যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন

ফিরে দেখা

যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি চার মেয়াদ ক্ষমতায় ছিলেন

ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের মতো যুক্তরাষ্ট্রে আর কোনো ব্যক্তি চারবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। সর্বশেষ ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে তিনি চতুর্থ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি চতুর্থ মেয়াদে তিনি শপথ নেন। তাঁকে নিয়ে আজকের আয়োজন।

মহামন্দা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে তুলেছিলেন তিনি, ছিলেন আজকের জাতিসংঘের স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর নেতৃত্বেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানি ও অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে জয়ের পথে হেঁটেছিল মিত্রশক্তি। সব শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে তিনি টানা চারবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তিনি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি টানা চারবার ক্ষমতায় বসেছেন, টানা ১২ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। রুজভেল্ট সবচেয়ে দীর্ঘ সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সাধারণত, আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ব্যক্তির দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হওয়ার রীতি নেই। অবশ্য রুজভেল্ট চারবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর একই ব্যক্তির সর্বোচ্চ দুবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার বিষয়টি আইনে পরিণত করা হয়।

শৈশব

জেমস ও সারা রুজভেল্ট দম্পতির ঘরে ১৮৮২ সালে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক শিশু। তার নাম রাখা হয় ফ্রাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট। নিউইয়র্কের ধনী ব্যবসায়ী জেমস অনেক জমির মালিক ছিলেন। তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সারা ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। একমাত্র সন্তান রুজভেল্টকে নিয়ে মেতে থাকতেন সারা। শৈশবে বাড়িতেই গৃহশিক্ষকের কাছে লেখাপড়া শুরু করেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট।

১৪ বছর বয়সে গ্রোটন স্কুলে যাওয়া শুরু করেন রুজভেল্ট। বাড়ির বাইরে এই প্রথম তাঁর ঠিকঠাক স্কুলে যাওয়া শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অভিজাত প্রাইভেট স্কুলের একটি গ্রোটন স্কুল। ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরা ওই স্কুলে লেখাপড়া করে থাকে। সেখানে লেখাপড়া শেষে ১৯০০ সালে রুজভেল্ট হার্ভার্ড কলেজে যান। সেখানেই আনা এলেনরের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় এবং তাঁরা বিয়ে করেন।

পোলিওতে আক্রান্ত

১৯২১ সালে কানাডার কাম্পোবেজো দ্বীপে পারিবারিক কটেজে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন রুজভেল্ট। নিজের প্রমোদতরিতে করে ফান্ডি উপসাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। সেখানে হঠাৎ তিনি প্রমোদতরি থেকে নিচের বরফশীতল পানিতে পড়ে যান। প্রচণ্ড ঠান্ডায় প্রাথমিকভাবে তাঁর শরীর অসাড় হয়ে পড়েছিল। এরপর তাঁর পিঠে ব্যথা শুরু হয়। তৃতীয় দিন থেকে তিনি দুই পায়ে আর জোর পাচ্ছিলেন না। এমনকি দাঁড়াতেও পারছিলেন না।

নানা পরীক্ষা করেও চিকিৎসকেরা রুজভেল্টের অসুস্থতা ধরতে পারছিলেন না। অবশেষে ওই বছর ২৫ আগস্ট চিকিৎসক রবার্ট লাভেট জানান, রুজভেল্ট পোলিওতে আক্রান্ত হয়েছেন। রুজভেল্টের বয়স তখন ৩৯ বছর।

সাধারণত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা পোলিওতে আক্রান্ত হয়। কিন্তু রুজভেল্টের মতো একজন মাঝবয়সী মানুষ কীভাবে এ রোগে আক্রান্ত হলেন? এর ব্যাখ্যায় চিকিৎসক লাভেট বলেছিলেন, পোলিওমাইলাইটিসের ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করলে তার সঙ্গে লড়াই করার জন্য ব্যক্তিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হতে হয় এবং দেহের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী হতে হয়। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণে রুজভেল্ট যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক চাপের মধ্যে আছেন, তাই তাঁর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। রুজভেল্টের মা তাঁকে রাজনীতি ছেড়ে দিতে বলেন।

১৯৩৩ সালে প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট

রাজনীতিতে ফিরে আসা

শারীরিক অক্ষমতার কারণে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান রুজভেল্ট। শুরু হয় তাঁর নিজেকে সুস্থ করে তোলার সংগ্রাম। নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে তিনি নিয়মিত সাঁতার কাটা ও ব্যায়াম শুরু করেন। এমনকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া সময়ও তিনি ব্যায়াম করে যেতেন। নিজের জেদ, চেষ্টা ও ধৈর্যের জোরে ধীরে ধীরে হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে শুরু করেন রুজভেল্ট। একসময় তিনি রাজনীতিতেও ফিরে আসেন। তাঁকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে স্ত্রী আনা এলেনর রুজভেল্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ব্যক্তিগত মহলে রুজভেল্ট হুইলচেয়ার ব্যবহার করতেন। কিন্তু জনসসক্ষে তিনি নানাভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতেন। অন্য একজনের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটার কসরতও শিখে নিয়েছিলেন তিনি। ১৯২৮ সালে রুজভেল্ট নিউইয়র্কের গভর্নর নির্বাচিত হন।

মহামন্দার মধ্যে প্রথমবার দায়িত্ব গ্রহণ

১৯৩২ সালের নভেম্বরে রুজভেল্ট যখন প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন মহামন্দায় পর্যুদস্ত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। পরের বছর মার্চের আগেই দেশটিতে বেকারের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখে পৌঁছায়, প্রায় সব ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের প্রথম ১০০ দিনে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে রুজভেল্ট একের পর এক প্রস্তাব করেছেন এবং কংগ্রেসে তা অনুমোদন দিয়ে গেছে।

রুজভেল্টের চেষ্টায় ১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি অনেকটা ঘুরে দাঁড়ায়। নানা বিভাগে সংস্কারের উদ্যোগ দেশজুড়ে সাধারণ মানুষের কাছে রুজভেল্টের জনপ্রিয়তা বাড়ায়; যদিও ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা দিন দিন তাঁর বিপক্ষে চলে যেতে থাকেন। দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ভূমিকার কারণে ১৯৩৬ সালে বিপুল ভোটে জিতে দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন রুজভেল্ট। নিজের দ্বিতীয় মেয়াদেও দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কাজ করে গেছেন রুজভেল্ট।

তৃতীয়বার ভোটে জয় এবং সংবিধানের ২২তম সংশোধন

রুজভেল্ট যখন নিজের তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন, তখনো মহামন্দার প্রভাব পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। হিটলারের জার্মানি ফরাসি বাহিনীকে পরাজিত করে ফেলেছে।

দেশে ও দেশের বাইরের অস্থির ওই সময়ই রুজভেল্টের সামনে রীতি ভেঙে তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দুয়ার খুলে দিয়েছিল। বিশ্বাস করা হয়েছিল, অস্থিতিশীল ওই পরিস্থিতির সঙ্গে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তিনিই দেশে ও দেশের বাইরে স্থিতিশীলতা ফেরাতে পারবেন।

১৯৪০ সালের জুলাইয়ে তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন রুজভেল্ট। তাঁর ওই সিদ্ধান্ত দলের ভেতরেই অনেককে অসন্তুষ্ট করেছিল। তবে সব পেছনে ফেলে সে বছর ৫ নভেম্বরের ভোটে জিতে যান রুজভেল্ট। তৃতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে ইতিহাস গড়েন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোনো একজন ব্যক্তির টানা তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার নজির সেটিই প্রথম। রুজভেল্ট সে বছর ভোটে জেতার প্রায় এক দশক পর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংশোধন করে একজন ব্যক্তির দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হওয়া আটকে দেওয়া হয়।

১৯৪০ সালে বিরোধী রিপাবলিকান পার্টি থেকে বর্তমান প্রেসিডেন্টের তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিরুদ্ধে ঘোরতর আপত্তি তোলা হয়েছিল। কিন্তু ডেমোক্র্যাটদের যুক্তি ছিল, রিপাবলিকান প্রার্থী ওয়েন্ডেল উইলকি যোগ্য প্রার্থীই নন। তাঁরা উইলকিকে ‘তৃতীয় শ্রেণির’ প্রার্থী বলে বর্ণনা করেছিলেন।

নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিকে এসে রুজভেল্ট জোরের সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ইউরোপের যুদ্ধ থেকে আমেরিকাকে তিনি বাইরে রাখবেন। জনগণ তাঁর ওই প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখেছিল এবং তিনি ভোটে সহজ জয় পান।

প্রতিশ্রুতিমতো রুজভেল্ট আমেরিকাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে সরিয়েই রেখেছিলেন। কিন্তু খুব বেশি দিন তিনি নিজের এই প্রতিশ্রুতি ধরে রাখতে পারেননি। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবারে আক্রমণ করে বসে যুদ্ধে জার্মানির পক্ষ নেওয়া জাপান। হঠাৎ আক্রমণের শিকার হলেও বিস্ময়ের ঘোর কাটতে যুক্তরাষ্ট্রের খুব বেশি সময় লাগেনি। পার্ল হারবার আক্রান্ত হওয়ার পরদিন জাতীয় বেতারে এক ভাষণে রুজভেল্ট ‘দিনটি ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে থাকবে বলে’ ঘোষণা দেন।

সর্বশক্তি নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। এ যুদ্ধ করতে ১ কোটি ৬০ লাখ আমেরিকান পুরুষকে জড়ো করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৪ লাখ ৫ হাজার প্রাণ হারান। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ও নৌবাহিনীর প্রধান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিজের এই সাংবিধানিক দায়িত্ব ভালোভাবেই পালন করেছেন রুজভেল্ট। তিনি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্তালিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্ব গড়ে তোলেন। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের অস্ত্র এবং যুদ্ধসরঞ্জাম সরবরাহ করে অ্যাডলফ হিটলারের জার্মানিকে হারাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে সময় এক ভাষণে রুজভেল্ট বলেছিলেন, বাক্‌স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, ইচ্ছার স্বাধীনতা ও ভয় থেকে মুক্তির জন্য তিনি এই যুদ্ধকে বেছে নিয়েছেন।

ইয়াল্টা সম্মেলনে তিন বিশ্বনেতা—উইনস্টন চার্চিল, ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ও জোসেফ স্তালিন

কেন চতুর্থবার নির্বাচন করলেন অসুস্থ রুজভেল্ট

শৈশব থেকেই হাঁপানি ছিল রুজভেল্টের। ছোটবেলায় প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। মাঝবয়সে আক্রান্ত হন পোলিওতে। ভঙ্গুর স্বাস্থ্য নিয়ে তিন মেয়াদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। নিজে ঠিকমতো হাঁটতে না পারলেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে মহামন্দা থেকে দেশের অর্থনীতিকে টেনে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। একটি বিশ্বযুদ্ধ সামলেছেন। এত কিছু সামলাতে গিয়ে রুজভেল্টের স্বাস্থ্যের তখন একেবারে নাজুক দশা।

১৯৪৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের দ্বাদশ বছরে পদার্পণ করেন রুজভেল্ট। দুয়ারে কড়া নাড়ছে আরও একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এদিকে রুজভেল্টের সামনে বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধে অক্ষশক্তিকে শুধু হারালেই চলবে না; যুদ্ধের পর দীর্ঘমেয়াদি শান্তি বজায় রাখতে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্য মিত্রদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে হবে। তিনি এসব কাজ শুরুও করেছিলেন। কিন্তু কয়েক মাস ধরে তাঁর শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছিল। বিশেষ করে ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বরে তেহরান কনফারেন্স থেকে ফেরার পর মারাত্মক সর্দিকাশিতে আক্রান্ত হন রুজভেল্ট। তাঁর ওজন কমতে থাকে, তিনি সব সময় ক্লান্ত থাকতেন।

১৯৪৪ সালের ২৮ মার্চ রুজভেল্টের বিস্তারিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় কী রোগ ধরা পড়েছে, তা সে সময় প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু পরে তাঁর সে সময়ের চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, ৬২ বছর বয়সী রুজভেল্টের ফুসফুস খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। উচ্চ রক্তচাপ ও ব্রঙ্কিওলাইটিস ধরা পড়েছিল। তবে সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা ধরা পড়েছিল হৃদ্‌যন্ত্রে।

সে সময় চিকিৎসাবিজ্ঞান এতটা উন্নত ছিল না। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের কোনো ওষুধও ছিল না। একমাত্র উপায় ছিল জীবনযাপনে নিয়ন্ত্রণ আনা। সে সময় চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, রুজভেল্টের শারীরিক অবস্থা আরও চার বছর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করার উপযুক্ত নয়। এ দায়িত্ব তাঁর শরীরের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করবে।

কিন্তু রুজভেল্টকে তখন ক্ষমতার নেশায় পেয়ে বসেছে। চিকিৎসকদের সতর্কবাণী উপেক্ষা করে দুর্বল শরীরেই তিনি দলীয় মনোনয়ন গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন।

শুধু রুজভেল্টের স্বাস্থ্য নয়, বরং সেবার তাঁর রানিং মেট বেছে নেওয়া নিয়েও ডেমোক্রেটিক পার্টিতে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। নিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট হেনরি ওয়ালেসকে বাদ দিয়ে রুজভেল্ট সেবার রানিং মেট হিসেবে বেছে নেন হ্যারি এস ট্রুম্যানকে। দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়েই নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যেতে থাকেন। জনগণের সামনে নিজেকে যথেষ্ট সুস্থ দেখাতেও সক্ষম হন। আগের তিনবারের মতো ভোট না পেলেও ঠিকই জিতে যান রুজভেল্ট।

প্রথমবার হুইলচেয়ারে জনসমক্ষে

১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে ইয়াল্টা সম্মেলনে যোগ দিতে ১৪ হাজার মাইল উড়ে যান রুজভেল্ট। সেখানে নানা বিষয় নিয়ে তিনি এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল নানা বিষয়ে সোভিয়েত নেতা স্তালিনের সঙ্গে রীতিমতো বিরোধে জড়ান। ওই সম্মেলন থেকে ফেরার পরদিন ১ মার্চ কংগ্রেসের সামনে সম্মেলনের প্রতিবেদন দিতে আসেন তিনি। নিজের ১২ বছরের প্রেসিডেন্ট–জীবনে প্রথমবারের মতো হুইলচেয়ারে করে জনসমক্ষে আসেন রুজভেল্ট, হুইলচেয়ারে বসেই ভাষণ দেন।

মার্চের শেষ দিকে অবকাশযাপনে ওয়াশিংটন থেকে জর্জিয়া যান রুজভেল্ট। সেখানেই ১২ এপ্রিল মারা যান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার মাত্র ৮২ দিন পর। মৃত্যুর কারণ মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ।

আরও যেসব বিতর্ক

রীতি ভেঙে দুবারে বেশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়া ছাড়াও রুজভেল্টকে ঘিরে আরও কিছু বিতর্ক ছিল। বলা হয়, তাঁর হাত ধরেই বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র আণবিক বোমা তৈরির যাত্রা শুরু হয়েছিল।

বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯৩৯ সালের আগস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সে চিঠির জেরে যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা শুরু হয়েছিল আণবিক বোমা তৈরির কাজ, যেটি ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’ নামে পরিচিত। ওই প্রকল্পের ফসলই ছিল পরমাণু বোমা। রুজভেল্টের মৃত্যুর কয়েক মাস পর ১৯৪৫ সালের আগস্টে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে দুটো আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। এ বোমার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছিল।