব্দীতে শুধু উত্তর কোরিয়া একবার পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে। এটি ২০১৭ সালে। রাশিয়া সাম্প্রতিক দিনগুলোতে পারমাণবিক শক্তিচালিত দুটি নতুন অস্ত্রের পরীক্ষা করেছে। ওয়াশিংটনের ভাষ্য, তারা তথাকথিত ‘কম শক্তির’ পরীক্ষা চালিয়েছে এবং তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা নেই, তবে তারা পূর্ণমাত্রার বিস্ফোরণ ঘটায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পারমাণবিক বিস্ফোরকের পরীক্ষা আবার শুরু করার তেমন ভালো কোনো কারণ নেই। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সবাইকে কম নিরাপদ করে তুলবে। বোমা পরীক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি অনেক বেশি ও লাভ খুব কম হবে।
তারা ড্রোজডেনকো, ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েন্টিস্টসের বৈশ্বিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক

ক্রেমলিনের একজন মুখপাত্র গতকাল জানান, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সতর্ক করেছেন যে যদি কোনো দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়, তবে মস্কোও চালাবে।

আর চীন বারবার মার্কিন প্রশাসনের পারমাণবিক অস্ত্রসংক্রান্ত আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই সঙ্গে তার পারমাণবিক অস্ত্র নাটকীয়ভাবে বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এ নিয়ে তারা রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় খুব একটা আগ্রহী নয়। তাদের যুক্তি, এ দুই দেশের পারমাণবিক শক্তি বর্তমানে অনেক বেশি।

‘কার্নেগি এন্ডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’-এর পারমাণবিক নীতি কর্মসূচির সহপরিচালক জেমস অ্যাকটন বলেন, ‘যদি লক্ষ্য (যুক্তরাষ্ট্রের) চীনের সঙ্গে আলোচনার জন্য চাপ তৈরি করা হয়, আমি মনে করি, তা কাজ করবে না।’

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল জানিয়েছে, তারা আশা করছে, যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষাসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা এবং এ–সংক্রান্ত চুক্তির প্রতিশ্রুতি মেনে চলবে।