জোহরান মামদানির প্রচারের ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহজেই নজর কাড়ে। উজ্জ্বল রঙে ভরা ভিডিওগুলো আধেয়ের ভিড়েও আলাদা হয়ে ওঠে
জোহরান মামদানির প্রচারের ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহজেই নজর কাড়ে। উজ্জ্বল রঙে ভরা ভিডিওগুলো আধেয়ের ভিড়েও আলাদা হয়ে ওঠে

যুক্তরাষ্ট্রে প্রার্থীরা কীভাবে জোহরান মামদানির প্রচার কৌশল কাজে লাগাচ্ছেন

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির নতুন মেয়র জোহরান মামদানি ৪ নভেম্বরের নির্বাচনে এক বিশেষ অনলাইন প্রচার কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। এটি এখন ডিজিটাল যুগের প্রার্থীদের জন্য অনুকরণীয় মডেল হয়ে উঠেছে।

২০২৫ সালের প্রচার-প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রার্থী ক্যামেরার দিকে ঝুঁকে কথা বলছেন, হাত নাড়ছেন, হাঁটতে হাঁটতে ব্যস্ত রাস্তা বা দোকানের ভেতর কথা বলছেন। ভিডিওগুলোতে উষ্ণ রঙের আলো বা ‘ওয়ার্ম ফিল্টার’ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ছবিকে প্রাণবন্ত করে তুলছে। প্রার্থীরাও এক নিঃশ্বাসে বলছেন নানা প্রতিশ্রুতি ও নীতির কথা।

নিচে দেখা যাক, কীভাবে কিছু ডেমোক্র্যাট প্রার্থী অনলাইনে জোহরান মামদানির কৌশল অনুসরণ করছেন।

মামদানির নান্দনিক ধরন

মামদানির ভিডিওগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো এর উজ্জ্বল ও দীপ্তিময় রং। এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আধেয়ের ভিড়ের মধ্যেও সহজেই চোখে পড়ে।

এসব ভিডিওতে থাকে দ্রুত দৃশ্যের পরিবর্তন আর বড় বড় হাতের অঙ্গভঙ্গি। এক ভিডিওতে মামদানি নিজেই মজা করে বলছিলেন, ‘আমার টিম বলে, আমি নাকি হাত বেশি নাড়ি!’

মামদানির ভিডিওগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো এর উজ্জ্বল ও দীপ্তিময় রং। এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আধেয়ের ভিড়ের মধ্যেও সহজেই চোখে পড়ে।

এ ধরন সফল হয়েছে অন্য অনেক ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর ক্ষেত্রেও। মিশিগানের ডেমোক্রেটিক সিনেট প্রাইমারির দুই প্রগতিশীল প্রার্থী এর ভালো উদাহরণ।

ডেট্রয়েটের সাবেক জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা আবদুল এল-সায়েদ একটি ভিডিও বানিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ‘বার্গার’ ব্যবহার করে বিলিয়নিয়ারদের অতিরিক্ত ভোগবিলাস বোঝান, যেমন মামদানি একটি ভিডিওতে ‘ম্যাঙ্গো লাসিস’ (দক্ষিণ এশীয় একটি জনপ্রিয় পানীয়) দিয়ে নিউইয়র্কের ‘র‍্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং’ ব্যাখ্যা করেছিলেন।

অন্যদিকে, মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেমোক্র্যাট সিনেটর ম্যালরি ম্যাকমরো তৈরি করেছিলেন এমন একটি ভাইরাল ভিডিও, যেখানে তিনি নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে কথা বলেন। এটি মামদানির বডেগা বা ছোট দোকান ভ্রমণের দৃশ্যগুলো মনে করিয়ে দেয়।

ম্যাকমরো ও টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য জেমস টালারিকোর (২০২৬ সালের সিনেট নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী) উপদেষ্টা ডেমোক্র্যাট কৌশলবিদ অ্যান্ড্রু মামো বলেন, ভিডিওর ভিজ্যুয়াল আকর্ষণই এখন মূল বিষয়।

প্রচার কৌশলটা প্রকৃতপক্ষে মূল বিষয় থেকে জন্ম নেয়। যদি এমন কোনো বার্তা ও কর্মসূচি না থাকে, যা মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, যা দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে কথা বলে, যা এই ভাঙা ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য কিছু উপস্থাপন করে—তাহলে সেটি কাজ করবে না।
অ্যান্ড্রু এপস্টাইন, জোহরান মামদানির প্রচার শিবিরের শীর্ষ সহযোগী

অ্যান্ড্রু মামো বলেন, ‘আপনি শুধু প্রাইমারিতে অন্য ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা করছেন না। আপনি প্রতিযোগিতা করছেন রিপাবলিকানদের সঙ্গেও নয়; বরং কুকুরের ভিডিও, খেলাধুলার হাইলাইটস, নেটফ্লিক্সে চলা শো, ফেসটাইম কল, গ্রুপ চ্যাট—সবকিছুর সঙ্গেই। এখন ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব—সব স্ক্রিনে দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণের লড়াই।’

মূলবার্তা: জীবনযাত্রার খরচ

মামদানির প্রচার শিবির বলছে, শুধু ভিজ্যুয়াল নয়, তাঁর সফলতার মূলে ছিল ‘সহনীয় জীবনযাত্রার খরচ’কে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক বার্তা।

প্রচার শিবিরের শীর্ষ সহযোগী অ্যান্ড্রু এপস্টাইন বলেন, ‘প্রচার কৌশলটা প্রকৃতপক্ষে মূল বিষয় থেকে জন্ম নেয়। যদি এমন কোনো বার্তা ও কর্মসূচি না থাকে; যা মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, যা দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে কথা বলে, যা এই ভাঙা ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য কিছু উপস্থাপন করে—তাহলে সেটি কাজ করবে না।’

মামদানির প্রচার শিবির বলছে, শুধু ভিজ্যুয়াল নয়, তাঁর সফলতার মূলে ছিল ‘সহনীয় জীবনযাত্রার খরচ’কে কেন্দ্র করে ধারাবাহিক বার্তা।

আবদুল এল-সায়েদের যোগাযোগ পরিচালক রক্সি রিচনারও মামদানির দলের মতোই বিষয়বস্তুর গুরুত্বের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত মানুষ আসলে বিষয়বস্তুকেই গুরুত্ব দেয়। যেমন এল-সায়েদ এক ভিডিওতে মিশিগানের বে সিটির সেতুগুলো কীভাবে বেসরকারিকরণ করা হয়েছে, সেটি এমনভাবে বুঝিয়েছেন যে সাধারণ মানুষও সহজেই ধরতে পেরেছেন; এমনকি যাঁরা অন্য অঞ্চলের, তাঁরাও নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন।’

রাজনীতিকদের মধ্যে এখন অর্থনীতি নিয়ে ভোটারদের উদ্বেগের প্রসঙ্গে কথা বলা নতুন কিছু নয়। কিন্তু কৌশলবিদেরা বলছেন, মামদানি দেখিয়েছেন, কীভাবে বিষয়টি নির্দিষ্ট ও বাস্তব করে তুলতে হয়, যেমন বাড়িভাড়া, বাসভাড়া বা দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম।

অ্যান্ড্রু মামো বলেন, ‘প্রচারে শুধু সার্বিক “অর্থনৈতিক সংকট” নিয়ে কথা বললে হবে না। এটা এমন হতে হবে যে, “আমার নতুন ডিওডোরেন্ট দরকার, দাম ১৩ দশমিক ৯৯ ডলার। ডিওডোরেন্টের দাম এত কবে হলো?” বলতে হবে এভাবে। আপনি যদি কোথাও বসে কাউকে বলতেন, এমন করেই বলতেন। তাই ভিডিওতেও একইভাবে বলা উচিত, যেমন আপনি প্রতিবেশী বা অপরিচিত কাউকে সরাসরি বুঝিয়ে বলতেন।’

এবারের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করেছে, ডেমোক্র্যাট পার্টির এখন প্রয়োজন এমন দক্ষ বক্তা ও যোগাযোগকারীদের, যাঁরা সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারেন।
রক্সি রিচনার, মিশিগানের ডেমোক্রেটিক সিনেট প্রাইমারির প্রগতিশীল প্রার্থী আবদুল এল-সায়েদের যোগাযোগ পরিচালক

অনুকরণ, অনুলিপি নয়

এই গ্রীষ্মে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে মামদানির কাছে হেরে যাওয়ার পর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুমোও হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা এবং মৃদু আলোতে ফিল্টার করা ভিডিও বানাতে শুরু করেন। মামদানির দল তা খেয়াল করেছে।

অ্যান্ড্রু এপস্টাইন বলেন, ‘বলা হয়, অনুকরণই নাকি প্রশংসার সেরা রূপ। কিন্তু অ্যান্ড্রুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা প্রশংসার চেয়ে অনেক বেশি করুণ।’

অন্য কৌশলবিদেরা বলছেন, প্রচারে সত্যিকারের বিশ্বাসযোগ্যতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নানা প্রান্তের প্রার্থীদের পটভূমি, ইস্যু ও বাস্তবতা আলাদা।

মামো বলেন, ‘এটা (প্রচার কৌশল) আপনার নিজের মতো হতে হবে।’ তিনি উদাহরণ দেন ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর অ্যাডাম শিফের। তিনি একজন আইনজীবী, অধ্যাপক, ব্যাখ্যাকার। তাই তাঁর ভিডিওতেও সেই ‘আইনজীবী-অধ্যাপক-ব্যাখ্যাকার’ স্টাইলটা থাকে। অ্যাডাম শিফ যেমন কংগ্রেসে কী হচ্ছে, সেটি বুঝিয়ে থাকেন।

রক্সি রিচনার বলেন, এবারের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করেছে, ডেমোক্র্যাট পার্টির এখন প্রয়োজন এমন দক্ষ বক্তা ও যোগাযোগকারীদের, যাঁরা সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারেন।

রিচনার বলেন, ‘হোক সেটা নিউ জার্সিতে বিদ্যুতের বিল কমানো কিংবা নিউইয়র্কে বাস দ্রুত ও বিনা ভাড়ায় চালানো। মানুষ এখন কষ্টে আছে। তাঁরা বিশ্বাস করতে চান, পরিস্থিতি বদলাতে পারে। আর সেই বিশ্বাস জাগাতে দরকার এমন নেতাদের, যাঁরা তা দেখাতে পারেন।’