গাজীপুরের যে গ্রামের পরতে পরতে ইতিহাসের হাতছানি

বাড়ির আঙিনায় কলাবাগান, চাষের জমি কিংবা পুকুরঘাট সর্বত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে চতুর্ভুজ আকৃতির প্রাচীন টালি ইট। শুক্রবার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কর্ণপুর গ্রামে
ছবি: সাদিক মৃধা

নিরেট গ্রাম বলতে যা বোঝায়, কর্ণপুর ও দড়ি খুঁজেখানি ঠিক তা–ই। শান্ত বানার নদের জল ছুঁয়ে থাকা জনপদ এটি। গ্রাম দুটির পরতে পরতে হাজার বছরের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। গ্রামের কোথাও পড়ে আছে পুরাকীর্তির ভগ্নাংশ। কোথাও আবার হাজার বছরের পুরোনো অমূল্য ইট। কারও বাড়ির সিঁড়িতে পাওয়া গেল প্রত্নতাত্ত্বিক নকশা করা মহামূল্যবান পাথর। কোথাও কোথাও নিজেদের প্রয়োজনে মাটি খনন করতে গিয়ে বাসিন্দারা পেয়েছেন দীর্ঘ প্রাচীন দেয়াল।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গোসিংগা ইউনিয়নে গ্রাম দুটির অবস্থান। সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া জেলার কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া দুর্গের পশ্চিম পাশে গ্রাম দুটির অবস্থান। মাঝে বয়ে গেছে বানার নদ। ইতিহাসবিদদের বইয়েও গ্রাম দুটির হাজার বছরের ইতিহাসের কথা বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন
গ্রাম দুটির বাড়িঘরের আশপাশে বেশ কয়েকটি নকশাখচিত বেলে ও গ্রানাইট পাথর পড়ে থাকতে দেখা যায়
ছবি: সাদিক মৃধা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের ধারণা, দরদরিয়া দুর্গের সোজা বিপরীত পাশে নদের ওপারে দড়ি খুঁজেখানি গ্রামে প্রাচীন স্থাপনার অবস্থান হওয়ায় সেখানে তুঘলক সাম্রাজ্যের স্মৃতিচিহ্ন থাকতে পারে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ওই স্থাপনাকে মধ্যযুগীয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিস্তারিত ইতিহাস জানা যাবে বলে মত দেন এই প্রত্নতত্ত্ববিদ।

প্রত্নতত্ত্ববিদ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান শুক্রবার গ্রাম দুটি পরিদর্শন করে প্রাচীন স্থাপনা সংরক্ষণে উদ্যোগ না থাকায় আক্ষেপ করেন। অধ্যাপকের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে এই প্রতিবেদক দেখেন, দড়ি খুঁজেখানি গ্রামে বিশাল বট ও তেঁতুলগাছ। নিচে মাজার। তিন দিকে তিনটি প্রাচীন দেয়াল। মাজারে গাছের শিকড়ের ভেতরে চতুর্ভুজ আকৃতির শত শত টালি ইট। রয়েছে দুটি বেলে পাথর। পাথরের গায়ে লোহার ছোট দণ্ড সাঁটানোর গর্ত। স্থাপনার উত্তর দিকে বেশ কয়েকটি ঢিবি ও বাড়িঘরের আশপাশ ঘুরে প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।

আরও পড়ুন
বাড়ির আঙিনায় পড়ে আছে হাজার বছরের পুরোনো নকশাখচিত পাথর। শুক্রবার বিকেলে কর্ণপুর গ্রামে
ছবি: সাদিক মৃধা

স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে কথিত আছে, দড়ি খুঁজেখানি গ্রামে প্রাচীন একটি মসজিদ ছিল। মসজিদের উপরিভাগ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। মাটির ভেতরে লুকিয়ে আছে মসজিদের দেয়ালগুলো। অনেকে আবার মনে করেন, সেখানে মসজিদ নয়; মন্দির ছিল। দেয়ালের ইটের গাঁথুনিতে ব্যবহৃত হয়েছে লাল মাটি। মাজার থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে নদের দিকে যেতে যেতে অসংখ্য পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ দেখা গেল।

দড়ি খুঁজেখানি থেকে পশ্চিমে শ্রীপুর সড়ক ধরে দেড় কিলোমিটার এগোলেই কর্ণপুর গ্রাম। মূল সড়ক থেকে দক্ষিণে ৫০০ মিটার গেলে দেখা যাবে বিশাল একটি পুকুর। স্থানীয়ভাবে এটি ‘কনক রাজার পুকুর’ বা ‘বড় পুকুর’ নামে পরিচিত। পুকুরের পশ্চিমে বেশ কয়েকটি বাড়ির উঠানে বিপুল পরিমাণ চতুর্ভুজ আকৃতির টালি ইটের দেখা মিলল। বাড়ির আঙিনায় কলাবাগান, চাষের জমি কিংবা পুকুরঘাট সর্বত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে ইট। বাড়িঘরের আশপাশে বেশ কয়েকটি নকশাখচিত বেলে ও গ্রানাইট পাথর পড়ে থাকতে দেখা গেল।

আরও পড়ুন
শ্রীপুরের কর্ণপুর গ্রামে প্রাচীন ঐতিহ্যের বিভিন্ন উপাদান পরিদর্শন করছেন প্রত্নতাত্বিক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানসহ অন্যরা। শুক্রবার বিকেলে
ছবি: সাদিক মৃধা

ব্যক্তিগত কাজে বাড়ির পশ্চিম পাশে একটি স্থানে পাঁচ ফুট গভীর করে খনন করেছিলেন মো. আলম নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি। খননের সময় বিপুল পরিমাণ চতুর্ভুজ আকৃতির ইট পাওয়া গেছে। পাশের জমিতে সেগুলো স্তূপ করে রেখেছেন তিনি। খনন করা অংশে গিয়ে দেখা গেল, খননের ফলে প্রাচীন স্থাপনার দেয়ালের অংশবিশেষ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। খনন করা অংশের কিছুটা দক্ষিণে আরও একটি প্রাচীরের দেখা পাওয়া গেল। সামান্য দক্ষিণে চতুর্ভুজ আকৃতির ইট দিয়ে বাঁধাই করা কূপের অংশবিশেষ দৃশ্যমান। এ স্থাপনার ৩০০ মিটারের মধ্যে অন্য একটি বাড়ির প্রবেশদ্বারে অষ্টভুজ আকৃতির একটি গ্রানাইট পাথর ছিল।

কথিত আছে, ১০৪৫ সালের দিকে চন্দ্র বংশের শেষ রাজা গোবিন্দ চন্দ্র ও কলচুরির রাজা লক্ষ্মী কর্ণের মধ্যে যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধে লক্ষ্মী কর্ণের কাছে গোবিন্দ চন্দ্র পরাজিত হন। বিজয়ের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে যুদ্ধক্ষেত্রের অদূরে কর্ণপুরে তিনি তখন একটি দিঘি ও রাজবাড়ী নির্মাণ করেন।

আরও পড়ুন
দড়ি খুঁজেখানি গ্রামের বিশাল বট ও তেঁতুলগাছ। নিচে মাজার। মাজারে গাছের শিকড়ের ভেতরে চতুর্ভুজ আকৃতির শত শত টালি ইট
ছবি: সাদিক মৃধা

কর্ণপুরের হাজার বছরের ইতিহাসের ধারণা পাওয়া যায় যতীন্দ্রমোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে। তিনি লিখেছেন, বানার নদের তীরে সমৃদ্ধ নগরীর চিহ্ন বিদ্যমান। শফিকুল আসগর ও আবদুর রশীদের লেখা ‘গাজীপুর জেলার ইতিহাস’ বইয়েও লক্ষ্মী কর্ণ ও গোবিন্দ চন্দ্রের যুদ্ধ ও যুদ্ধ–পরবর্তী বিজয়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রাজবাড়ি নির্মাণের তথ্য পাওয়া যায়। মুনশী রহমান আলী তায়েশের ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’ বইয়েও দুটি গ্রামের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ববিদ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্থানটি পরিদর্শন করে তিনি যেমন অভিভূত হয়েছেন, তেমন দুঃখও পেয়েছেন। এত বড় একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব? এখান থেকে ইট ও দেয়াল তুলে নেওয়া হচ্ছে। এত বড় পুকুর তিনি কমই দেখেছেন। এগুলো উদ্ধার হওয়া দরকার। এতে পর্যটনের নতুন দ্বার উন্মুক্ত হবে। পর্যটনের মাধ্যমে শুধু সরকার নয়, দেশের প্রত্যেক নাগরিক, গ্রামের মানুষ, সবাই উপকৃত হবেন। জনপ্রতিনিধিদের স্থানীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের দায় আছে।

আরও পড়ুন
ব্যক্তিগত কাজে বাড়ির পাশে একটি স্থানে পাঁচ ফুট গভীর করে খনন করেছিলেন আলম নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি। খননের সময় বিপুল পরিমাণ চতুর্ভুজ আকৃতির ইট পাওয়া যায়
ছবি: সাদিক মৃধা

আইন অনুযায়ী প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার ক্ষতি করা দণ্ডনীয় অপরাধ। স্থানীয় লোকজন বিষয়টির গুরুত্ব না বুঝে যাচ্ছেতাইভাবে খনন করছেন। তাঁদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে তাঁরা এড়িয়ে যান।

স্থানীয় বাসিন্দা অশীতিপর সিরাজউদ্দিনের ভাষ্য, ‘এখানে এত প্রাচীন ইতিহাস আছে, আমরা জানতাম না। আমরা জানতাম এটা কনক রাজার দিঘি। কিন্তু এই রাজা কে বা কখন এসেছিলেন, আমাদের জানা নেই। দিঘির আশপাশে মাটির নিচ থেকে প্রচুর ইট ওঠে। লোকজন এগুলো বিভিন্ন কাজে লাগায়।’

শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীমা ইয়াসমীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নিজে গ্রাম দুটি পরিদর্শনে যাব। এ বিষয়ে যাঁরা অভিজ্ঞ, তাঁদের সঙ্গে কথা বলব। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় স্থানটি কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে আলাপ করব। ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে যা করা দরকার, সবই করা হবে।’

আরও পড়ুন
বাড়ির প্রবেশদ্বারে অষ্টভুজ আকৃতির গ্রানাইট পাথর
ছবি: সাদিক মৃধা

সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে গ্রাম দুটি পরিদর্শনে এসেছিলেন শ্রীপুর কলেজের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান মো. সেলিম মোল্লা। তিনি বলেন, কর্ণপুরের প্রাচীন রাজবাড়ির ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। এটি খনন করে সঠিক ইতিহাস উদ্‌ঘাটন করা প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষের উচিত স্থাপনাটি সংরক্ষণ করা।

আরও পড়ুন