মাছিটির বৈজ্ঞানিক নাম কোচলিওমিয়া হোমিনিভোরাক্স
মাছিটির বৈজ্ঞানিক নাম কোচলিওমিয়া হোমিনিভোরাক্স

কোটি কোটি মাছি চাষের পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের, ছড়িয়ে দেওয়া হবে উড়োজাহাজ থেকে

উড়োজাহাজ থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি মাছি। চিত্রটি কল্পনা করাই যেন আতঙ্কের। ঠিক এ কাজটিই করার পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। উদ্দেশ্য—‘মাংসখেকোর’ হুমকি থেকে গবাদিপশুদের রক্ষা করা। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চল এই হুমকির মুখে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে।

মাংসখেকো বলা হচ্ছে একধরনের মাছির লার্ভা বা শূককীটকে। ওই মাছির বৈজ্ঞানিক নাম কোচলিওমিয়া হোমিনিভোরাক্স। মাছিটির লার্ভারও একটি নাম রয়েছে—‘নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওর্ম’। এই লার্ভা উষ্ণ রক্তের প্রাণীর ক্ষতস্থানে বাসা বাঁধে। আর জীবিত অবস্থায়ই ওই প্রাণীর মাংস খাওয়া শুরু করে।

২০২৩ সালের শুরুর দিক থেকে এই লার্ভা মধ্য আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, বেলিজ ও এল সালভাদরে এর উপদ্রব দেখা যায়। গত নভেম্বরে এই লার্ভা মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলে পৌঁছে যায়। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত এলাকায় গবাদিপশু, ঘোড়া ও বাইসন বাণিজ্যে ব্যবহৃত হয়—এমন কয়েকটি বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়।

গরুর ক্ষতস্থানে চিকিৎসা দিচ্ছেন এক খামারি

তবে পোকা দিয়ে পোকা দমনের প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথম নয়। ষাট ও সত্তরের দশকে নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওর্ম দমনে প্রজননে অক্ষম পুরুষ মাছি চাষ করা হয়েছিল দেশটিতে। তারপর স্ত্রী মাছির সঙ্গে মিলনের জন্য সেগুলো উড়োজাহাজ থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুরুষ মাছি প্রজননে অক্ষম হওয়ায় স্ত্রী মাছি ডিম পাড়তে পারে না। ফলে বংশবিস্তার হয় না।

সেবার যুক্তরাষ্ট্রে এই পদ্ধতি বড় সফলতা পেয়েছিল। তাই বর্তমানে তা আবারও কাজে লাগাতে চাচ্ছেন দেশটির আইনপ্রণেতারা। প্রজননে অক্ষম মাছি চাষ করতে গত ১৭ জুন চিঠি পাঠান ৮০ জন মার্কিন আইনপ্রণেতা। পরের দিনই যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয়, এই মাছি চাষের জন্য মেক্সিকো–টেক্সাস সীমান্তের কাছে একটি ‘কারখানা’ নির্মাণ করা হবে।

টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফিলিপ কাফম্যান বলেন, বিরল হলেও নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওর্ম মানুষকে আক্রান্ত করেছে—এমন তথ্যও পাওয়া গেছে।

‘মানুষকেও আক্রান্ত করতে পারে’

টেক্সাস এঅ্যান্ডএম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফিলিপ কাফম্যান বলেন, নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওর্ম নামের লার্ভা ঘোড়া ও গরুসহ বেশির ভাগ উষ্ণ রক্তের প্রাণীর মাংস খেয়ে থাকে। গবাদিপশুকে আক্রমণও করে থাকে এই লার্ভা। বিরল হলেও নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওর্ম মানুষকে আক্রান্ত করেছে—এমন তথ্যও পাওয়া গেছে।

কোচলিওমিয়া হোমিনিভোরাক্স মাছি কীভাবে বংশবিস্তার করে, তার একটি ধারণা দিয়েছেন কাফম্যান। তিনি বলেন, পুরুষ মৌমাছির সংস্পর্শে আসার পর জীবিত কোনো প্রাণীর ক্ষতস্থানে বসে এই মাছি। তারপর সেখানে ২০০ থেকে ৩০০টি ডিম পাড়ে। ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়। এর পরপরই লার্ভাগুলো ওই প্রাণীর মাংস খাওয়া শুরু করে। এরপর একপর্যায়ে সেগুলো পূর্ণ মাছিতে পরিণত হয়।

লার্ভায় আক্রান্ত হওয়া ঠেকাতে এখন পর্যন্ত কোনো টিকা আবিষ্কার হয়নি। টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের পশুস্বাস্থ্য কমিশনের উপনির্বাহী পরিচালক থমাস ল্যানসফোর্ড বলেন, আক্রান্ত পশুগুলোর চিকিৎসার জন্য সেগুলোকে প্রায়ই পরিষ্কার করতে হয়, ক্ষতস্থানে অ্যান্টিসেপটিক দিতে হয় এবং ক্ষতস্থান ঢেকে রাখতে হয়। চিকিৎসা না দিলে আক্রান্ত পশু এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে মারা যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে মাছি তৈরির জন্য টেক্সাসের হিডালগো এলাকায় মুর বিমানঘাঁটির কাছে একটি স্থাপনা গড়ে তোলা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মেক্সিকোর একটি পশুর খামার

খরচটা কম নয়

অধ্যাপক ফিলিপ কাফম্যান বলেন, স্ত্রী মাছিগুলো ২০ দিনের মতো বেঁচে থাকে। এ সময় সেগুলো পুরুষ মাছির সঙ্গে মাত্র একবার মিলিত হয়। প্রজননে অক্ষম পুরুষ মাছির সঙ্গে স্ত্রী মাছির মিলনের ফলে নতুন করে বংশবিস্তার না হলে কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে এর উপদ্রব শেষ হয়ে যেতে পারে।

নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওর্ম দমনে যুক্তরাষ্ট্র ও পানামার যৌথ কমিশন ‘সিওপিইজি’–এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে তারা প্রায় ১০ কোটি মাছি উৎপাদন করে এবং মেক্সিকোসহ মধ্য আমেরিকার আক্রান্ত এলাকাগুলোয় উড়োজাহাজ থেকে ছেড়ে দেয়। সেখানেই এই মাছির লার্ভার উপদ্রব শনাক্ত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে মাছি তৈরির জন্য টেক্সাসের হিডালগো এলাকায় মুর বিমানঘাঁটির কাছে একটি স্থাপনা গড়ে তোলা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেখানে উৎপাদন থেকে শুরু করে মাছি অবমুক্ত করা পর্যন্ত কাজে প্রতিবারে ৮৫ লাখ ডলার খরচ হতে পারে। তবে ওই স্থাপনাটি নির্মাণে কত খরচ হবে, তা প্রকাশ করা হয়নি। মার্কিন আইনপ্রণেতাদের ধারণা, তা কমবেশি ৩০ কোটি ডলার হতে পারে।

টেক্সাসের গবাদিপশু পালনকারী স্টিফেন ডিয়েবেল বলেন, হয়তো এই পরিকল্পনাটা ব্যয়বহুল। তবে এই অর্থের বিনিময়ে কয়েক শ কোটি ডলারের পশুপালন শিল্প রক্ষা পাবে।