নির্বাচন ঘিরে গুপ্ত হামলা ও অবৈধ অস্ত্র নিয়ে শঙ্কা

  • ওসমান হাদিকে গুলির পর ঢাকা ও লক্ষ্মীপুরে আরও দুই নাশকতার ঘটনা।

  • নাশকতার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ঢাকা ও চট্টগ্রাম।

  • সারা দেশে পুলিশকে সতর্ক করা হয়েছে।

  • শুরু হচ্ছে বিশেষ অভিযান।

প্রতীকী ছবি

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও নাশকতার আশঙ্কা আরও প্রবল হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। পাশাপাশি যানবাহন এবং নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত হওয়া স্থাপনায়ও অগ্নিসংযোগ করে আতঙ্ক তৈরির চেষ্টাও হতে পারে—এমন আভাসও পেয়েছে পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে। আবার মাঠপর্যায় থেকেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে এমন আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার রাতে পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) সঙ্গে দেশের সব বিভাগের (রেঞ্জ) ডিআইজি এবং মহানগর পুলিশের কমিশনারদের বৈঠকেও এ–সংক্রান্ত আলোচনা এবং করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে পরামর্শ এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে।

এই ক্ষেত্রে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন শুক্রবার দিনের বেলায় ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনাকে সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছে সরকার। হাদির ওপর গুলির ঘটনার পর ওই দিন রাতে আরও দুটি নাশকতার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রাজধানীর বাড্ডায় একটি বাসে এবং লক্ষ্মীপুর জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। গতকাল বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত রাজধানীর শান্তিনগর, মৌচাক ও মিরপুরে চারটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনাকে একই সূত্রে দেখছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আরও পড়ুন

পুলিশ ও র‍্যাবের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন বানচাল করতে চায় এমন গোষ্ঠীটি চোরাগোপ্তা হামলা ও নাশকতার মাধ্যমে ভীতি তৈরির চেষ্টা করবে; যার একটা অন্যতম লক্ষ্য নির্বাচনী কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটানো ও ভোটার উপস্থিতি কমানো। ওই গোষ্ঠীর দেশে-বিদেশে পলাতক থাকা একটা অংশের অনলাইনে এ–সংক্রান্ত কিছু আলাপ-আলোচনার উপাদান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে এসেছে। ইন্টারনেটে একটি যোগাযোগ অ্যাপে এ রকম একটি আলোচনায় লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্কভাবে কাজ করতে বলা হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় শনিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির নেতারা
ছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২

সরকারও এই বিষয়গুলোকে নির্বাচন বানচালের বড় ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় হাদির ওপর হামলাকে নির্বাচন বন্ধের অপপ্রয়াস হিসেবে উল্লেখ করে বক্তব্য এসেছে।

এই সভায় মূলত নির্বাচন ঘিরে মানুষের মধ্যে কীভাবে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা যায়, সেটি গুরুত্ব পেয়েছে। সেখানে ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ফ্যাসিস্ট টেররিস্টদের দমনের’ উদ্দেশ্যে অবিলম্বে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত বা বানচাল করার যেকোনো অপচেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর হস্তে দমন করবে।

আরও পড়ুন

গতকাল দুপুরে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠক করেছেন। সেখানে ওসমান হাদির ওপর হামলাকে সতর্কবার্তা হিসেবে নিতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এর পেছনে বিরাট শক্তি কাজ করছে। ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনটি না হতে দেওয়া। এই আক্রমণ খুবই ‘সিম্বলিক’।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশে পেশাদার সন্ত্রাসী ও অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনার জন্য মাঠপর্যায়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বড় কোনো ঘটনা ঘটলে সেখানে পুলিশের কোনো গাফিলতি পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে ‘ক্লোজ’ করা হবে—এমন আলোচনাও রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে নির্বাচনকেন্দ্রিক সামগ্রিক নিরাপত্তা জোরদার করা হচ্ছে। এই নিরাপত্তাব্যবস্থায় জুলাই অভ‍্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার কারণে যাঁরা সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকতে পারেন, তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। তাৎক্ষণিক ব‍্যবস্থা নিশ্চিত করতে একটি বিশেষ হটলাইন নম্বর চালুরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

আরও পড়ুন

চিন্তা এখন অস্ত্র নিয়ে

জানা গেছে, গতকাল আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে এবং আগের দিন শুক্রবার উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য এবং আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের জরুরি বৈঠকে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

বৈঠক-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সীমান্ত হয়ে যেন অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করতে না পারে এবং কোনো আসামি পালাতে না পারে, সেটি বিশেষভাবে বলা হয়েছে। অবৈধ পথে সীমান্ত পারাপার বন্ধে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।

ব্যাটারিচালিত রিকশায় বসা ওসমান হাদিকে গুলি করেন মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ব্যক্তি। দ্রুত ঘটনা ঘটিয়ে তাঁরা ওই মোটরসাইকেলে সেখান থেকে চলে যান
ছবি: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেওয়া

সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলোতে আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্রের মজুত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করতে বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করেছে এমন চিহ্নিত ব্যক্তিদের ধরতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া পেশাদার সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে প্রচেষ্টা জোরদারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, অবৈধ অস্ত্রের রুটগুলো চিহ্নিত করা এবং অর্থের জোগানদাতাদের শনাক্তে কাজ শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

এসবের পাশাপাশি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধারে জোর দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত হারিয়ে যাওয়া ১ হাজার ৩৩৭টি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এর মধ্যে ৪০০টির মতো পিস্তলও আছে।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নতুন করে দেশে অস্ত্র প্রবেশের আশঙ্কার পাশাপাশি লুট হওয়া অস্ত্রগুলো কোনো অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সেটিও বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। অভিযানে এ–সংক্রান্ত বিষয়গুলোও গুরুত্ব পাবে।

আরও পড়ুন

মাঠপর্যায়ে কঠোর বার্তা

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করার দাবি এসেছে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও। গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিও এসেছে তাদের কাছ থেকে। সব মিলিয়ে নির্বাচনের সময়কালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারকে এ বিষয়ে নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, যেকোনো মূল্যে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের মাঠপর্যায়ে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পুলিশের পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার, আমরা করব। কোনোভাবেই নির্বাচন বানচালের চেষ্টা সফল হবে না। মাঠপর্যায়ে এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভোটার এবং প্রার্থীরা যেন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে পুলিশ সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকবে।’

আরও পড়ুন