ভাগনারবিদ্রোহ কি মস্কো–বেইজিং সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে

সি চিন পিং ও ভ্লাদিমির পুতিন
ফাইল ছবি: এএফপি

ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের বিদ্রোহকে ঘিরে নিজের শাসনামলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এরপরও দেশটির সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আগের মতোই শক্তপোক্ত দেখা গেছে। তবে বিশ্লেষকদের অনেকের ধারণা, সম্পর্ক অটুট থাকলেও পুতিন ও তাঁর সরকারের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা নিয়ে আরও সতর্ক হবে বেইজিং।

ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন গত শনিবার রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মস্কোর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। দক্ষিণ রাশিয়ার রোস্তভ-অন-দনসহ বেশ কয়েকটি শহর দখল করে নেন তাঁরা। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে রাশিয়ার অনেক মিত্রদেশ মুখ খোলেনি। বর্তমানে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনও একই পথ অবলম্বন করেছে।

২০১৩ সালে সি চিন পিং ক্ষমতায় আসার পর রাশিয়া ও চীন কাছাকাছি এসেছে। পুতিনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের জন্যই এটা হয়েছে। আর একটা কারণ, প্রভাবশালী এ দুই বিশ্বনেতাই যুক্তরাষ্ট্রকে শত্রু হিসেবে দেখেন।

তবে বিদ্রোহ থেকে ভাগনার পিছু হটার এবং প্রিগোশিন বেলারুশে নির্বাসনে যেতে রাজি হওয়ার পর একটি বিবৃতি দিয়েছিল চীন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, রাশিয়ায় যা ঘটেছে, তা পুরোপুরি ‘দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়’। আরও বলা হয়, ‘দেশের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে এবং উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনে’ মস্কোর যে প্রচেষ্টা, তা সমর্থন করে চীন সরকার‍।

এসব বক্তব্য দিয়ে চীন সরকার ভাগনারের বিদ্রোহকে যতই ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন, রাশিয়া নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংসহ অন্য শীর্ষ কর্মকর্তারা কিছুটা ঘাবড়ে গেছেন বলে মনে করছেন এলিজাবেথ উইশনিক। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ওয়েদারহেড ইস্ট এশিয়ান ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ এই গবেষকের মতে, কয়েক দিন আগে রাশিয়ায় যে ঘটনা ঘটেছে, তা সি চিন পিংয়ের জন্য হয়তো খুবই উদ্বেগের হবে। ওই ঘটনার ফলে রুশ সরকারের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এটা চীনের প্রেসিডেন্টের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক বেশ জোরদার করেছেন সি। নিজের দেশে বরাবরই যেকোনো মূল্যে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে চায় তাঁর সরকার। এমন পরিস্থিতিতে ভাগনারের বিদ্রোহের মতো কোনো ঘটনা যদি চীনে ঘটে, তা সির জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন হবে। এ প্রসঙ্গে সাংহাইভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ সেন ডিংলির বলেন, ‘মানুষ যতটা মনে করে, রাশিয়ায় পুতিনের নিয়ন্ত্রণ অতটা পোক্ত নয়—এমন ধারণা থেকে চীন আরও সতর্ক হবে বলে আমি মনে করি। শুধু চীন নয়, রাশিয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কাজাখস্তান, ইউক্রেন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র—সবাই হিসাব–নিকাশ করবে।’  

রোস্তভ-অন-দন শহরে ট্যাংকের ওপরে ভাগনার যোদ্ধারা। এই শহরটি দখল করে নিয়েছিল ভাগনার গ্রুপ। পরে মস্কো অভিমুখে অভিযান বন্ধ ঘোষণার পর শহর ছেড়ে চলে যান তাঁরা

‘দুর্বল পুতিন’

রাশিয়া ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিন সম্পর্কে জটিলতা ছিল। তবে ২০১৩ সালে সি চিন পিং ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। পুতিনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এর একটি বড় কারণ, দুই দেশই যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্ক দেখে।

গত বছর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগ দিয়ে ‘সীমাহীন বন্ধুত্বের’ ঘোষণা দিয়েছিল মস্কো ও বেইজিং। যুদ্ধ শুরুর পর এই সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ঘাড়ে নিয়ে চলা রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের আওতা বাড়িয়ে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করছে চীন। একই সঙ্গে যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকেছে এবং যুদ্ধ বন্ধে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে বেইজিং।

এরপর গত মার্চে মস্কো সফরে গিয়েছিলেন সি চিন পিং। পুতিনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। এই পুতিনের বিরুদ্ধেই তার কিছুদিন আগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। ওই সফরে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার ‘নতুন যুগ’ শুরু করতে একমত হন দুই নেতা। বেইজিংভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর চায়না অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের গবেষক অ্যান্ডি মোকের মতে, সম্প্রতি রাশিয়ায় যা ঘটেছে, তা চীনের জন্য উদ্বেগের। এরপরও দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করতে চীনের প্রতিশ্রুতি ও আকাঙ্ক্ষায় প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম।

‘কয়েক দিন আগে রাশিয়ায় যে ঘটনা ঘটেছে, তা সি চিন পিংয়ের জন্য হয়তো খুবই উদ্বেগের হবে। ওই ঘটনার ফলে রুশ সরকারের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এটা চীনের প্রেসিডেন্টের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়।’
এলিজাবেথ উইশনিক, গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ওয়েদারহেড ইস্ট এশিয়ান ইনস্টিটিউট

রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নিয়ে অ্যান্ডি মোকের সঙ্গে অনেকটা একমত ইউক্রেনের সেন্টার ফর আর্মি, কনভারশন অ্যান্ড ডিসআর্মামেন্ট স্টাডিজের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান ইউরি পোইতা। তবে তিনি মনে করছেন, দুই দেশের মধ্যকার উষ্ণ সম্পর্ক স্বল্প মেয়াদে টিকে থাকবে। একই সঙ্গে রাশিয়ার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত দুর্বলতা সামনে আসার পর দেশটি নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করবে বেইজিং।  

ভাগনারের বিদ্রোহের পর রাশিয়ার অভিজাতদের প্রতি চীনের বিশ্বাস কমে আসবে বলে মনে করেন ইউরি পোইতা। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি, বিদ্রোহ নিয়ে রাশিয়ার নেতারা চুপ ছিলেন। তাঁদের অনেকেই আবার মস্কো থেকে অন্য শহরগুলোতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ভাড়াও আকাশ ছুঁয়েছিল।’

চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে শক্ত থাকবে বলে একসময় মনে করতেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওয়েন-তি সাং। তবে এখন তাঁর সে ধারণায় বদল আসতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, অন্য বিকল্পগুলোর মধ্যে পুতিনকে এখনো সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন সি। তবে পুতিন দুর্বল হয়ে পড়লে তাঁকে আগের মতো কাজে লাগবে না চীনের। দুর্বল পুতিনকে নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। ফলে একটি সুসংহত পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তুলতে তাঁর সক্ষমতা কমে যাবে। আর চীনের সঙ্গে অভিন্ন লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায়ও ভাটা পড়বে।