যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

ইরান–ইসরায়েল সংঘাত

যুক্তরাষ্ট্র কি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত তীব্রতর হওয়ার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন এই সংঘাতে জড়াবে, নাকি এখনো কূটনৈতিক সমাধানের পথে হাঁটবে, সে বিষয়ে মিশ্র ইঙ্গিত দিচ্ছে।

প্রকাশ্যে ট্রাম্প প্রশাসন সমঝোতার কথা বলছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সমঝোতা আলোচনাকারীরা চলতি সপ্তাহে বসতেও চেয়েছিলেন। গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্পও ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে বলেছিলেন, ‘আমরা একটি কূটনৈতিক সমাধানের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ রয়েছি।’

কিন্তু এর ১৪ ঘণ্টা পর যখন ইসরায়েল ইরানে হামলা শুরু করেছে, ট্রাম্প তখন এক পোস্টে বলেন, তিনি ইরানকে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে ৬০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন এবং সেই সময়সীমা পার হয়েছে। এরপর রোববার ট্রাম্প জোরের সঙ্গে বললেন যে ইসরায়েল ও ইরানের একটি চুক্তি করা উচিত এবং তাঁর সহায়তা নিয়ে দেশ দুটি তা করবে।

সোমবার ট্রাম্প যখন জি–৭ সম্মেলন থেকে আগেভাগে ফেরার জন্য ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে কানাডা ত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সে সময় তাঁর সতর্কবার্তা আশঙ্কা তৈরি করে। তিনি এক পোস্টে বলেন, ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারে না এবং ‘তেহরান থেকে সবাইকে অবিলম্বে সরিয়ে নেওয়া উচিত’! পরে এয়ারফোর্স ওয়ানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের বলেন যে তিনি ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির সমঝোতা আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনে ফিরছেন না। তিনি ‘এর চেয়ে আরও অনেক বড় কিছু’ চান।

ট্রাম্পের এই বক্তব্য ইসরায়েল–ইরান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিকারে কোন মাত্রায় যুক্ত এবং এখানে আসলে দেশটি কী করতে চায়, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

ইরানে ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের যুক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রোববার তিনি ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘আজ রাতে ইরানে যে হামলা হয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’

ট্রাম্প কি যুদ্ধে জড়াবেন?

ইসরায়েলের হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনার ভূপৃষ্ঠের ওপরের অংশ ধ্বংস হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই পারমাণবিক কেন্দ্রে ইউরেনিয়ামকে ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধতায় সমৃদ্ধ করেছে, যা পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশের তুলনায় অনেক বেশি, কিন্তু পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশের নিচে। ইসরায়েলি হামলার কারণে নাতাঞ্জে বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়ে ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)।

কিন্তু আইএইএর মূল্যায়নে, ইসরায়েল ইরানের ফোরদোয় অপর ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। কেন্দ্রটি পাহাড়ের ভূগর্ভে তৈরি করা হয়েছে, এর মূল কক্ষগুলো মাটির নিচে ৮০ থেকে ৯০ মিটার (প্রায় ২৬০ থেকে ৩০০ ফুট) গভীরে। এখানেও ইউরেনিয়ামকে ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধতায় সমৃদ্ধ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক কেলসি ডেভেনপোর্ট বলেন, ইসরায়েল যদি এসব ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় হামলা করতে চায়, তাহলে সম্ভবত তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা দরকার হবে। কারণ, সেখানে ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম বোমা যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আছে।

ডেভেনপোর্ট বলেন, এই সব বোমা দিয়ে বারবার হামলা চালালে ভূগর্ভস্থ ওই সব পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করা সম্ভব। ওয়াশিংটন এখনো এই বোমা ইসরায়েলকে দেয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিন্তুক প্রতিষ্ঠান স্টিমসন সেন্টারের ডিস্টিংগুইশড ফেলো বারবারা স্লেভিনও আল–জাজিরাকে বলেছেন, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস করার যে লক্ষ্যের কথা বলছে, সেটি অর্জন করতে হলে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র দরকার হবে।

বারবারা স্লেভিন বলেন, ‘আমরা জানি যে (ট্রাম্প) বিজয়ীর পাশে থাকতে পছন্দ করেন। এই মুহূর্তে তিনি ইসরায়েলিদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন, সেই কারণে তিনি এই অবস্থান বজায় রাখছেন এবং আমি মনে করি, এটাই (ইসরায়েলের প্রতি) আমাদের একধরনের মৌন সমর্থন।’

শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র একটি বড়সংখ্যক বিমান মধ্যপ্রাচ্যে উড়িয়ে নিয়েছে, যেগুলো মাঝ আকাশে যুদ্ধবিমান ও বোমারু বিমানে জ্বালানি সরবরাহ করে। একই সঙ্গে সোমবার দক্ষিণ চীন সাগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস নিমিটজ মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাত্রা করেছে। গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র ওই অঞ্চলে আরও যুদ্ধবিমান পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।

এ বিষয়ে স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানিয়ান ইতিহাসের অধ্যাপক আলী আনসারি মনে করেন, ইসরায়েলের হামলার প্রাথমিক সফলতার কারণে ট্রাম্প ‘বিজয়ের গর্বের’ ভাগীদার হওয়ার জন্য এই সংঘাতে জড়িত হওয়ার বিষয়ে প্রলুব্ধ হতে পারেন। এতে ইরানের পতন হতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।

আলী আনসারি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ফোরদোয় হামলায় যোগ দিতে পারে, যদিও আমি মনে করি, আমেরিকার হামলার সত্যিকার হুমকিই ইরানিদের আলোচনার টেবিলে আনতে পারে।’ তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কিছু ছাড় দিলে ইরান তা সম্মানের সঙ্গেই মেনে নিতে পারে। কিন্তু ইসরায়েলের কাছে তারা তা পারবে না, যদিও শেষ পর্যন্ত তাদের আর কোনো উপায় না–ও থাকতে পারে।